মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/১

মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতাঃ

 গত ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরের অযােধ্যার ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে সারা দেশ জুড়ে যে অভূতপূর্ব হিন্দু জাগরণ শুরু হয়েছে, আমাদের বামপন্থী নেতৃবৃন্দ তার মূল সুরটি অনুধাবন করতে পুরােপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। তারা একে একটি মামুলি ও ক্ষণস্থায়ী ধর্মীয় জিগীর হিসাবে ধরে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে এর বিরােধিতায় নেমে পড়েছেন। যদিও তারা ভাবছেন যে নিষ্ঠাবান মার্কসবাদীর কাজই তারা করছেন, কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে, যে পথ তারা বেছে নিয়েছেন তা চূড়ান্তভাবে অ-মার্কসবাদী, ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী।

 যে ভুলটি তারা অতীতেও করেছেন এবং আজও করে চলেছেন তা হল, হিন্দুত্বই যে ভারতের জাতীয়তাবাদ এই ধ্রুব সত্যটিকে তারা স্বীকার করতে নারাজ। কারণ কি? কারণ হল এই যে মার্কস সাহেব অনেক মূল্যবান গ্রন্থ লিখে গেছেন ঠিকই, তার কোনাে গ্রন্থেই তিনি এই কথা লিখে যাননি যে, ‘হিন্দুত্বই ভারতের জাতীয়তাবাদ’। শুধু ঋষি অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ বা স্বামী বিবেকানন্দের মত ভারতীয় মনীষীরাই এই কথা বলে গেছেন। কিন্তু ভারতীয় মনীষীদের এই সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা শােনার তাদের প্রয়ােজনই বা কি আর সময়ই বা কোথায়? তাদের মতে মার্কস নামে জার্মানীতে এক ভদ্রলােক জন্মেছিলেন এবং শুধু তারই মস্তিষ্কে কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল। অথবা লেনিন নামে রাশিয়ায় এক ভদ্রলােক জন্মেছিলেন শুধু তার খুলিতেই ঘিলু নামক পদার্থ ছিল। এছাড়া বাদবাকী সবাই হল মূখস্য মূখ। কাজেই এই সব মূখরা কি বলেছে না বলেছে তাতে কিই বা আসে যায়? আর তারা যে সব বইপত্র লিখে রেখে গেছেন তা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলেই বা কি ক্ষতিবৃদ্ধি হয়?

 এদের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে যে, যা ধর্ম তাই রিলিজিয়ান এবং যেহেতু বুদ্ধিমান মার্কস রিলিজিয়নকে আফিম বলে গেছেন, তাই ইসলাম বা খ্রিস্ট ধর্মের মত হিন্দুধর্মও আফিম এবং পরিত্যাজ্য। এই বিশ্বে একমাত্র মার্কস সাহেবের বাণীই অভ্রান্ত সত্য, তাকে অতিক্রম করবে কে? তাই যে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু দর্শনকে না জানলে ভারতবর্ষকে জানা যায় না, ভারতবর্ষকে বােঝা যায় না, মার্কসবাদের দ্বারা বিকৃতবুদ্ধি সেই সব মার্কসবাদীরা হিন্দুধর্মকে জানার কোনাে আন্তরিক চেষ্টা তাে করলই না, বরং আফিমের মতই পরিত্যাগ করল। একমাত্র মার্কসীয় কেতাবেই সর্বশক্তিমান এবং সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক সত্য আছে। তাই অন্য কোবে কি প্রয়ােজন?

 কাজেই এই বিশাল ও সুপ্রাচীন দেশ সম্বন্ধে স্বল্পবুদ্ধি কূপমণ্ডুক মার্কসবাদীদের জ্ঞান বাহ্যিক স্তরেই পড়ে থাকল। ভারতবর্ষ বলতে তারা বােঝেন খানিকটা ভৌগােলিক সীমা যেখানে নানা ভাষা নানামতের কিছু লােক বসবাস করে এবং ইউরােপের বর্বরদের মতাে তাদের মধ্যেও তথাকথিত শ্রেণিসংগ্রাম বিদ্যমান। ভারতবর্ষের অন্তরকে, ভারতবর্ষের আত্মাকে জানার বােঝার কোনাে চেষ্টাই তারা করলেন না। কোন্ অদৃশ্য সূত্র এই কোটি কোটি ভারতবাসীকে একত্রে গ্রথিত করে রেখেছে, কোন অদৃশ্য শক্তি কোটি কোটি ভারতবাসীকে প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করছে বা কোন অদৃশ্য চেতনা এই ভারতের মাটিতে যাজ্ঞবল্ক্য, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ বা বুদ্ধ, শঙ্কর বা চৈতন্যের মত মহাপ্রাণ মহামানবদের জন্ম দিয়েছে তার কোনাে আভাষও, তাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব হল না।

 অবশ্য এসব জানবার বা বুঝবার কোনো প্রয়োজন আছে বলেই তাঁরা মনে করেন না। কারণ এইসব গোঁড়া (fanatic), অর্ধশিক্ষিত ও বিকৃতবুদ্ধি মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, পাশ্চাত্য থেকে সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের যে বড়ি তাঁরা নিয়ে এসেছেন তার থেকে ভাল আর কিছু হয় না বা হতে পারে না। যে কোনো রুগীকে এই অত্যাধুনিক দাওয়াই একবার খাওয়াতে পারলেই হল, সব রোগ নিমেষে আরোগ্য হয়ে যাবে। রুগীকে পরীক্ষা করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই, শুধু সেই বড়ি তাকে গিলিয়ে দাও। তাই তাঁরা ভারতবর্ষের নাড়ী টিপে দেখারও প্রয়োজন মনে করলেন না এবং সেই বড়ি গেলাতে উদ্যত হলেন। কিন্তু সুখের কথা হল সেই বড়ি ভারতবর্ষকে দিয়ে গেলানো গেল না। ভারতবর্ষ তা বমি করে ফেলে দিল।

 তাই চীনেরও আগে এই ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি তার কাজকর্ম শুরু করা সত্ত্বেও আজ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরালা ছাড়া আর কোথাও মার্কসবাদকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভারতের সুসভ্য মানুষ বর্বর মার্কসবাদী তত্ত্বকে সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে। যে তত্ত্ব শুধু মানুষের আহার-নিদ্রা আর মৈথুনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেই শিশ্নোদর তত্ত্বকে আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষ যে জঞ্জালের মতই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

 এই সব মার্কসবাদীদের সম্বন্ধে বলতে গেলে মাইকেলের ভাষায় বলতে হয় “পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি....”। এঁরা জানেনই না যে আমাদের পূর্বপুরুষগণ কি সম্পদ আমাদের জন্য রেখে গেছেন বা এই ভারতবর্ষের ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করার ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে কি অমূল্য সম্পদই না আমরা পেয়েছি। তা জানলে ভিক্ষুকের মত বিদেশ থেকে মার্কসবাদের তত্ত্ব ভিক্ষা করতে যেতেন না। ভারতবর্ষের এই বৌদ্ধিক সম্পদের সম্ভার সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে আমেরিকার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শ্রী উইল ডুরাণ্ট বলেন, “India is the motherland of our race, and Sanskrit is the mother of European languages. She was the mother of our philosophy-mother, through the Arabs, of much of our mathematics-mother through Buddha of the ideas embodied in christianity-mother, through village community of self government and democracy. Mother India is in many ways the mother of all.” সেই ভারতবর্ষের সন্তান ভিক্ষাপাত্র হাতে করে বিদেশ থেকে মার্কসবাদের মত একটি অপরিণত, অমার্জিত, বর্বর তত্ত্ব ভিক্ষা করে এনেছে এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করছে—এর থেকে দুঃখের ও লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে।

 অবশ্য মার্কসবাদীরা যুক্তি দেখাবেন যে উপরিউক্ত সমস্ত ভারতীয় দর্শনই ভাববাদী এবং এরা শুধু বর্তমান জগৎকে ব্যাখ্যা করতে পারে, পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু বুদ্ধিমান মার্কস এমন এক গূঢ় তত্ত্বের আমদানী করেছেন যা বস্তুবাদী, বৈজ্ঞানিক এবং জগৎকে পরিবর্তন করতে সক্ষম। বস্তু বলতে কি বোঝায় বা বস্তুর মূল কোথায় তার আধুনিক ব্যাখ্যা জানলে মার্কসবাদীদের পক্ষে বস্তুবাদী দর্শন নিয়ে লাফালাফি করা সম্ভব হত না, কারণ বস্তুর ঊনবিংশ শতাব্দীর সংজ্ঞাই তাদের জানা আছে। আর যে মার্কসবাদকে তাঁরা বৈজ্ঞানিক বলে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে চলেছেন, সে সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে Bertrand Russel লিখেছেন এই বিশাল বিশ্বের মধ্যে “His (Marx's) perview is confined to this planet, and, within this planet, to man. No man who has failed to assimilate this fact has a right to call his philosophy scientific”. তিনি আরও লিখেছেন, “Broadly speaking, all the elements in Marx's philosophy, which are derived from Hegel, are unscientific in the sense that there is no reason to suppose them true.” (Chapter on Marx, History of Western philosophy)।

 মার্কসবাদী তত্ত্ব জগৎকে পরিবর্তন করতে পারে— একথা শুনলে মনে হবে যে মার্কসের তত্ত্ব বুঝি সূর্য-চন্দ্রের গতিপথকেও পরিবর্তিত করে দিতে পারে। কিন্তু তা নয়। মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সীমা যেহেতু মনুষ্য সমাজ পর্যন্ত, তাই এই কথার মধ্য দিয়ে মনুষ্য সমাজের পরিবর্তনের কথাই বলা হয়ে থাকে। সমাজের সকল মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, সমগ্র দেশকে একটা জেলখানায় রূপান্তরিত করে, যে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা মার্কসের তত্ত্ব প্রচার করে, ১৯৯১ সালে রাশিয়ার জনগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছে। রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের নায়ক মহামতি লেনিনের মূর্তি তাঁরই প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রের দ্বারা লালিত-পালিত মানুষ গাঁইতি-শাবল দিয়ে ভেঙেছে শুধু নয়, সেই ভগ্ন মূর্তিতে মলমূত্র ত্যাগ করেছে।

 এখানে আরও একটা কথা বলার আছে। মার্কসবাদীদের মতে মার্কসবাদ হল এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং তাঁরা নিজেরা হলেন চরমভাবে বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন। অবৈজ্ঞানিক সব কিছুই তাঁদের কাছে পরিত্যাজ এবং বৈজ্ঞানিক সব কিছুই তাঁদের আদরণীয়। এ হেন মার্কসবাদীরাই আবার বলেন যে, সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা বা dead language, এবং তাই পরিত্যাজ্য। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সংস্কৃত যে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৈজ্ঞানিক ভাষা, তা তাঁদের জানা নেই। তাই এটাও অনুমান করা চলে যে, ইংরাজী science শব্দ যে সংস্কৃত ছিদ্ ধাতু (অর্থ কাটা) থেকে এসেছে তাও তাঁদের জানা নেই। সংস্কৃত ছিদ্ থেকে ল্যাটিন sciendere (to split) এসেছে। কালক্রমে এই sciendere থেকে ফরাসী sciens ও scient এসেছে। শেষ পর্যন্ত ফরাসী sciens থেকে ইংরাজী science এসেছে। কাজেই ইংরাজী science-এর জননী সংস্কৃত ছিদ্‌।

 যাই হোক, উপরিউক্ত মার্কসবাদী সমাজ পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান। কিন্তু যেই চীনের সমাজতন্ত্রকে আমাদের মার্কসবাদীরা তাদের আদর্শস্থল ও প্রেরণার উৎস বলে বর্ণনা করেন, সেখানে কি অবস্থা? ছোট, মাঝারি ও বৃহৎ মিলিয়ে চীনে প্রায় ৩ লক্ষ সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল এবং সেগুলোতে প্রায় ২৫ কোটি শ্রমিক কাজ করত। গত ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পার্টি-কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতি জিয়াং তাঁর পরিকল্পনা (Jiang's Plan) পেশ করেন। তাতে প্রস্তাব রাখা হয় যে, মাত্র ১০০০ সংস্থাকে সরকারি আওতায় রেখে বাদবাকিগুলোকে ব্যক্তিগত মালিকানায় তুলে দেওয়া হবে। বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার জন্য জিয়াং-এর প্রতিদ্বন্দ্বী কিয়াও শী-কে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯৮ সালে এই প্রাইভেটাইজেশনের কাজ শুরু হয়েছে যা ৫ বছর ধরে চলবে এবং এর ফলে ২ কোটি ৫০ লক্ষ শ্রমিক বেকার হবে। মার্কসীয় তত্ত্বের দ্বারা সমাজ পরিবর্তনের চিত্রটা যাতে আরও পরিষ্কার হয় তাই বর্তমান চীনের উপরিউক্ত উদাহরণটি দেওয়া গেল।