মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/২

ভারতবর্ষ সম্পর্কে মার্কসের চূড়ান্ত অজ্ঞতা:

 কোনো একটি দেশকে জানতে গেলে সর্বপ্রথম সেই দেশের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু জানা আবশ্যক। মার্কস সারা জীবনে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সাকুল্যে দু’খানা প্রবন্ধ লিখেছেন, “ভারতে বৃটিশ শাসন” এবং “ভারতে বৃটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল”। পরিশিষ্ট-১ এবং পরিশিষ্ট-২ দ্রষ্টব্য। যে কেউ এই প্রবন্ধদ্বয় পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন যে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মার্কসের জ্ঞান ছিল নিতান্ত ভাসা ভাসা এবং ভারতের জলবায়ু সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। “ভারতে বৃটিশ শাসন” প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “আবহাওয়া ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য, বিশেষ করে সাহারা থেকে শুরু করে আরব, পারস্য, ভারত ও তাতারিয়ার মধ্য দিয়ে সমুন্নত এশীয় মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহৎ বৃহৎ মরু অঞ্চলের অস্তিত্বের ফলে খাল ও জলাশয় থেকে কৃত্রিম সেচ ছিল প্রাচ্য কৃষির ভিত্তি। যেমন মিশর ও ভারতে, তেমনি মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেশেও বন্যার জল দিয়ে ভূমির উর্বরতা সাধন করা হয়,....” এ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের কৃষি যে মূলত জলসেচের বদলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর দ্বারা সৃষ্ট বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল, এই সাধারণ তথ্যটিও মার্কসের জানা ছিল না।

 আর পাঁচটা সাধারণ ইয়োরোপীয়ের মত মার্কসও মনে করতেন যে একমাত্র ইয়োরোপীয় সমাজই পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুসভ্য ও সংস্কৃতি-সম্পন্ন জাতি। তাই মার্কসের চোখে ভারতবর্ষ একটা অর্ধনগ্ন, অসভ্য, জংলীদের দেশ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং ভারতীয়দের ধর্মও নানা রকম দেবদেবী, পুতুল, গাছপালা বা প্রকৃতি পূজনকারী একটা জংলী বা pagan ধর্ম বিশেষ। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতের হিন্দুরা যে মহান সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকার ফলেই মার্কস লিখতে পারলেন যে, “ভারতীয় সমাজের কোনো ইতিহাস নেই। ভারতের ইতিহাস বলতে যা বোঝায় তা শুধু একের পর এক বহিরাক্রমণকারীর ইতিহাস, যারা ঐ অপ্রতিরোধী ও অচলায়তন সমাজের নিষ্ক্রিয় ভিত্তির উপর তাদের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে।” তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, ঐ সব পুরানো আক্রমণকারীরা সকলেই ছিল বর্বর ও তাতার, তাই তারা কালক্রমে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ভারতীয় সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছে এবং একমাত্র “বৃটিশরাই হল প্রথম বিজয়ী যারা সভ্যতায় হিন্দুদের চেয়ে উন্নত এবং সেই হেতু তার কাছে অনধিগম্য।”

 এখানে আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, মার্কস হলেন সেই ইয়োরোপীয় সমাজের প্রতিনিধি যাদের অভিধানে শ্রদ্ধা, সাধনা, ভক্তি, মোক্ষ ইত্যাদি শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই। সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ গুণ সম্বন্ধে যাদের কোনো ধারণা নেই; সাত্ত্বিক জীবনযাত্রা বা সাত্ত্বিক আহার-বিহারের ধারণা যাদের কাছে নিতান্তই দুর্বোধ্য; বস্তুগত ভোগের সামগ্রী হস্তগত করে ভোগ করা এবং লালসার চরিতার্থতাই যাদের জীবনের চরম লক্ষ্য এবং এই উদ্দেশ্যে যারা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশ ও মহাদেশের আদিম অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে নিঃশেষ করে ফেলেছে; আফ্রিকার অধিবাসীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, বন্দী করে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার বাজারে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করেছে; নীল চাষের আমলে আমাদের দেশের কৃষক সমাজের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে; কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের মত জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। এইসব সুসভ্য (?) জাতিদের ধর্ম শিক্ষা দেয় যে পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করার জন্যই ভগবান পৃথিবীতে তাঁদের পাঠিয়েছেন। তাই নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তারা পৃথিবীকে মনুষ্যবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। এদের অত্যাচারে বহু প্রজাতির জীবজন্তু আজ পৃথিবী থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং আরও বহু প্রজাতি লুপ্ত হবার আশঙ্কায় দিন গুনছে।

 কাজেই এইসব অসভ্য, বর্বর ও সংস্কৃতিহীন লোকেরা ভারতের সভ্যতার মহত্ত্বকেই বা উপলদ্ধি করবে কেমন করে, আর তার মর্মবাণীকেই বা অনুধাবন করবে কেমন করে? এই সব অসভ্যের দল চুরি-ডাকাতি করে হঠাৎ বড়লোক হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছে। চীৎকার করে বলতে শুরু করেছে যে, পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র তারাই সভ্য আর সবাই অসভ্য। অথচ তাদের আচার-আচরণ প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ দিচ্ছে যে, আজও তারা পশুত্বের উপরে বেশি দুর উঠতে পারেনি। তাই তো তাদের দেশের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে পশুদের মতই মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। পতি-পত্নীর সম্পর্ক বলতে সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হবার ফলে পরিবার ধ্বংসপ্রায়। পশুদের চেয়েও অবাধ যৌন সম্ভোগের ফলে ‘এইডস্’ রোগ এখানে লেলিহান শিখার মতই ছড়িয়ে পড়ছে। চুরি, রাহাজানি, খুন, জখম, মাদকাসক্তি এবং নারীর প্রতি বলাৎকারে এদের সমাজ সকলের শীর্ষে। ঘন ঘন বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে জন্ম নিচ্ছে পিতা-মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত বেপরোয়া, ভয়ঙ্কর এক নাবালক অপরাধী শ্রেণি। তারা বন্দুক নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে আর সহপাঠীদেরই মেরে শেষ করে ফেলছে।

 তাই এই অসভ্যের দল যখন ভারতীয় সমাজকে অসভ্য বলে এবং এই অসভ্য সমাজের প্রতিনিধি মার্কস মন্তব্য করেন যে, “ভারতবর্ষে বৃটিশকে একটা দ্বিবিধ কর্তব্য পালন করতে হবে, একটি ধ্বংসমূলক এবং অন্যটি গঠনমূলক—পুরাতন এশিয় সমাজকে ধ্বংস করে এশিয়ায় পাশ্চাত্য সমাজের বৈষয়িক উন্নতির প্রতিষ্ঠা করা”, তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় যে, কোন্ জিনিসটাকে মার্কস সভ্যতার নির্ণায়ক মানদণ্ড রূপে ব্যবহার করতে চান? কে কত জামাকাপড় পরে তাই যদি এই মানদণ্ড হয় তবে মার্কস সাহেবকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে এস্কিমোরা তাদের থেকে বেশি সভ্য। আর গায়ের রঙের বিভিন্নতা যদি অসভ্যতার মাপকাঠি হয় তবে তার উপযুক্ত জবাব — ঘোড়াই বিভিন্ন রঙের হয়, আর গাধা সব এক রঙেরই হয়।

 দাম্ভিক মার্কসের মতে ভারতের কোনো অতীত ইতিহাস নেই। কাজেই মেনে নিতে হয় যে, তাঁর দেশ জার্মানীর অবশ্যই অতীত ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস কি মার্কস সাহেব কখনও অধ্যয়ন করে দেখেছেন যে, ভারতে যখন ঋগ্বেদ, সামবেদ ইত্যাদি, কিংবা রামায়ণ, মহাভারত, সাঙ্খ্য দর্শন, অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি রচিত হচ্ছিল তখন তাঁর দেশবাসীরা পুরানো প্রস্তর না নব্য প্রস্তর যুগে ছিল? তখন কি তারা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল না কাঁচা মাংস খেত? নাকি তখন তাঁরা পুরোপুরি মানুষ হয়েই ওঠেনি, শাখামৃগ হয়ে গাছে অবস্থান করছিল? যাইহোক, মার্কস বিপ্লবের শুরু। তাই একজন যকৃতের রুগী যেমন সব কিছুকে হলুদ দেখে, তিনিও সেই রকম সব কিছুর মধ্যেই বিপ্লব দেখতে পান। তাই তো তিনি বৃটিশের দ্বারা ভারতীয় বয়ন শিল্পের নির্মম ধ্বংসের মধ্যেই বিপ্লব দেখতে পেয়েছেন এবং লিখেছেন, “ইংরাজের হস্তক্ষেপ সূতাকাটুনীর স্থান করেছে ল্যাংকাশায়ারে আর তাঁতীর স্থান রেখেছে বাংলায়; অথবা হিন্দু সূতাকাটুনী ও তাঁতী উভয়কেই নিশ্চিহ্ন করে ঐ সব ছোট ছোট অর্ধবর্বর, অর্ধসভ্য গোষ্ঠীগুলোকে ভেঙে দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিতে ধ্বংস করেছে এবং এইভাবে সে যে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করেছে তা এশিয়ায়, এতদিন যা শোনা গেছে তার মধ্যে, সর্ববৃহৎ এবং সত্যি কথা বলতে, একমাত্র বিপ্লব”।

 তাহলে মার্কসের মতে বিপ্লব বলতে কি বোঝায়? ভারতের (বা বৃহদর্থে এশিয়ার) যা কিছু বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা আছে তার সব কিছুকেই বিসর্জন দিয়ে বা বলপূর্বক ধ্বংস করে সমস্ত ইয়োরোপীয় হালচালকে অন্ধভাবে অনুকরণ করা এবং ভারতের মাটিতে তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার নামই কি বিপ্লব? হ্যাঁ তাই, কারণ এই অসভ্য ভারতীয় সমাজকে সুসভ্য করে গড়ে তুলতে আর কোনো রাস্তাই মার্কস খুঁজে পাচ্ছেন না এবং এইভাবে বিপ্লব রপ্তানী করে ইংরাজরা ভারতের যে মহান উপকার করে চলেছে তার প্রশংসা না করে পারছেন না। তাই লিখছেন, “বৃটিশের যত দোষই থাক না কেন, তবুও সে নিজের অজান্তেই এই বিপ্লবের কাজ করে যাচ্ছে।” তাহলে প্রশ্ন থাকছে যে, এই রকম একটা বিপ্লব ঘটাবার জন্যই কি আমাদের মার্কসবাদীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন? তাহলে তাঁদের এই পরামর্শই দিতে হয় যে, কেন তাঁরা আর বৃথা খাটাখাটি করবেন? তার থেকে বরং বৃটিশদের বা অন্য ইয়োরোপীয়দের ডেকে নিয়ে আসুন। তাঁরা সেই বিপ্লব অনেক ভালভাবে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে করতে পারবে।