মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/১১
পাশ্চাত্যের রিলিজিয়ন:
পাশ্চাত্যের খ্রিস্টধর্ম ও আরবের ইসলাম রিলিজিয়নের প্রকৃত উদাহরণ। এদের তুলনা করা চলে আজকের বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে। এই সব কোম্পানিগুলো যেমন বলছে, একমাত্র তাদের তৈরি সাবানেই জামা-কাপড় পরিষ্কার হবে বা তাদের তৈরি দাঁতের মার্জনেই দাঁত পরিষ্কার হবে, অন্য সব কোম্পানির সাবান বা মাজন সব বাজে মাল। এই রিলিজিয়ন দুটিও দিনরাত ওই একই কথা বলে চলেছে। বিক্রির জন্য তারা তাদের উপাসনা পদ্ধতির মতবাদকে হাজির করে বলছে যে, একমাত্র তাদের মতকে অনুসরণ করলেই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, স্বর্গলাভ হবে। অন্য কোনো মত অবলম্বন করে স্বর্গে যাওয়া অসম্ভব। উপরন্তু তারা আরও বলছে যে, তারা যে ঈশ্বরের ভজনা করে সে-ই একমাত্র খাঁটি ঈশ্বর এবং অন্যান্য লোকেরা যে ঈশ্বরের ভজনা করে তা মেকী ঈশ্বর। তারা যে পথ অনুসরণ করে চলেছে সেটাই একমাত্র খাঁটি পথ এবং বাদবাকি সবাই যে পথ অনুসরণ করে চলেছে সে সবই মেকী পথ। এ থেকে তাদের সিদ্ধান্ত হল, প্রথমত যে সমস্ত লোক সেই মেকী পথ অনুসরণ করে মেকী ঈশ্বরের ভজনা করে চলেছে তারা ঘৃণ্য ও বধযোগ্য। দ্বিতীয়ত, সেই মেকী ঈশ্বরের ভজনাকারী বিধর্মী লোকেদের ধর্মান্তরিত করে খাঁটি ঈশ্বরের পথে নিয়ে আসতে হবে। সোজা কথায় না হলে বলপ্রয়োগ ও রক্তপাত ঘটিয়েও তা করতে হবে। তৃতীয়ত মেকী ঈশ্বর ও মেকী পথ সম্পর্কিত যে সব গ্রন্থাদি আছে তার থেকে কিছুই শিক্ষণীয় নেই। ঐ সব গ্রন্থ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না।
তাই খ্রিস্টমত বলছে, যে যীশুর শরণাপন্ন না হবে তার পরিত্রাণ নেই (2 Timothy-3) যে খ্রিস্টকে অনুসরণ করবে একমাত্র সেই পরিত্রাণ পাবে (2 Peter-3/13)। অ-খ্রিস্টানদের উপর ঈশ্বরের ক্রোধ বর্ষিত হবে (Hebrews-3/11)। অ-খ্রিস্টানরা বন্য পশু (2 Peter-2/12), ওদের ঘরে ঢুকতে দিও না (2 John-10), ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো না (2 Corinthian-6/ 14), ওদের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ কোরো না (3 John-7) এবং ওরা হল ঈশ্বরহীন পশু (Jude-4)। খ্রিস্টকে অনুসরণকারীরা হল ঈশ্বরের নির্বাচিত প্রিয়পাত্র (Colossians-3/12, Peter-1/1, 2/9, 2/18; Thessalonians-1/4; Titus-1/1 ইত্যাদি)। অ-খ্রিস্টানরা সকলেই নরকের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে (2 Thessalonians-1/89)।
ঠিক একই ভাবে ইসলাম বলছে, যারা কোরান ও মহম্মদের নবীত্বে বিশ্বাস করে না তারা কাফের এবং পশুর সমান (কোরান-৭;১৭৯)। এরা সবাই নরকে যাবে (ঐ ৩/৮৫) এবং এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো না (ঐ ৫/৫৭)। আল্লা এদের জন্য মর্মস্তুদ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন (ঐ ৪/১৪৭, ৪/১৪৮, ৮/১০-১৪)। এরা নিষ্ঠুরভাবে বধযোগ্য (ঐ ৩৯/৩০-৩২)। এদের যেখানে পাবে বন্দী করবে এবং হত্যা করবে (ঐ ৪/৮৯, ৪/৯১, ২/১৯১)। এদের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করো, গর্দানে আঘাত করো (ঐ ৮/৩৯, ৪৭/৪)। ওদের শূলবিদ্ধ করো অথবা হাত-পা কেটে দাও (ঐ ৫/৩৩)।
বিধর্মী কাফেরদের প্রতি আল্লা কতখানি নৃশংস হতে পারেন, দু একটা উদাহরণ দিলে তা ভালো বোঝা যাবে। কোরানের ৯ম সুরায় ৫ম আয়াতে আল্লা বলেছেন— অতঃপর নিষিদ্ধ মাসমস্হ শেষ হলে অংশীবাদী কাফেরদের যেখানে পাবে বধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওৎ পেতে থাকবে। কিন্তু যদি তারা তওবা (অনুতাপ) করে, নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয় তবে তাদের মুক্ত করে দেবে। ৪র্থ সুরার ৫৬শ আয়াতে আল্লা বলছেন— যারা আমার আয়াতে বিশ্বাস না করে তাদের আমি অবশ্যই জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ করবো এবং প্রত্যেকবার দগ্ধ করার পর নতুন চামড়ার সৃষ্টি করবো, যাতে তারা নিরন্তর শাস্তি ভোগ করতে পারে। ৫ম সুরার ৩৩শ আয়াতে আল্লা বলছেন— যারা আল্লা ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে পৃথিবীতে অশান্তি উৎপাদন করে, নিশ্চয়ই তাদের শাস্তি হল এই যে, তাদের হত্যা করো, কিংবা শূলবিদ্ধ করো, কিংবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেল, কিংবা তাদের দেশ থেকে থেকে বহিষ্কার করো।
উপরিউক্ত বাণীগুলো থেকে দুটো সিদ্ধান্ত করা চলে। প্রথমত, এই রিলিজিয়নগুলো হল মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী এক ধরনের তত্ত্ব। সমগ্র মানবসমাজকে এরা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী— এই দুই শিবিরে ভাগ করে। এগুলো একপ্রকার ঘৃণার তত্ত্ব। এদের ঈশ্বরও অন্য ধর্মাবলম্বী বা অবিশ্বাসীদের প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করে থাকেন এবং অনন্ত নরকের আগুনে নিক্ষেপ করেন। তাই এদের ঈশ্বর শুধু বিশ্বাসীদের প্রতিই করুণাময় ভগবান এবং অবিশ্বাসীদের কাছে ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ দানব বা জল্লাদ বিশেষ। কিন্তু হিন্দুর ভগবান বলেন— সকলেই আমার কাছে সমান এবং কেউ আমার প্রিয়ও নয়, কেউ আমার বিদ্বেষভাজনও নয় (গীতা—৯/২৮)। অথবা যে আমাকে যেমনভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেই ভাবেই সন্তুষ্ট করে থাকি (ঐ— ১/২৩)।
দ্বিতীয়ত, এই রিলিজিয়নগুলোকে তুলনা করা চলে আজকের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এবং সেই হিসাবে রিলিজিয়নগুলোও এক ধরনের রাজনৈতিক মতবাদ মাত্র। মানুষের নৈতিক চরিত্র কীভাবে উন্নত হবে, সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক পথে সে কেমন করে অগ্রসর হবে ইত্যাদি ব্যাপারে এদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের কথা হল শুধু আমার দলে যোগ দাও তাহলেই সব আপনি-আপনিই হয়ে যাবে, অনন্ত স্বর্গবাসের ব্যবস্থা পাকা হয়ে যাবে। আর আমার দলে যোগ না দিলে অনন্ত নরকের আগুনে পুড়ে মরতে হবে। এইভাবে লোভ দেখিয়ে দলের সদস্যসংখ্যা বাড়াতে হবে। ভালো কথায় কাজ না হলে নির্যাতন, হত্যা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়েও সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হবে এবং সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ধর্মের নামে এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্মের নামে এইসব কার্যকলাপ এবং নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতাকে লক্ষ্য করে বিবেকানন্দ লিখছেন— খ্রিস্টধর্ম চিরকালই তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে। কি আশ্চর্য, খ্রিস্টের মত নিরীহ মহাপুরুষের শিষ্যরা এত নরহত্যা করেছে। তলোয়ার ছাড়া খ্রিস্টধর্ম কোথায় সফল হয়েছে? ... আমি জানি, তোমাদের পূর্বপুরুষরা কি করে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তাদের সম্মুখে দুটি বিকল্প ছিল, হয় ধর্মান্তর গ্রহণ নয় মৃত্যু, এই তো?
স্বামীজি আরও লিখছেন,—মুসলমানরা এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা অপরিণত ও সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন। তাহাদের মূলমন্ত্র, আল্লা এক এবং মহম্মদই একমাত্র পয়গম্বর। যাহা কিছু ইহার বহির্ভূত সে সমস্ত কেবল খারাপই নহে, উপরন্তু সে সমস্তই তৎক্ষণাৎ ধ্বংস করিতে হইবে; যে কোন পুরুষ বা নারী এই মতে সামান্য অবিশ্বাসী তাহাকে নিমেষেই হত্যা করিতে হইবে; যাহা কিছু এই উপাসনা-পদ্ধতির বহির্ভূত তাহাকেই অবিলম্বে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হইবে, যে কোন গ্রন্থ অন্যরূপ মত প্রচার করিয়াছে সেগুলিকে দগ্ধ করিতে হইবে। প্রশান্ত মহাসাগর হইতে আটলাণ্টিক মহাসাগর পর্যন্ত ব্যাপক এলাকায় দীর্ঘ পাঁচশত বৎসর ধরিয়া রক্তের বন্যা বহিয়া গিয়াছে। ইহাই মুসলমান ধর্ম (বিঃ রঃ ঐ, ৫/৪১৭, ৪/১২৫)।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ধর্ম এবং রিলিজিয়ন শব্দ দুটি কখনই সমার্থক হতে পারে না। উপরন্তু এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হিন্দু বা সনাতন ধর্ম কোনো মতেই ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের সমতুল্য নয়। প্রথমত, হিন্দুধর্মে কোথাও বলা হয়নি যে, যারা হিন্দু নয় তাদের হত্যা করতে হবে বা তারা নরকে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, হিন্দুধর্ম মানুষের মধ্যে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর বিভেদ সৃষ্টি করে না। হিন্দু এই বিশ্বের সকল মানুষকেই ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের পুত্র বলে বিশ্বাস করে। তাই হিন্দু যখন বলে যে, “সর্বে সুখিনঃ সন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ” তখন সে বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই সুখ-শান্তি ও আরোগ্য কামনা করে, বিশেষ কোনো মানবগোষ্ঠীর জন্য তা করে না। দ্বিতীয়ত, হিন্দু বলে না যে কাউকে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু করতে হবে, বা ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হবে। তৃতীয়ত, হিন্দু কখনও বলে না যে, আমি যে ঈশ্বর ভজনা করি সেই খাঁটি ঈশ্বর বা আমি যে পথ অনুসরণ করছি সেটাই শ্রেষ্ঠ পথ। পক্ষান্তরে উদার হিন্দু বলে যে, বিশ্বে ঈশ্বর একজনই আছেন। যে যার মত অনুসরণ করে ঈশ্বরের করুণা বা কৃপা লাভ করতে সক্ষম। কাজেই এটা সহজেই অনুমান করা চলে যে, যাঁরা বলেন— সব ধর্মই এক তাঁরা তাঁদের সীমাহীন অজ্ঞতা থেকেই এই সব কথা বলে থাকেন। এই সব অজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রায়শই মুসলমানদের নিষ্ঠাবান মুসলমান হতে পরামর্শ দেন, কিন্তু তাঁদের জানা নেই যে, সেই ব্যক্তি নিষ্ঠাবান মুসলমান হলে তাঁর ধড় থেকে মাথা নেমে যাবে। কারণ নিষ্ঠাবান মুসলমানের সর্বপ্রথম কর্তব্যই হল বিধর্মীকে হত্যা করে স্বর্গের পথ পরিষ্কার করা।