মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/১০

ধর্ম শব্দের তাৎপর্য:

 গীতা বলছে, “প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝিয়া, ‘ইহাই যাহা কিছু সমস্ত’ এইরূপ কোন একটি খণ্ডিত বিষয়ে আসক্ত থাকাকে, সেই যুক্তি-বিরুদ্ধ, অ-যথার্থ ও তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে।” (১৮/২২)। কাজেই গীতা অনুসারে ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের মার্কসবাদীদের জ্ঞান অ-যথার্থ ও তামসিক। ধর্ম শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য না বুঝে তাঁরা একে বিলাতী রিলিজিয়ন শব্দে সমার্থক ধরে নিয়েছেন এবং তাদের এই জ্ঞানকেই সম্পূর্ণ ভাবছেন॥ ছাড়া আর কিছু জানার বা বোঝার নেই। কাজেই হিন্দুধর্মও পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টধর্ম বা আরবের ইসলামের মতই একটা রিলিজিয়ন মাত্র। তাই গীতানুসারে তাদের এই জ্ঞানও অ-যথার্থ ও তামসিক জ্ঞান। সব থেকে বড় কথা হল, তাদের এই ভুল ভাবনার জন্য সত্য পরিবর্তিত হবে না, ধর্ম আর রিলিজিয়ন সমান হয়ে যাবে না। এবং হিন্দুধর্ম বা সনাতন ধর্ম খ্রীষ্ট মত বা ইসলামের সঙ্গে সমান হয়ে যাবে না। পক্ষান্তরে এই ভুল ধারণা বশত মার্কসবাদীরা যে ভুল পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে তাদের শ্মশানযাত্রার পথই প্রশস্ত হচ্ছে এবং হবে।

 ভারতীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী প্রতিটি মানুষ শরীর, মন, বুদ্ধি ও আত্মার সমষ্টি, কিন্তু এগুলি একাত্মীভূত এবং একটিকে পৃথক করে চিন্তা করা যায় না। কাজেই মানুষের জীবন প্রণালী ও সমাজ ব্যবস্থাও এমন হওয়া উচিত যাতে এই চারটিরই পুরিপুষ্টি ঘটে, সন্তুষ্টি ঘটে এবং উন্নতি সাধিত হয়। এগুলি বিকশিত হলেই মানুষ পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারটি পুরুষার্থের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবন নির্ধারিত করে দিয়েছে যাতে শরীর, মন, বুদ্ধি ও আত্মার পরিপুষ্টি ঘটতে পারে। পুরুষার্থ হল মানবীয় প্রয়াস বা প্রচেষ্টা। এখানে লক্ষণীয় হল এই যে, মার্কসবাদ মানুষের শরীর, মন ও বুদ্ধির পরিপুষ্টির ব্যবস্থা করেছে এবং আত্মা অবহেলিত হয়েছে। মার্কসবাদ অনুসারে মানুষ হল একটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র এবং ভাবা হয়েছিল যে, আহার, নিদ্রা, বাসস্থান আর মৈথুনের ব্যবস্থা করতে পারলেই মানুষ সুখে থাকবে। এই কারণেই মার্কসবাদকে বলা যায় একটি শিশ্নোদর তত্ত্ব এবং এতে থাকাতে ১০০ বছর যেতে না যেতেই তা পৃথিবীর মাটি থেকে উৎখাত হতে চলেছে। মানুষ পশু নয়, তাই মার্কসবাদকে মানুষ পরিত্যাগ করেছে।

 যাই হোক, এবার ধর্মের কথায় আসা যেতে পারে। উপরিউক্ত চার পুরুষার্থের মধ্যে একমাত্র অর্থের স্থান মানুষের বাইরে। জগতে যা কিছু ভোগের সামগ্রী আছে তা সবই অর্থের মধ্যে পড়ে। টাকা-পয়সা বা ধনের বিনিময়ে এই সমস্ত ভোগের সামগ্রীর উপর অধিকার অর্জন করা যায় বলে সাধারণভাবে অর্থ বলতে টাকা-পয়সা বা ধন বোঝায়। পরবর্তী পুরুষার্থ ‘কাম’-এর স্থান হল মানুষের মনে। কাম বলতে বোঝায় মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছা বা কামনার পরিপূর্তি। ইন্দ্রিয়গণ হল কাম পুরুষার্থ চরিতার্থ করার সহায়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক, এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; পায়ু, উপস্থ, হস্ত, পদ ও বাক্য, এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় এবং মন হল একাদশ ইন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয়গণ হল “ধেনুবৎ বৎসায়” অর্থাৎ গাভী যেমন তার বাছুরের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, ইন্দ্রিয়গণও সেই রকম কামের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। ইন্দ্রিয়গণের দ্বারাই মানুষের মনে কামের উদয় হয়, আবার ইন্দ্রিয়গণের দ্বারাই সে কামের পরিতৃপ্তি হয়। যেমন ভাল খাবারের গন্ধ নাকে গেলে খাবার লোভ জন্মায় এবং খেলে জিহ্বা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সে কাম তৃপ্ত হয়।

 সব মানুষের পক্ষে কাম জয় করে নিষ্কাম হওয়া সম্ভব নয়। আবার সর্বক্ষণ কামের প্রতি ধাবমান হওয়াও সঙ্গত নয়। তাই নিয়ন্ত্রিত কামই সাধারণ মানুষের পথ এবং এখানেই ধর্মের -এর আবির্ভাব। ধর্ম পুরুষার্থের দ্বারা কামকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধর্মের উৎপত্তি হয় মানুষের বুদ্ধি থেকে—বিশেষভাবে ভাল-মন্দ বা সৎ-অসতের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে মানুষ সমর্থ হয় বুদ্ধি থেকে। কামের প্রতি উদ্ভ্রান্তের মত ধাবিত হওয়া থেকে বুদ্ধি বা ধর্ম মানুষকে রক্ষা করে। রশ্মি (বল্গার দড়ি) যেমন অশ্বকে এবং অঙ্কুশ যেমন হাতীকে নিয়ন্ত্রিত করে, ধর্ম তেমনি মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করে। কাজেই ধর্মহীন মানুষ বল্গাহীন রথের মতই উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হয়ে কামের প্রতি উদ্দাম গতিতে ছুটে শেষ পর্যন্ত কোনো খানা-ডোবায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে বাধ্য। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক এবং তা শুধু মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বা গীর্জায় গিয়ে উপাসনা করার মত কতকগুলি বাহ্যিক ক্রিয়া সম্পাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

 অন্য দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি কোনো নিয়ন্ত্রণ না মেনে উদ্দাম গতিতে কামের পিছনে ছুটতে থাকে তাহলে মনুষ্য সমাজ আর সুসভ্য সমাজ থাকবে না, অরণ্যের সমাজে পরিণত হবে। কাজেই ধর্ম বলতে উদ্দাম কাম নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সমুদায় সামাজিক বিধি-নিয়মকে বোঝায়। অর্থাৎ ধর্ম হল সমাজ থেকে উদ্ভূত একটি স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনের সমষ্টি যা একটা সভ্য সমাজ রক্ষার জন্য প্রয়োজন। এই কারণে অনেকে সংস্কৃত ধর্ম শব্দের প্রতিশব্দ করেছেন “innate law” অথবা “moral value” এবং আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ধর্মের প্রতিশব্দ করেছেন “Virtue”। এই কারণেই সংস্কৃত ধৃ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল—যাহা ধারণ করে। বিশেষ অর্থে— যা সমাজকে ধারণ করে। তাই মহাভারতের শান্তি পর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, পুরাকালে রাজাও ছিল না, রাজ্যও ছিল না; দণ্ড ছিল না, দণ্ডাই ব্যক্তিও ছিল না। তখন প্রজারা ধর্মানুসারে পরস্পরকে রক্ষা করত।

 পাশ্চাত্য মতে মানুষ এবং তার ব্যক্তি স্বাধীনতা সকলের উপরে। এই কারণে আজ ইয়োরোপের অনেক দেশে ড্রাগ খাওয়া আইনত অপরাধ নয়, এবং প্রায় সব শহরগুলিতে ড্রাগের কাফে গজিয়ে উঠেছে যেখানে যে কেউ পয়সা দিয়ে ড্রাগ খেতে পারে। এই কারণেই পাশ্চাত্যে আজ সমকামীদের (বিশেষ করে দুই সমকামী পুরুষের মধ্যে) বিবাহ আইনত সিদ্ধ। এই কারণেই আমেরিকায় যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো দোকান থেকে যে কোনো রকমের আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পারে, কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ভারতীয় মতে সমাজের স্বার্থ সকলের উপরে এবং তারপরে ব্যক্তিস্বার্থ বা ব্যক্তিস্বাধীনতা। যে ব্যক্তিস্বাধীনতা সমষ্টির ক্ষতি সাধন করে সে ব্যক্তিস্বাধীনতা ভারতে স্বীকৃত নয়। তাই সমাজের পক্ষে শুভ ও মঙ্গলজনক বলে যে সমস্ত নিয়ম-নীতি ধর্মের স্বীকৃতি লাভ করেছে, হিন্দু সংস্কৃতিতে তার স্থান সকলের উপরে। রাজা তো বটেই, এমন কি ঈশ্বরও ধর্মের অধীন। ধর্মকে অতিক্রম করার সাধ্য কারও নেই। হিন্দু মতে যে কোনো প্রাণীপীড়ন অধর্ম। পরের অনিষ্ট চিন্তা অধর্ম। শঠতা ও বঞ্চনাহীন বৃত্তি গ্রহণ করাই ধর্ম। শুধু প্রাণ রক্ষার জন্য ধন উপার্জন করাই ধর্ম, বেশি ধনের চেষ্টা করা অধর্ম। আহার, নিদ্রা ও মৈথুন মানুষ ও পশু উভয়ের মধ্যেই বিদ্যমান কিন্তু ধর্মই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে। তাই ধর্মহীন মানুষ পশুমাত্র, ধর্মহীন সমাজ পশুর সমাজ, অরাজক মাৎস্যন্যায়ের সমাজ।

 উপরিউক্ত ধর্ম সম্বন্ধে মনুসংহিতা বলছে,

ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্॥

 — অর্থাৎ ধৃতি (সন্তোষ), ক্ষমা, দম (বিষয় সংসর্গে মনের অবিকার), অস্তেয় (চুরি না করা), শৌচ (দেহশুদ্ধি), ইন্দ্রিয়সংযম, ধী (সংশয় বিলোপকারী সম্যক বুদ্ধি), বিদ্যা (আকিঞ্চন), সত্য ও অক্রোধ, এই দশটি ধর্মের লক্ষণ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধর্মপথে চলেন তাঁর মধ্যে এ-সকল গুণ বিকশিত হয়। ধর্মের এই ব্যাখ্যার মধ্যে মানবিকতার চূড়ান্ত উৎকর্ষের কথাই বলা হয়েছে। এ ধর্ম সমগ্র মানবজাতির জন্য, বিশেষ কোনো মানবগোষ্ঠীর জন্য নয়। স্বামীজি বলেছেন, “যাহাই মানুষকে উন্নত করে তাহার নাম ধর্ম। পশুত্বকে দূর করিতে হইবে, মানবত্বকে দেবত্বে লইয়া যাইতে হইবে।” এই পৃথিবীতে একমাত্র হিন্দুই বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দেবত্ব লুকিয়ে আছে এবং সাধনার দ্বারা মানুষ নিজেকে সেই দেবত্বে উন্নীত করতে সক্ষম। ধর্ম হল সেই সাধনার পথ। ধর্মই মানুষকে, মানবত্বকে অতিক্রম করে দেবত্বে পৌঁছে দেয়।