মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/৯

হিন্দুত্ব ভারতের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি:

 আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে এই বিতর্ক চরমে ওঠে যে, মহারাষ্ট্রের কোনো একটি রাজনৈতিক দল হিন্দুত্বের কথা বলে বা বিশেষ একটি ধর্মের আবেদন সামনে রেখে জনসাধারণের ভোট প্রার্থনা করে খুবই সাম্প্রদায়িক কাজ করেছে এবং সেই কারণে ভোট বাতিল করা উচিত। বিবাদ শেষ পর্যন্ত সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত যায়। বিগত ১৯৯৫ সালের ১১ ডিসেম্বর সুপ্রীম কোর্টের তিনজন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সেই মামলার ঐতিহাসিক রায়ে এই মত ব্যক্ত করে যে, হিন্দু শব্দের দ্বারা ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের মত বিশেষ কোনো ধর্মমতকে বোঝায় না। হিন্দু শব্দের অর্থ আরও ব্যাপক এবং প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্বের দ্বারা একটি বিশেষ সভ্যতা বা সংস্কৃতিকে বোঝায়, যা বিগত হাজার হাজার বছর ধরে এই ভারতবর্ষে চলে আসছে। কাজেই হিন্দুত্বের কথা বলে ভোট চাওয়া কোনো মতেই সাম্প্রদায়িক কাজ নয়। এখানে আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হল এই যে, উপরিউক্ত কারণের জন্যই প্রাচীন ভারতীয় যে কোনো বিদ্যাচর্চার শাখাকে পণ্ডিতরা হিন্দু নামে অভিহিত করেন — যেমন, হিন্দু গণিত, হিন্দু জ্যোতিষ, হিন্দু অর্থনীতি ইত্যাদি। বেশি দূরে যাবার প্রয়োজন নেই। এই রীতি অনুসরণ করেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর রচিত প্রাচীন ভারতীয় রসায়নের নাম “হিন্দু রসায়নের ইতিহাস” রেখেছেন।

 কিন্তু শ্রীমোহন দাস গান্ধী ও শ্রীজহরলাল নেহেরু এই ভারতে বিচিত্র এক সেকুলার তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যার মতে হিন্দু নামাঙ্কিত যে কোনো গ্রন্থ, পুস্তক, বক্তৃতা, কথাবার্তা সবই সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দিত হচ্ছে। উল্লিখিত সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে গালে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় খাওয়া সত্ত্বেও সেকুলারবাদীবা তাদের সেই বিচিত্র সেকুলারবাদ আজও অনুকরণ করে চলেছে। আমাদের মার্কসবাদীরা এই সেকুলার তত্ত্বের এক প্রবল সমর্থক এবং দারুণভাবে সেকুলারবাদী। তবে এই সেকুলারবাদের হীন উদ্দেশ্য যে মুসলমান তোষণ তা আর দেশের মানুষের জানতে বাকি নেই। এই সেকুলারবাদী মুসলীম তোষণের নীতি গ্রহণ করেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মার্কসবাদী সরকার বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশে সাহায্য করছে।

 এই প্রসঙ্গে সেকুলারবাদী ঐতিহাসিকরা ভারতের ইতিহাসে কি পরিমাণ বিকৃতি সাধন করে সমূহ ক্ষতি করে চলেছেন তার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া চলে। এঁরা প্রচার করছেন যে ভারতে মুসলমান শাসনের যুগ পরাধীনতার যুগ তো নয়ই, বরং সুবর্ণ যুগ। অত্যাচারী, লম্পট ও নিষ্ঠুর আকবরকে তাঁরা মহান সম্রাট অশোকের সমান আসনে বসিয়েছেন। তাঁদের মতে আকবর রাজস্থান জয় করে সমস্ত ভারতকে এক ঐক্য বন্ধনে বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হীনমতি রাণা প্রতাপ আকবরের সেই মহান প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছেন। তেমনি মহান সম্রাট ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য জয় করে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ক্ষুদ্রবুদ্ধি রাজা শিবাজী সেই মহান প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছেন। এঁদের মতে বিদেশী অত্যাচারী, লম্পট মুসলমান শাসকরা সকলেই ছিল মহান ও উদার এবং বদমাস হিন্দুগুলোই নানারকম সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের মতে এই সব মুসলমান দস্যুরা তাদের ৭০০ বছরের শাসনকালে এত ব্যাপক হিন্দুহত্যা করেছে যে, হিন্দুর সংখ্যা ৬০ কোটি থেকে কমে ২০ কোটি হয়েছে। (বিশদ বিবরণের জন্য বর্তমান লেখকের “মিথ্যার আবরণে দিল্লি আগ্রা ফতেপুর সিক্রি” দ্রষ্টব্য।)

  দেশদ্রোহী মার্কসবাদীরা ইতিহাসকে কতখানি বিকৃত করতে পারে তা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মার্কসবাদী সরকার দ্বারা প্রকাশিত যে কোনো স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের বই পড়লেই পাঠক পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। এই সব পুস্তকে নেতাজীর বিষয়ে দু'লাইনে লেখা হয়, কিন্তু তিতুমীরের বিষয়ে দু’পৃষ্ঠা লেখা হয় এবং ভিয়েতনাম ও চিনের মার্কসবাদী বিপ্লবের বিষয়ে পৃথক অধ্যায় রচিত হয়। এ ব্যাপারে এটাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, সেকুলার ঐতিহাসিকদের যে গোষ্ঠী ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে মার্কসবাদী দেশদ্রোহীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই এটা নিয়ন্ত্রণ করছেন (এ বিষয়ে বিশদ বিবরণের জন্য পাঠক অরুণ শৌরি মহাশয়ের “Eminent Historians” এবং শ্রীপুরুষোত্তম নাগেশ ওক মহাশয়ের “Islamic Havoc in Indian History” দেখতে পারেন।)

 প্রকৃতপক্ষে যে হিন্দুত্ব বর্তমানে সেকুলারবাদী ঐতিহাসিকদের কাছে সর্বাপেক্ষা ঘৃণার বস্তু, সেই হিন্দুত্বই ভারতের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। কবি বলেছেন, “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।” কবি এখানে আরও একটা বিষয় বাদ দিয়েছেন, তা হল খাদ্যাভ্যাস। রাজস্থানের জোয়ারের রুটি বাঙালির পেটে সহ্য হবে না। তেমনি দক্ষিণ ভারতের ইলি, দোসা, সম্বর, রসম উত্তর ভারতের মুখে রুচিকর মনে হবে না। কিন্তু এই সব বিবিধের মাঝে মিলনের সূত্রটা কি? কি সেই অদৃশ্য বন্ধন যা এত বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতের জনসাধারণকে এক নিবিড় ঐক্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছে? তা হল গঙ্গা, গায়ত্রী, গীতা ও গোবিন্দ, এই চার গ’র ঐতিহ্য।

 আমাদের মনীষীদের মতে হিন্দু সংস্কৃতি বা হিন্দুধর্ম বা হিন্দুত্বই হল সেই ঐক্যের মূল ভিত্তিভূমি। হিন্দুত্বই হল ভারতের জাতীয়তাবাদ। তাই শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, “I say that is the Sanatana Dharma which is for us our nationalism. This Hindu nation was born with the Sanatana Dharma, with it moves and with it it grows.” অর্থাৎ, “সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মই হল আমাদের জাতীয়তাবাদ। এই হিন্দু জাতি সনাতন ধর্ম সাথে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, এবং সনাতন ধর্মকে সাথে নিয়েই সে অগ্রসর হচ্ছে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে” (উত্তরপাড়া অভিভাষণ)।

 কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর “আত্মপরিচয়” প্রবন্ধে লিখছেন, “বর্তমানকালে আমরা কেহ কেহ এই লইয়া চিন্তা করিতে আরম্ভ করিয়াছি, আমরা যে কী, সে লইয়া আমাদের মনে একটা সন্দেহ জন্মিয়াছে। আমরা আর কিছুই নই, আমরা ব্রাহ্ম। কিন্তু সে তো একটা নূতন পরিচয় হইল। সে পরিচয়ের শিকড় তো বেশিদূর যায় না?....ইহার চেয়ে পাকা পরিচয়ের ভিত্তি কি আমার কিছুই নাই? অতীতকাল হইতে প্রবাহিত একটা নিত্য লক্ষণ কি আমার মধ্যে একেবারেই বর্তায় নাই?...অতএব আমি হিন্দু, এ কথা বলিতে যদি নিতান্তই কোন লজ্জার কারণ থাকে, তবে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতে হইবে।” কবি আরও লিখছেন, “তবে কি মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তুমি হিন্দু থাকিতে পার? নিশ্চয়ই পারি। ইহার মধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই। ...ইহা সত্য যে কালীচরণ বাঁড়ুজ্জে মহাশয় হিন্দু-খ্রিস্টান ছিলেন, তাহার পূর্বে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় হিন্দু-খ্রিস্টান ছিলেন, তাঁহার পূর্বে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু-খ্রীষ্টান ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহারা জাতিতে হিন্দু ধর্মে খ্রিস্টান ছিলেন। খ্রিস্টান তাহাদের রঙ, হিন্দুই তাহাদের বস্তু। বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে, হিন্দুরা তাহাদের অহর্নিশি “হিন্দু নও, হিন্দু নও” বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজদিগকে “হিন্দু নই, হিন্দু নই” শুনাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু তৎ সত্ত্বেও তাহারা প্রকৃতই হিন্দু-মুসলমান।....মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম, কিন্তু হিন্দু কোন বিশেষ ধর্ম নহে, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক জাতিগত পরিণাম।”

 গীতা বলছে, “যদ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ” (৩/২১), অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে।” কাজেই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, ভারতের আপামর জনসাধারণ কোন্ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে অনুসরণ করবে? ভারতবর্ষের মানুষ কি এই ভারতেরই সন্তান, সত্যদ্রষ্টা ঋষি অরবিন্দ বা শ্রীরবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করবে, না কি জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী এবং ভারত সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞ মার্কসকে অনুসরণ করবে? ভারতবর্ষের মানুষ কি মার্কসের কথামত হিন্দুত্বকে আফিমের মত বর্জন করবে, না রবীন্দ্রনাথ ও অরবিন্দের কথামত হিন্দুত্বকে জাতির মূল জীবনীশক্তি হিসাবে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকবে? বিবেকানন্দও এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলে গেছেন, “তোমরা যদি ধর্ম ছাড়িয়া পাশ্চাত্য জাতির জড়বাদ-সর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হও, তোমরা তিন পুরুষ যাইতে না যাইতেই বিনষ্ট হইবে। ধর্ম ছাড়িয়া দিলে হিন্দুর জাতীয় মেরুদণ্ডই ভাঙ্গিয়া যাইবে। ফল দাঁড়াইবে সম্পূর্ণ ধ্বংস।” (বিবেঃ রচঃ, উদ্বোধন, জন্মশতবর্ষ সং, ৫ম খণ্ড, পৃঃ-৬৮।)

 কিন্তু দেশের প্রতি শ্রদ্ধাহীন, জাতির প্রতি শ্রদ্ধাহীন, সর্বোপরি নিজের দেশের মহাপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন দেশদ্রোহী মার্কসবাদীরা সত্যদ্রষ্টা দেশের মহামানবদের কথা বা উপদেশকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ভারতবর্ষ সম্পর্কে অজ্ঞ, বিদেশী ও জড়বাদী মার্কসের বাণীকেই অভ্রান্ত বলে মেনে নিল এবং হিন্দুত্বকে আফিমের মতই বর্জন করল। হিন্দুত্বকে অস্বীকার করে তারা জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করল। বিবেকানন্দের ভাষায়, জাতির মেরুদণ্ডকেই অস্বীকার করল। ফল দাঁড়াল ভারত সম্পর্কে মার্কসবাদীদের সীমাহীন অজ্ঞতা। এই কারণেই স্বাধীনতার প্রাক্কালে তারা বলতে পেরেছিল যে, ভারতে ষোলটি জাতি বাস করে এবং তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে মেনে নিয়ে ভারতবর্ষকে ষোল টুকরো করা উচিত। এই ঘটনা এটাও প্রমাণ করে যে, অন্ধের মত কোনো বিদেশী তত্ত্বকে ভারতে প্রয়োগ করার ফল কত মারাত্মক ও বিপজ্জনক হতে পারে। পাকিস্তান সৃষ্টিতে মার্কসবাদীদের সমর্থন এই বিপজ্জনক পরিণতিরই সাক্ষ্য বহন করছে।

 শ্রীঅরবিন্দের অসীম প্রজ্ঞা ও গভীর অনুভূতি যে সত্য উচ্চারণ করেছিল, সেই সত্য ক্রমশই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। হিন্দুত্বই যে ভারতীয়ত্ব বা ভারতের জাতীয়তাবাদ তা নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে আজ চরম সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। ভারতের যে অংশে হিন্দুর সংখ্যা কমে যাচ্ছে সেখানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাচ্ছে। হিন্দুর সংখ্যা কমে যাবার ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ভারত থেকে পৃথক হয়ে পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, মেঘালয় ইত্যাদি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে হিন্দুর সংখ্যা কমে গিয়ে খ্রীষ্টানদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখানেও বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি উঠছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ বেড়ে চলেছে। তাই এটাও দিনের আলোর মত পরিষ্কার হচ্ছে যে, হিন্দুত্বের প্রসার ভিন্ন আর কোনো মতেই ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব নয়।