মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/৮

মার্কসীয় তত্ত্ব ভারতে প্রযোজ্য নয়:

 এখানে আরও একটা বিষয় বলা দরকার। ইয়োরোপের মত ক্রীতদাস প্রথার সমাজ যেমন ভারতে ছিল না, তেমনি ইয়োরোপের মত জঘন্য সামন্ততন্ত্র ও ভারতে ছিল না। সেই সময় ইয়োরোপীয় সমাজ সামন্ত প্রভু (লর্ড, ম্যানর ইত্যাদি) ও ভূমিদাস বা সার্ক (Serf), এই দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, ভারতে যা কোনো দিনই হয়নি। ব্রিটিশ এদেশে আসার পর লর্ড কর্নোয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে এ দেশে ইয়োরোপীয় সামন্তপ্রথার পত্তন করে। এই সামন্তপ্রথার মূল লক্ষণ হল, চাষি যেহেতু জমির মালিক নয় তাই জমি হস্তান্তর বা বেচাবিক্রি করার তার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় চাষিই জমির মালিক ছিল এবং সে জমি কেনা-বেচা করতে পারত। সেই সঙ্গে সঙ্গে ইয়োরোপের মত ধনতন্ত্র বা ক্যাপিটালিজ্য যে ভারতে হয়নি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এই দিক থেকে বিচার করলে, মার্কস সাহেবের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ভারতবর্ষে পুরোপুরি অচল। উল্লিখিত ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে যে, আদিম সমাজতন্ত্র থেকে শুরু করে মানব সমাজ একে একে ক্রীতাদাস প্রথার সমাজ, সামন্ততন্ত্রের সমাজ ও বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে উন্নীত হবে। কিন্তু ভারতে যেহেতু ক্রীতাদাস প্রথার সমাজ ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ছিল না, তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মার্কসের উপরিউক্ত তত্ত্ব ইয়োরোপের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ভারতের ক্ষেত্রে নয়। তাই ধনতান্ত্রিক সমাজকে বিপ্লবের দ্বারা অপসারিত করে মার্কসবাদীরা এখানে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবেন সে আশা দুরাশা মাত্র।

 ক্ষমার অযোগ্য যে অপরাধ মার্কসবাদীরা করে চলেছেন তা হল, ভারতবর্ষকে তাঁরা জানতে চেষ্টা করেছেন বিদেশী বর্বর ইয়োরোপে উদ্ভূত মার্কসবাদী তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে ভারতকে জানার জন্য ভারতের নিজস্ব যে সমস্ত গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করা প্রয়োজন তাকে তাঁরা ভাববাদী গ্রন্থ নাম দিয়ে আফিমের মতই বর্জন করেছেন। তাই তাদের জানা কখনও সঠিক হয় না। এককালে তাঁরা জানতেন নেতাজী জাপানের চর, তোজোর কুকুর, আজ সে জানা পালটে গিয়েছে। কাজেই এই সব স্বল্পশিক্ষিত ও অদূরদর্শী মার্কসবাদীর দল ভারতকেই বা জানবে কেমন করে আর তার সমস্যাকেই বা বুঝবে কেমন করে? সমস্যার সমাধান করা তো অনেক দূরের কথা। যে শ্রেণিসংগ্রামের মার্কসবাদী তত্ত্ব বর্বর, বস্তুনিষ্ঠ ও ভোগবাদী ইয়োরোপীয় সমাজের ফসল, তাকে তাঁরা মহানন্দে ভারতে আমদানী করেছেন, বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন বলে তাকে ভারতের মাটিতে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন এবং প্রতিপদে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ সুসভ্য ভারতীয় সমাজ ঐ বিদেশী তত্ত্ব অনুযায়ী অতীতেও চলেনি, আর ভবিষ্যতেও চলবে না।

 মূল সমস্যা হল, মুসলমানদের যেমন যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, যে দেশে বসবাস করছে, সেই মাতৃভূমির প্রতি কোন আনুগত্য ও শ্রদ্ধা থাকে না, তাদের সমস্ত শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রবাহিত হয় শুষ্ক মরুময় আরবের প্রতি, মক্কা-মদিনার প্রতি, তেমনি আমাদের দেশদ্রোহী মার্কসবাদীদেরও ভারতের প্রতি, তাদের মাতৃভূমির প্রতি কোনো আনুগত্য ও শ্রদ্ধা নেই। এককালে তাদের সমস্ত আনুগত্য ছিল রাশিয়া তথা মস্কোর প্রতি এবং আজ চিন তথা বেজিং সে স্থান দখল করেছে। তাই চিন পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে আমাদের মার্কসবাদীরা পুলকিত হন। কিন্তু নিজের দেশ ভারত তা করলে এই মীর্জাফরের দল তাকে নিন্দা করে। চিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করলে এই সব ঘৃণ্য ব্যক্তিরা আনন্দিত হন, কিন্তু সেই পরীক্ষা ভারত করলে তাকে টাকা পয়সার অপব্যয় বলেন এবং এর দ্বারা গরিব মানুষের ডাল-রুটির যোগাড়ে কোনো সুবিধে হবে না বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন।

 তাই এ কথা জোর দিয়ে অস্বীকার করা যায় না, ভবিষ্যতে যদি চিন ভারত আক্রমণ করে তবে এই মার্কসবাদীর দল ভারতের বিরুদ্ধে চিনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করবে না। এ প্রসঙ্গে পাঠকের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে যে, ১৯৬২ সালে চিন ভারত আক্রমণ করলে দেশদ্রোহী মার্কসবাদীরা ভারতকেই আক্রমণকারী বলে দোষারোপ করেছিল এবং ’৭০-এর দশকে নক্‌শাল আমলে ঐ নক্শালবাদীরা আওয়াজ তুলেছিল—চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। এককালের ভারত আক্রমণকারী দস্যু মহম্মদ ঘোরীর নামে আজ পাকিস্তান তার সব থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ‘ঘাউরি” রেখেছে এবং তাতেই ক্ষান্ত থেকেছে। কিন্তু নক্শালদের যে মনোভাব উল্লিখিত, স্লোগানের মধ্য গিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাতে অনুমান করা চলে যে তারা কোনো এক চিনা ব্যক্তিকে ভারতে এনে ভারতের সর্বোচ্চ পদে বসাতেও কুণ্ঠিত হবে না।