মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/৭

ভারতে ক্রীতদাস প্রথা ছিল না:

 পক্ষান্তরে “মনুসংহিতা” থেকে তৎকালীন ভারতীয় সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায়, এবং বিশেষ করে ঐ গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে শুদ্র সম্পর্কে যে সমস্ত শ্লোক রয়েছে তাতে দেখা যায় যে, “শূদ্র মাত্রই দাস্যকর্মের উপযুক্ত” এই কথাই বলা হয়েছে। শূদ্র মাত্রই দাস এ কথা বলা হয়নি। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল, সংস্কৃত “দাস” শব্দের দ্বারা কেবল ক্রীতদাস বোঝায় না, সাধারণ গৃহভৃত্যকেও বোঝায়। বৃহদর্থে যে কোনো বেতনভোগী কর্মচারীও দাস। “দাসী বা দাসপত্নীতে শূদ্রের যে পুত্র হয়, ঐ পুত্র শুদ্র পিতার অনুজ্ঞামতে উহার ঔরস-পুত্রের তুল্যভাগী হইবে, ইহাই শাস্ত্রীয় বিধান” (৯/১৭৯)। মনুসংহিতার উপরিউক্ত শ্লোক প্রমাণ করেছে যে, শূদ্রেরও দাসদাসী ছিল বা থাকা সম্ভব ছিল। কাজেই শূদ্র মাত্রই দাস ছিল, মার্কসবাদীদের এই সিদ্ধান্ত সত্যের অপলাপ ও ইতিহাসের বিকৃতিকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া উক্ত গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে শূদ্রের অনেক স্বাধীন পেশার উল্লেখ আছে, কিন্তু ক্রীতদাসের কোনো স্বাধীন পেশা থাকা সম্ভব নয়।

 “বৈশ্যের অভাবে শুদ্রগৃহ হইতে (ব্রাহ্মণ) ইচ্ছামত দুই বা তিনটি যজ্ঞীয় দ্রব্য গ্রহণ করিবে” (১১/১৩)। “যজ্ঞের নিমিত্ত শূদ্রের নিকট ধন যাচ্ঞা করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়” (১০/২৪)। “যদি পশুযাগ ও সোমযাগ না হইয়া থাকে তবে তদুদ্দেশ্যে শূদ্র হইতেও ধন গ্রহণ করিয়া ব্রাহ্মণ বৎসরান্তে বৈশ্বানরী ইষ্ম করিবেন” (১১/২৭)।— ইত্যাদি শ্লোকগুলি অকাট্যভাবে স্বাধীন ও বিত্তশালী শূদ্রের অস্তিত্ব স্বীকার করছে। ক্রীতদাসের কাছে কেউ আর্থিক সাহায্য চাইতে পারে না এবং তাদের কোনো স্বাধীন গৃহও থাকা সম্ভব নয়।

 “...অনুপযুক্ত ব্রাহ্মণকে রাজা ধর্মপ্রবক্তাপদে নিযুক্ত করিতে পারেন, পরক্ত সর্বগুণান্বিত ধার্মিক ও ব্যবহারজ্ঞ শূদ্রকে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে পারেন না। যে রাজার সামনে শূদ্র ন্যায়ান্যায় ধর্ম বিচার করে সেই রাজার রাষ্ট্র শীঘ্রই পঙ্কে পতিত গোরুর ন্যায় অবসন্ন হয়” (৮/২০, ২১)। এই শ্লোক থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ধার্মিক, বিদ্বান বা রাজার অমাত্যপদে আসীন হবার মত সর্বগুণান্বিত শূদ্রও বিরল ছিল না। তা ছাড়া মহাভারতে শূদ্র রাজার কন্যা সত্যবতীর সঙ্গে শান্তনুর বিবাহ এবং শূদ্র রাজাদের সসৈন্যে কুরুক্ষেত্রে যোগদান, স্বাধীন শূদ্র রাজার অস্তিত্ব প্রমাণ করে।

 কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে লিখেছেন, “কোন ম্লেচ্ছ যদি তার সন্তানকে দাস হিসাবে বিক্রি করে বা বন্ধক রাখে তবে তা দণ্ডনীয় হবে না। তবে আর্যদের মধ্যে যে কোন রকমের দাসত্বপ্রথা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ” (৩/১৩/৩৪) পণ্ডিতগণের মতে ম্লেচ্ছ শব্দের দ্বারা বিদেশী বোঝায় এবং শূদ্র কিংবা তার থেকেও পতিত (অশাস্ত্রীয় বিবাহের দ্বারা) কোনো ব্যক্তিও আর্য বলে গণ্য। যে কোন মার্কসবাদী উক্ত গ্রন্থের উক্ত প্রকরণে বর্ণিত ক্রীতাদাস বিষয়ে আলোচনা পড়লে বুঝতে পারবেন যে ভারতীয় সমাজ কত সভ্য ও মানবিক ছিল। ইয়োরোপ যেখানে ক্রীতদাসকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলার কথা বলছে, কৌটিল্য সেখানে বলছেন যে, নাবালক ম্লেচ্ছ ক্রীতদাসকেও যদি তাঁর মালিক কোনো নোংরা কাজে নিযুক্ত করে তবে সেই মালিকের অর্থদণ্ড হবে। রোমের লেখকরা ক্রীতদাসীদের গণিকাবৃত্তি করতে বলছেন, পক্ষান্তরে কৌটিল্য বলছেন, ক্রীতদাসীর সঙ্গে কোনো রকম অশালীন কথা বললে বা ইঙ্গিত করলে তার দণ্ড হবে (৩/১৩/১১,১২)।

 মনুসংহিতায়, সাত রকম দাসের বর্ণনা আছে, যেমন (১) যুদ্ধবন্দী দাস, (২) অন্নের জন্য দাস, (৩) গৃহস্থ দাসীর পুত্র দাস, (৪) দদ্রিম বা অন্য কেউ দিয়েছে এমন দাস, (৫) পৈতৃক বা পিত্রাদিক্রমাগত দাস, (৬) দণ্ডদাস বা রাজার শাস্তিস্বরূপ দাস্যবৃত্তি করছে এমন, এবং (৭) ক্রীত বা পয়সা দিয়ে কেনা দাস; (৮/৪১৫)। এর মধ্যে একমাত্র ‘ক্রীত’ শ্রেণির দাসই ইয়োরোপের ক্রীতদাসের পর্যায়ে পড়ে। কাজেই ইয়োরোপের মত ক্রীতদাসের হাটে হাজার হাজার দাস কেনা-বেচার ঘটনাও ভারতে অনুপস্থিত। ইত্যাদি আরও নানা তথ্য-প্রমাণ হাজির করে দেখানো যেতে পারে যে ইয়োরোপের মত জঘন্য ক্রীতদাস প্রথা ভারতে কোনো কালেই ছিল না। এই কারণে মেগাস্থিনিস তাঁর বিবরণে লেখেন যে, ভারতে ক্রীতদাস প্রথা নেই।

 আরও একটা কথা এখানে বলে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে যে, শুধু ভারতের নয়, পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার পণ্ডিতরাও ভারতে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে বিশেষ চেষ্টা চালায়। কিন্তু মেগাস্থিনিসের মন্তব্য তাদের সকল অপচেষ্টায় জল ঢেলে দেয়। মেগাস্থিনিসের মন্তব্য উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না, কারণ সে একজন ইয়োরোপীয়। দ্বিতীয়তঃ, মেগাস্থিনিস ইয়োরোপীয় ক্রীতদাস প্রথার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এই সব ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, শ্রীভাঙ্গে সহ আমাদের মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের ভারতচর্চা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে সত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা নয়, বরং গায়ের জোরে ইতিহাসকে বিকৃত করে তাকে মার্কসবাদী তত্ত্বের উপযোগী করে তোলার অপচেষ্টা মাত্র। এ থেকে আরও একটা জিনিস প্রমাণ হয় তা হল, নিজের দেশের ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, তাদের যত শ্রদ্ধা সব শুধু বিদেশী মার্কস ও তাঁর তত্ত্বের প্রতি। পাঠক যদি শ্রীডাঙ্গের উল্লিখিত পুস্তকটি সংগ্রহ করে একবার পড়েন তবে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি কালিমা লেপন করার মার্কসবাদী কায়দার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হতে পারবেন। রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, উপনিষদ ইত্যাদি আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদিরও যে কি রকম কুৎসিত অপব্যাখ্যা মার্কসবাদীরা করতে পারে সে সম্বন্ধেও কিছুটা ধারণা করতে পারবেন। তবে সুখের কথা হল, হিমালয়কে গাঁইতি দিয়ে আঘাত করলে যেমন হিমালয়ের কিছু যায় আসে না, বরং যে গাঁইতি মারে তারই পরিশ্রম সার হয়, সেই রকম গীতা, উপনিষদ ইত্যাদিকে আঘাত করে মার্কসবাদীরা শুধু তাদের গা-হাত-পা ব্যথা করছেন। হিমালয় যেমন ছিল তেমনই আছে। পোকা যেমন গ্রন্থের মহত্ত্ব বোঝে না, শুধু কাটে, আমাদের মার্কসবাদী অজ্ঞের দলও সেই রকম গ্রন্থের মহত্ত্ব না বুঝে পোকার মত কেটে চলেছে।