মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা/৬

আমাদের মার্কসবাদীদের চরিত্র:

 কাজেই প্রশ্ন থাকছে যে, ভারতের মার্কসবাদীরা, যাঁরা মার্কসবাদে অবিচল বিশ্বাস রাখেন, তাঁরা কি ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মার্কসের উপরিউক্ত ধ্যানধারণাগুলোকেও বিশ্বাস করেন? তাঁরাও কি বিশ্বাস করেন যে ভারতের হিন্দু জাতি ইয়োরোপীয়দের তুলনায় জংলী ও অসভ্য? তাঁরাও কি বিশ্বাস করেন যে, ভারতের কোনো অতীত ইতিহাস নেই? তাঁরাও কি বিশ্বাস করেন যে, ভারতের সনাতন ধর্ম জংলী ধর্ম ছাড়া আর কিছুই নয় এবং সেই তুলনায় খ্রিস্টধর্ম অনেক সভ্য ও মহৎ? তাঁরাও কি বিশ্বাস করেন যে, ভারতবর্ষকে ইয়োরোপের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে? তাহলে এই কথাই বলতে হয় যে, ঐ সব বিজাতীয় ও দেশদ্রোহী মার্কসবাদীদের ভারতে থাকার কোনো অধিকার নেই— সভ্য হবার জন্য তাদের ইয়োরোপে চলে যাওয়া উচিত।

 আমাদের মার্কসবাদীরা, বিদেশী ঐতিহাসিকদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই বিকৃত মতবাদে বিশ্বাসী যে, তথাকথিত দ্রাবিড় ও আদিবাসী নামে চিহ্নিত বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত লোকেরাই ভারতের মূল বাসিন্দা এবং সেই জনগোষ্ঠী আর্য নামে পরিচিত তারা বহিরাগত। তাঁরা আরও বিশ্বাস করেন যে, সেই তথাকথিত আর্যরা ঐ সব আদিম অধিবাসীদের দাসত্বে বাধ্য করেছে। তাদের সমস্ত কৃষিযোগ্য উর্বর জমি বলপূর্বক কেড়ে নিয়েছে, তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে এবং সমস্ত দিক দিয়ে তাদের শোষণ করেছে। গ্রীক ও রোমান আমলে ইয়োরোপের ক্রীতদাস মালিকরা ক্রীতাদীসদের উপর যে রকম অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতো, আর্যরাও এদের ‘শূদ্র’ নামে অভিহিত করে একই রকম অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছে।

 এ থেকে আমাদের মার্কসবাদীরা দেখাতে চান যে, মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বে যে ক্রীতদাস সমাজের কথা বলেছেন, ভারতেও সেই সমাজের অস্তিত্ব ছিল। এটা প্রমাণ করা তাদের পক্ষে খুবই জরুরী কারণ এটা না দেখাতে পারলে তাঁদের পক্ষে মার্কসের তত্ত্বকে অভ্রান্ত ও সার্বজনীন বলে প্রচার করতে খুবই অসুবিধা হবে।

 অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতা শ্রী এস. এ. ডাঙ্গে মহাশয় তাঁর “Slavery in India” গ্রন্থে এই সব দিকগুলোকেই সাক্ষ্যপ্রমাণ সহকারে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মুনিঋষিদের তপোবনকে তিনি জমিদারি বলেছেন। শিক্ষাগ্রহণের জন্য আগত আশ্রমবালকদের তিনি ক্রীতদাস-কৃষি-শ্রমিক বলেছেন। অবসর বিনোদনের জন্য আসা রাজা-মহারাজাদের সঙ্গদানকারী হিসাবে আশ্রমবালিকাদের বর্ণনা করেছেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই শকুন্তলা ও রাজা দুষ্মন্ত্রের কাহিনী ব্যাখ্যা করেছেন। তাড়কা বধ, একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দান প্রভৃতিকে বলপূর্বক শূদ্র দমন বলেছেন ইত্যাদি।

 কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় সমাজকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যে নৃশংস ও বর্বর ইয়োরোপীয় সমাজের সঙ্গে শ্রীড়াঙ্গে ভারতীয় সমাজকে তুলনীয় বলে বলতে চাইছেন সাক্ষ্য প্রমাণ সে-কথা বলে না। সেই সময়কার ইয়োরোপীয় সমাজ ক্রীতদাস ও স্বাধীন নাগরিক, এই দুই শ্রেণিতে সরাসরি ভাগ হয়ে গিয়েছিল এবং ইয়োরোপের তিন-চতুর্থাংশ অধিবাসী ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ইয়োরোপের বড় বড় হাটে রোজ প্রায় দশ হাজার ক্রীতদাস কেনা-বেচা হত এবং শৃংখলিত ঐ সব হতভাগ্যদের স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার কোনো অধিকার তো ছিলই না বরং পশুর চেয়েও জঘন্য জীবনযাপনে তাঁদের বাধ্য করা হত। ভারতীয় ইতিহাসের কোনো একটা পর্যায়ে এই রকম বীভৎস একটা সামাজিক পরিস্থিতি ছিল কোনো রকম সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়েও তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ভারতীয় সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত ছিল। কাজেই ইয়োরোপের মত ভারতীয় সমাজও ক্রীতাদাস ও স্বাধীন নাগরিক, এই দুই শ্রেণিতে সরাসরি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল তা খুবই কষ্ট-কল্পনা।

 ক্রীতদাসদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে, এ ব্যাপারে রোমান লেখক ক্যাটো (Cato)-র মত হল, তাদের খাবার কাজের উপর নির্ভর করবে। বছরের যে যে সময় কৃষিকাজ সর্বাপেক্ষা শ্রমসাধ্য, তখন তাদের খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং অল্প খাটুনির সময় বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া তিনি বাগান ও ক্ষেতের মালিকরদের পরামর্শ দিচ্ছেন, বৃদ্ধ গোরুবলদ ও পুরানো লোহালক্কড়ের সঙ্গে বয়স্ক ও রুগ্ন ক্রীতাদাসদের বেচে দিতে। সমুদ্রে ঝড় উঠলে জাহাজ হাল্কা করার জন্য ঘোড়াকে আগে জলে ফেলতে হবে, না ক্রীতদাসকে আগে জলে ফেলতে হবে? এ ব্যাপারে সিসেরো (Cicero)-র মত হল, ক্রীতদাসকেই আগে জলে ফেলা উচিত। সিসেরো, পিণ্ডার, হোরেস প্রভৃতি রোমান লেখকদের মতে দুর্ভিক্ষের সময় ক্রীতদাসদের হয় বেচে দিতে হবে, নয়তো না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। তা ছাড়া ওই সব লেখকরা, স্বাধীন রোমক যুবকদের সুবিধার্থে ক্রীতদাসীদের গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করার জন্যও উপদেশ দিতেন। (এই প্রসঙ্গে আরও তথ্যের জন্য বর্তমান লেখকের “পুরুষার্থ প্রসঙ্গ: পাশ্চাত্য বনাম ভারতীয় ভাবধারা” দ্রষ্টব্য।)