মার্কাস্‌ অরিলিয়সের আত্মচিন্তা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 ১। তোমার প্রত্যেক কার্য্যের যেন একটা বিশেষ লক্ষ্য থাকে, এবং যে কার্য্য করিবে, ঐ জাতীয় কার্য্যের পক্ষে যেন উহা সর্ব্বাঙ্গ-সম্পূর্ণ হয়।

 ২। কেহ কেহ বিজনবাসের জন্য, জনশূন্য পল্লীপ্রদেশে, সমুদ্র-তীরে, কিংবা পর্ব্বতে গমন করিয়া থাকে; এবং তুমিও এইরূপ করিবে বলিয়া অনেক সময় আগ্রহ প্রকাশ করিয়া থাক; কিন্তু আসলে ইহা একটা মনের খেয়াল বই আর কিছুই নহে। কেন না, তুমি ইচ্ছা করিলেই তোমার অন্তরের নিভৃত দেশে গিয়া বিশ্রাম করিতে পার। তোমার চিন্তাগুলি যদি এরূপ হয় যে, তাহাতে মনের শান্তি রক্ষিত হইতে পারে, মন সুব্যবস্থিত হইতে পারে, তাহা হইলে জানিবে, তোমার মন অপেক্ষা জনকোলাহলশূন্য বিজন স্থান আর কোথাও নাই। অতএব, নিভৃত মানসাশ্রমে বাস করিয়া ধর্ম্মসাধনা করাই প্রকৃষ্ট পন্থা; এবং এই উদ্দেশ্যে, কতকগুলি ভাল ভাল তত্ত্বকথা তোমার বিজনবাসের সম্বল করিয়া রাখিবে। একটা দৃষ্টান্ত;–কিসে তোমার মন উদ্বেজিত হইয়াছে?—সংসারের শঠতায়? ইহাই যদি তোমার উদ্বেগের কারণ হয়—তোমার বিষহারী ঔষধটা ত তোমার নিকটেই আছে। ইহাই বিবেচনা করিবে, পরস্পরের হিতের জন্যই, জ্ঞানপ্রধান জীবদিগের সৃষ্টি, ক্ষমা ন্যায়েরই একটা অংশ, এবং লোকে যে অন্যায় কার্য্য করে, সে তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আরও বিবেচনা করিয়া দেখ, কত লোক কলহবিবাদে, সন্দেহ ও শক্রতায় তাহাদের জীবন অতিবাহিত করিয়াছে; কিন্তু এখন তাহারা কোথায়?—তাহার কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে, চিতাভস্মে পরিণত হইয়াছে। অতএব শান্ত হও, চিত্তকে আর বিচলিত করিও না। জগতের বর্ত্তমান ব্যবস্থাটা তোমার ভাল না-ও লাগিতে পারে। বিকল্পে অন্য ব্যবস্থা কি হইতে পারে, একবার ভাবিয়া দেখঃ—হয় একজন বিধাতা, নয় কতকগুলা পরমাণু জগৎকে শাসন করিতেছে। জগৎ যে একটা সুব্যবস্থিত নগরের মত শাসিত হইতেছে, তাহার কি অসংখ্য প্রমাণ এখনও পাও নাই? তোমার শরীরের অসুস্থতাবশতঃ তুমি কি কষ্ট পাইতেছ? যদি তোমার অন্তরাত্মা স্বকীয় শক্তি ও অধিকার হৃদয়ঙ্গম করিয়া থাকে, তবে ইন্দ্রিয়-প্রবাহ অবাধে চলিতেছে, কি বাধা প্রাপ্ত হইতেছে, তাহাতে তোমার আইসে-যায় কি? তাহার পর, সুখদুঃখের গূঢ় তত্ত্বটা একবার ভাবিয়া দেখ। তবে কি যশের জন্য তোমার চিত্ত ক্ষুব্ধ হইয়াছে? তাহা যদি হইয়া থাকে, মনে করিয়া দেখ, পৃথিবীর জিনিস কত শীঘ্র অন্তৰ্হিত হয়—লোকে সে সমস্ত কত শীঘ্র ভুলিয়া যায়। মধ্যে অনন্তকাল, তাহার দুই পার্শ্বে বিস্মৃতির অতলস্পর্শ। লোক-প্রশংসা! মনে করিয়া দেখ, উহা ফাঁকা আওয়াজ মাত্র, অল্প কাল স্থায়ী, অল্প পরিসরের মধ্যে বদ্ধ, এবং যাহাদের প্রশংসা চাহিতেছ, তাহারাও কি ক্ষুদ্রবুদ্ধি। সমস্ত পৃথিবী একটি বিন্দুমাত্র; এই বিদুর মধ্যে আবার তোমার বাসস্থানটি কি ক্ষুদ্র, এবং সংখ্যা ও যোগ্যতায় তোমার ভক্ত-বৃন্দও কি অকিঞ্চিৎকর। মোদ্দা কথা,—বিশ্রামের জন্য, আপনার ক্ষুদ্র অন্তররাজ্যে প্রবেশ করিতে ভুলিও না। মানুষের মত, স্বাধীন জীবের মত স্বাধীনভাবে সহজভাবে সমস্ত বিবেচনা করিয়া দেখ; ইহার মধ্যে কোন যুঝাযুঝির ভাব নাই। তোমার অন্য পুঁজির মধ্যে এই দুইটি বীজমন্ত্রও যেন তোমার সর্ব্বদা হাতের কাছে থাকেঃ–প্রথম, কোন বহির্বিষয় অন্তরাত্মাকে বিচলিত করিতে না পারে; বহির্বিষয়গুলা বাহিরেই অচলভাবে অবস্থিতি করে; চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ আত্মার অন্তর হইতেই—অন্তরের ভাব হইতেই উৎপন্ন হয়। দ্বিতীয়, কাল-যবনিকা এখনি পতিত হইবে, বর্ত্তমান দৃশ্যটি একেবারেই অন্তৰ্হিত হইবে। তোমার জীবনের মধ্যে কত বড় বড় পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে, তুমিত তাহা দেখিয়াছ। এক কথায়, জগতের সমস্তই শুধু কতকগুলি রূপান্তর-পরম্পরা, জীবনটা অন্তরের কতকগুলি ভাব বই আর কিছুই নহে।

 ৩। যদি বুদ্ধিবৃত্তিটা আমাদের সকলেরই সাধারণসামগ্রী হয়, তাহা হইলে বুদ্ধিবৃত্তির হেতু যে প্রজ্ঞা, তাহাও অবশ্য আমাদের সাধারণ জিনিস হইবে; এবং আর-একটা বুদ্ধি, যাহা বিধি-নিষেধের দ্বারা আমাদের আচরণকে নিয়মিত করে, সেই বিবেকবুদ্ধিও আমাদের সাধারণ সম্পত্তি। ইহা হইতে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, সমস্ত মানবজাতিই একটা সাধারণ নিয়মের অধীন; তাহা যদি হইল, তবে সমস্ত জাতিই এক রাষ্ট্রের অধীন, সকলেই এক রাজ্যের প্রজা।

 ৪। জন্ম ও মৃত্যু উভয়ই প্রকৃতির গূঢ় রহস্য এবং উভয়ের মধ্যেই সাদৃশ্য আছে। জীবন যে সকল উপাদানকে একত্র সম্মিলিত করে, মৃত্যু সেইগুলিকে ভাঙ্গিয়া দেয়—বিলীন করিয়া দেয়। অতএব ইহাতে এমন কিছুই নাই—যাহাতে মানুষ লজ্জা পাইতে পারে;–এমন কিছুই নাই—যাহা জ্ঞানবিশিষ্ট জীবের প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং মানব-প্রকৃতির পরিকল্পনার বিরুদ্ধ।

 ৫। আচরণ ও মনের ভাব প্রায় একই জিনিস্‌ বলিলেই হয়। অমুক প্রকৃতির লোকের অমুক প্রকার আচরণ অবশ্যম্ভাবী। ইহাতে যদি আশ্চর্য্য হও, তাহা হইলে, ডুমুর গাছ রসদান করে বলিয়াও তুমি আশ্চর্য্য হইবে। এটা যেন মনে থাকে, তুমি ও তোমার শক্র উভয়েই সরিয়া পড়িবে; এবং শীঘ্রই তোমাদের স্মৃতি পর্য্যন্ত বিলুপ্ত হইবে।

 ৬। তুমি ব্যথিত হইয়াছ বলিয়া মনে করিও না,—তাহা হইলেই তোমার ব্যথা চলিয়া যাইবে। ব্যথা জানাইও না, দেখিবে তোমার ব্যথা আর নাই।

 ৭। যাহাতে মনুষ্যত্বের হীনতা হয়, তাহাতেই মানুষের প্রকৃত হীনতা। তা ছাড়া,—কি বাহিরে, কি অন্তরে,—মানুষের আর কোন অনিষ্টের কারণ নাই।

 ৮। এই দুইটি মূলমন্ত্র যেন তোমার জীবনের নিয়ামক হয়ঃ—প্রথমতঃ, তোমার অন্তরে যিনি নিয়ন্তারূপে, অধিপতিরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, সেই বিবেকের আদেশ ও উপদেশ ছাড়া তুমি কোন কাজ করিবে না; যাহা মনুষ্যের পক্ষে হিতজনক, সেই কাজই করিবে। দ্বিতীয়তঃ, যদি তোমার কোন বন্ধু তোমার মত-পরিবর্ত্তনের পক্ষে উৎকৃষ্ট হেতু দেখাইতে পারেন, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তোমার মত পরিবর্ত্তন করিবে। সাধারণের হিত ও ন্যায়ধর্ম্মের খাতিরেই তুমি তোমার মত পরিবর্ত্তন করিতে পার, তোমার খেয়াল অনুসারে, কিংবা যশের জন্য মত পরিবর্ত্তন করিবে না।

 ৯। এখন তোমার প্রকৃতি স্বতন্ত্রভাবে রহিয়াছে, ব্যষ্টিভাবে রহিয়াছে; শীঘ্রই উহা সমষ্টির মধ্যে মিশাইয়া যাইবে;—যে বিশ্ব-প্রজ্ঞা হইতে তুমি জন্মলাভ করিয়াছ, তাহাতেই তুমি আবার প্রবেশ করিবে।

 ১০। জ্ঞানের কথা শুনিয়া চলিতে আরম্ভ কর;–এখন যাহারা তোমাকে বানর বলিয়া, পশু বলিয়া, অবজ্ঞা করিতেছে, তাহারাই আবার তোমাকে দেবতা বলিয়া পূজা করিবে।

 ১১। দশ হাজার বৎসর যেন তুমি অনায়াসে অপব্যয় করিতে পার, এরূপভাবে কোন কাজ করিও না। মৃত্যু তোমার শিয়রে বসিয়া আছে। জীবন থাকিতে থাকিতেই একটা কিছু ভাল কাজ কর, এবং তাহা তুমি অনায়াসেই করিতে পার।

 ১২। যে ব্যক্তি পরছিদ্রানুসন্ধান না করিয়া, পরচর্চ্চা না করিয়া, কিসে আপনি ভাল হইবে, সৎ হইবে, সেই উদ্দেশে আপনার প্রতিই তাহার সমস্ত অন্তর্দৃষ্টি নিয়োগ করে, সে ব্যক্তি কতটা সময় হাতে পায়, তাহার কাজ কত সহজ হইয়া পড়ে।

 ১৩। আমি মরিয়া গেলে, আমার কথা লইয়া সকলেই বলাবলি করিবে,—এই মনে করিয়া যাহারা আপনার স্মৃতির জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়, তাহারা ভাবে না, তাহার পরিচিত লোক সকলেই চলিয়া যাইবে। বংশপরম্পরাক্রমে তাহার যশ ক্রমেই ক্ষীণ হইতে থাকিবে; পর পর বংশ, যাহারা নিজেই যশের প্রার্থী, তাহার পূর্ব্ববংশীয় লোকের যশকে লাঘব করিবে, এইরূপে সেই যশ একেবারেই বিলুপ্ত হইবে। আচ্ছা, মানিলাম তোমার স্মৃতি অমর, তোমার ভক্ত লোকেরা অমর কিন্তু তাহাদের প্রশংসায় তোমার কি লাভ? তোমার মৃত্যুর উত্তর-কালের কথা বলিতেছি না, মনে কর—তুমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতেই যদি খুব প্রশংসা পাও, সে প্রশংসায় যদি সাধারণের কোন হিত না হয়, তাহা হইলে সে প্রশংসার মূল্য কি?

 ১৪। যাহা কিছু ভাল, তাহা স্বতই ভাল; সে ভাল গুণ সে নিজের স্বরূপ হইতেই পাইয়াছে; লোকের প্রশংসা তাহার কোন অংশ নহে। অতএব শুধু প্রশংসিত হইয়াছে বলিয়া কোন জিনিস ভালও নহে, মন্দও নহে। ন্যায়, সত্য, সুশীলতা, সংযম—এই সমস্ত জিনিস কোন প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ যদি মাণিকের গুণ কীর্ত্তন না করিয়া নীরব থাকে, তাহাতে মাণিকের উজ্জ্বলতার কি কিছু মাত্র লাঘব হয়?

 ১৫। যদি মৃত্যুর পরেও মানব-আত্মার অস্তিত্ব থাকে তাহা হইলে অনন্তকাল হইতে যে সকল আত্মা ক্রমাগত ইহ-লোক হইতে অপসৃত হইতেছে, তাহাদের জন্য আকাশে কি স্থান হইবে? ভাল, আমি জিজ্ঞাসা করি পৃথিবীতে যে এত লোক কবরস্থ হইতেছে তাহাদের জন্য কি স্থান হইতেছে না? প্রত্যেক শব কিছুকাল থাকিয়া পরিবর্ত্তিত ও বিলীন হইয়া যাইতেছে, তাহার স্থান আবার অন্য শব আসিয়া অধিকার করিতেছে; সেইরূপ যখন কোন মানুষ মরে, তাহার মুক্ত-আত্মা আকাশে চলিয়া যায়, তখন সে কিছুকাল সেই ভাবে থাকিয়া আবার পরিবর্ত্তিত হয়, পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়ে, অনলশিখার ন্যায় প্রজ্বলিত হয়; অথবা বিশ্বের প্রজননী শক্তির মধ্যে বিলীন হইয়া যায়। এইরূপে তাহারা পর-পর অন্য আত্মার জন্য স্থান ছাড়িয়া দেয়।

 ১৬। উচ্ছৃঙ্খলভাবে চলিও না; তোমার উদ্দেশ্য যেন সৎ হয়, তোমার বিশ্বাস যেন ধ্রুব হয়।

 ১৭। হে বিশ্বপ্রকৃতি! তোমার যাহা প্রীতিকর, আমার নিকটেও তাহাই প্রীতিকর। তুমি যাহা সময়োচিত বলিয়া মনে কর, আমি তাহা বেশী শীঘ্র আসিয়াছে, কিংবা বেশী বিলম্বে অসিয়াছে বলিয়া মনে করি না। হে বিশ্বপ্রকৃতি! তোমার ঋতুরা যে সব ফল আনয়ন করে, তাহাই আমার পক্ষে উপাদেয়। তোমা হইতেই সমস্ত উৎপন্ন হয়, তোমাতেই স্থিতি করে, এবং তোমাতেই পুনর্ব্বার প্রবেশ করে।

 ১৮। ডেমক্রিটান্‌ বলেন;—“যদি স্বচ্ছন্দে দিনপাত করিতে চাহ, তবে অধিক কাজের ভার হাতে লইও না।” আমার মনে হয়,—এই কথা বলিলে আরও ভাল হইত যে “নিতান্ত আবশ্যক ছাড়া কোন কাজ করিবে না; সামাজিক জীবের পক্ষে যাহা কর্ত্তব্য এবং যে প্রণালীতে কাজ করা কর্ত্তব্য তাহাই করিবে।” কারণ এই নিয়মানুসারে, কাজ অল্প হইলেও, তাহা সুসম্পন্ন হইতে পারে, এবং কার্য্য সুসম্পন্ন করিবার সুখ তাহা হইলে আমরা অনুভব করিতে পারি। আমরা যে সকল কথা কহি, যে সকল কার্য্য করি, তাহার অধিকাংশই অনাবশ্যক; আমাদের কথা ও আমাদের কাজ যদি কমাইয়া ফেলি, তাহা হইলে আমাদের হাতে অনেক অবসর থাকে, মনও বিচলিত হয় না। অতএব কোন কাজে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে আপনাকে আপনি এই প্রশ্নটি করিবে, “এমন কোন জিনিসে হাত দিতেছি কি না, যাহা প্রায় অনাবশ্যক?” আমাদের কি চিন্তা, কি কার্য্য—উভয়ের সম্বন্ধেই এই কথাটি মনে করিবে। কেননা, অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা,—অনাবশ্যক কার্য্যকে টানিয়া আনে।

 ১৯। এ দিকটা দেখিয়াছ কি? তবে ও দিক্‌টাও এক বার দেখ। মনকে বিচলিত হইতে দিবে না; তোমার মনের যেন একটিমাত্র সংকল্প হয়। যদি কোন ব্যক্তি কোন দোষে দোষী হয়, তবে সে আপনারই অনিষ্ট করে,–আপনার নিকটেই দোষী হয়। যদি তোমার কোন সুবিধা কিংবা লাভ হইয়া থাকে,—জানিবে সে বিধাতার দান। বিশ্বজনীন কারণ হইতে তাহা পূর্ব্ব হইতেই নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে—তাহা তোমার অদৃষ্টে গোড়া হইতেই আছে। মোটের উপর জীবন ক্ষণস্থায়ী; অতএব ন্যায়পরায়ণ হও, দূরদর্শী হও, জীবনের সদ্ব্যবহার কর, আত্মবিনোদনের সময় সতর্ক থাকিও।

 ২০। হয় এই জগৎ জ্ঞানময় সংকল্প হইতে, নয় আকস্মিক ঘটনা হইতে উৎপন্ন। যদি আকস্মিক ঘটনা হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে, তথাপি ইহা জগৎ—অর্থাৎ সুষমাবিশিষ্ট একটি সুন্দর গঠন। যদি কোন মানুষ আপনার গঠনে সুষমা দেখিতে পায়,—তবে সে কি বিশ্বজগৎকে বিশৃঙ্খলার রাশি বলিয়া মনে করিবে—সেই বিশ্বজগৎ যাহার অন্তর্গত মহাভূতদিগের গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলাও ক্রমে সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলায় পরিণত হয়।

 ২১। জগতে কি আছে—না জানা, এবং জগতে কি ঘটে—না জানা,—প্রায়ই একই কথা হইয়া দাঁড়ায়। জগতে কি আছে—যে জানে না, এবং জগতে কি ঘটে—যে জানে না—উভয়ই জগতের সহিত সমান অপরিচিত। সে একপ্রকার রাষ্ট্রের “পলাতক আসামী” বই আর কিছুই নহে। যে জ্ঞানের চক্ষু বুজিয়া থাকে, সে অন্ধ; যাহার নিজের বাড়ী সুসজ্জিত নহে, যে আর একজনের সাহায্য চাহে,—সে ভিক্ষুক। আপনার মনের মত সব হইতেছে না বলিয়া যে সর্ব্বদাই খুঁৎখুঁৎ করে এবং বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখে, সে জগতের একপ্রকার দুষ্ট ক্ষতস্বরূপ। একথা সে একবার ভাবিয়া দেখে না,—যে কারণ হইতে তাহার অপ্রিয় ঘটনাটি ঘটিয়াছে, সেই কারণ হইতেই সে নিজেও উৎপন্ন হইয়াছে। যে ব্যক্তি স্বার্থপর, সমস্ত জ্ঞানবিশিষ্ট জীবের বিশ্ব-আত্মা হইতে যে আপনার আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে সে একপ্রকার স্বেচ্ছানির্ব্বাসিত রাষ্ট্রদ্রোহী।

 ২২। এক জায়গা হইতে আলোচনা আরম্ভ কর: Vespatianএর আমলে জগৎ কিরূপ চলিতেছিল একবার ভাবিয়া দেখ;—দেখিবে এখনও যেমন তখনও তেমনি। কেহ বিবাহ করিতেছে, কেহ বা শিক্ষায় ব্যাপৃত, কেহ বা রোগগ্রস্ত, কাহারও বা মৃত্যু আসন্ন, কেহ বা যুদ্ধ করিতেছে, কেহ বা ভোজন করিতেছে; কেহ বা হলকর্ষণ করিতেছে, কেহ বা কেনা-বেচা করিতেছে; কেহ বিনয়ী, কেহ বা গর্ব্বিত; কেহ বা ঈর্ষ্যাপরায়ণ, কেহ বা শঠ; কেহ বা বন্ধুগণের মৃত্যু কামুনা করিতেছে, কেহ বা রাজকার্য্যে অসন্তুষ্ট হইয়া বিদ্রোহীসভার সভ্য হইতেছে; কেহ প্রেমিক, কেহ বা কৃপণ, কেহ বা প্রদেশের, কেহ বা রাজ্যের শাসনদণ্ড ধারণ করিতেছে। কিন্তু সে সময়কার সমস্ত ব্যাপার বহুকাল শেষ হইয়া গিয়াছে। তাহার পর, Trojan-এর আমলে আইস। এস্থলেও তাই, তাহারাও সব চলিয়া গিয়াছে। এইরূপ আলোচনা করিয়া দেখ, অন্য কালে এবং অন্য দেশে তোমার চিন্তাকে লইয়া যাও,—সেখানেও দেখিবে কত লোক কত বিচিত্র কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া অবশেষে পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া গিয়াছে। বিশেষতঃ তোমার পরিচিত লোকদিগকে স্মরণ করিয়া দেখ, কত বৃথা কার্য্যে, তাহারা ধাবমান হইয়াছে; আত্মার মর্য্যাদা তাহারা উপেক্ষা করিয়াছে, স্বকীয় অন্তঃপ্রকৃতিকে তাহারা অবহেলা করিয়াছে, তাহাকে লইয়া তাহারা সন্তুষ্ট হয় নাই—তাহাতেই তাহারা দৃঢ়রূপে আসক্ত হয় নাই।

 ২৩। মনে রাখিও, যে কার্য্যের যতটা ওজন ও গুরুত্ব সেই পরিমাণে তাহাতে ব্যাপৃত হওয়া কর্ত্তব্য। যদি তুচ্ছ বিষয় হইতে বিরত হও, তাহা হইলে বৃথা আমোদপ্রমোদ অক্লেশে ছাড়িয়া দিতে পারিবে।

 ২৪। যে সকল শব্দ পূর্ব্বে প্রচলিত ছিল এখন তাহা অপ্রচলিত হইয়া পড়িয়াছে। হা! শুধু তাহাই নহে; কালক্রমে যশও ম্লান হইয়া যায়, এবং ভাষার ন্যায় মানুষও অপ্রসিদ্ধ হইয়া পড়ে। Camillus, Coeso, Volesus, Leonatus এই সব নাম এখন নিতান্ত “সেকেলে” হইয়া পড়িয়াছে; Cipio, Cato, Augustus এবং তাহার পর Hadrian, Antonious এই সকল নামও শীঘ্র ঐ দশা প্রাপ্ত হইবে। এই সব জিনিস ক্ষণস্থায়ী, শীঘ্রই স্বপ্নকথার সামিল হইয়া পড়ে, বিস্মৃতির কবলে পতিত হয়। আমি সেই সকল লোকের কথা বলিতেছি যাঁহারা স্বকীয় যুগের এক একটি উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন। অবশিষ্ট লোক ত মরিবামাত্রই বিস্মৃতি-সাগরে নিমগ্ন হয়। ভাল, চিরস্থায়ী যশের অর্থ কি?—একটা তুচ্ছ অসার বস্তু ভিন্ন উহা আর কিছুই নহে। তবে কোন্‌ জিনিস আমাদের আকাঙ্ক্ষার বিষয় হইতে পারে? মনকে খাঁটি রাখা, সমাজের হিতের জন্য কাজ করা, যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহা সাদরে ও অম্লানবদনে গ্রহণ করা—ইহা ভিন্ন আকাঙ্ক্ষার বিষয় আর কিছুই নাই।

 ২৫। তরঙ্গতাড়িত পর্ব্বতের ন্যায় অটলভাবে দণ্ডায়মান হও, তরঙ্গসমূহ পর্ব্বতকে আঘাত করিয়া অবশেষে আপনিই উপশান্ত হয়। অমুক ব্যক্তি বলিলেন—“আমার এই দুর্ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে—আমি কি দুর্ভাগ্য!” মোটেই না! বরং তাহার বলা উচিত,—“এই দুর্ঘটনায়, আমি যে বিচলিত হই নাই—বর্ত্তমানে নিষ্পেষিত হই নাই, ও ভবিষ্যতের জন্যও ভীত হই নাই—ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য। আমার ন্যায় অন্য কাহারও এই দুর্ঘটনা হইতে পারিত; কিন্তু এই দুর্ঘটনায়, আমার ন্যায় সকলেই এরূপ নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিত না।”

 ২৬। দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় যে দুর্ভাগ্য, তদপেক্ষা দুর্ঘটনা সহ্য করার সৌভাগ্য কি আমার অধিক নহে? যে ঘটনা মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করিতে পারে না, তাহা কেমন করিয়া মানুষের দুর্ভাগ্যের বিষয় হইতে পারে? তুমি যদি ন্যায়বান্‌ হইতে চাহ, মহানুভব হইতে চাহ, মিতাচারী ও বিনয়ী হইতে চাহ, বিবেকী, সত্যপরায়ণ ভক্তিমান ও দাসত্ব-বিমুখ হইতে চাহ—এই দুর্ঘটনা কি তোমাকে বাধা দিতে পারে? যে ব্যক্তির এই সকল গুণ আছে—মানব-স্বভাবে যাহা থাকা উচিত তাহাই তাহার আছে। কোন দুর্ঘটনা উপস্থিত হইলে এই বীজ-মন্ত্রটি স্মরণ করিবেঃ—এই দুর্ঘটনাটি দুর্ভাগ্যের বিষয় নহে, বরং ভাল করিয়া সহ্য করিতে পারিলে উহা সৌভাগ্যেই পরিণত হইবে।

 ২৭। প্রাতঃকালে যখন শয্যাত্যাগ করিতে অনিচ্ছা হইবে, তখন এই কথাগুলি আপনার নিকট বলিবেঃ—মানুষের কাজ করিবার জন্য আমি এখন গাত্রোখান করিতেছি, কিন্তু সে কার্য্যসাধনের জন্য আমি সৃষ্টি হইয়াছি, যাহার জন্য আমি পৃথিবীতে প্রেরিত হইয়াছি, সে কার্য্য সাধন করিতে আমার মন যাইতেছে না। তবে কি শুধু ঝিমাইবার জন্য, নেপের ভিতর গরম থাকিবার জন্য আমি সৃষ্টি হইয়াছি? তা হোক্‌! কিন্তু ইহাতে বেশ আরামে থাকা যায়। মানিলাম। কিন্তু তুমি কি শুধু সুখভোগ করিবার জন্যই জন্মিয়াছ? তোমার কি কোন কাজ করিবার নাই? কার্য্যই কি তোমার জীবনের উদ্দেশ্য নহে? গাছপালা, পক্ষী, পিপীলিকা, মাকড়সা, মৌমাছি, ইহাদের দিকে একবার তাকাইয়া দেখ দিকি—দেখিবে, তাহারা সকলেই আপনার স্বভাবানুযায়ী নিজ নিজ কাজ করিতেছে। তবে শুধু কি মানুষই মানুষের মত কাজ করিবে না? তোমার বৃত্তিসমূহকে জাগাইয়া তুমি কি তোমার স্বভাব অনুসারে কাজ করিবার জন্য ধাবমান হইবে না? তাহা হইলেও, বিশ্রাম না করিয়া বাঁচা যায় না। সত্য, কিন্তু প্রকৃতি পানাহারের জন্য একটা সীমা নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, এ বিষয়ে ত তুমি প্রায়ই সীমা অতিক্রম কর; যাহা তোমার পক্ষে যথেষ্ট, তাহা ছাড়াইয়া যাও। কিন্তু শুধু কাজ করিবার সময়েই, যাহা তোমার সাধ্যায়ত্ত, তাহা অপেক্ষাও কম করিবার দিকে তোমার প্রবণতা দেখা যায়। আসলে, আপনার প্রতি তোমার অনুরাগ নাই। যদি তাহা থাকিত, তাহা হইলে তুমি তোমার মানব-স্বভাবকে ভালবাসিতে এবং সেই মানব-স্বভাবের আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করিবার চেষ্টা করিতে। দেখ না কেন, যখন কোন ব্যক্তি নিজের ব্যবসায় ভালবাসে, তখন সে তাহার কাজ যাহাতে সর্ব্বাংশে সুন্দর হয়, তার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। একজন ছুতোর ছুতোরের কাজকে,—একজন নৃত্যের শিক্ষক নৃত্যকলাকে যেরূপ সন্মান দেয়, তুমি তোমার মনুষ্যধর্ম্মকে তাহা অপেক্ষা কম সম্মান দেও। কিন্তু ধন ঐশ্বর্য্যের জন্য, খ্যাতিলাভের জন্য, গর্ব্বস্ফীত ও ধনলুব্ধ ব্যক্তিদিগের কতই না আগ্রহ দেখা যায়। এই সকল লোক যখন একটা কিছু পাইবার জন্য আকাঙ্ক্ষা করে, তখন তাহারা আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া তাহা লাভ করিবার জন্য চেষ্টা করে। তুমি কি মনে কর, এই সকল তুচ্ছ আমোদ-প্রমোদ অপেক্ষা তাহাদের সামাজিক কর্ত্তব্য সকল কম মূল্যবান্‌?

 ২৮। যতক্ষণ না আমার চলৎশক্তি রহিত হয় ততক্ষণ আমি প্রকৃতির পথে—ধর্ম্মের পথে চলিব, তাহার পর আমি বিশ্রাম করিব; যে বায়ু হইতে আমার দৈনিক নিঃশ্বাস পাইয়াছি, সেই বায়ুর মধ্যে আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিব; যে ধরণী আমার পিতৃপুরুষদিগকে পোষণ করিয়াছেন, আমার ধাত্রীকে দুগ্ধ যোগাইয়াছেন এবং এতদিন আমার খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করিয়াছেন, এবং তাঁহার অনুগ্রহের অপব্যবহার করিলেও যিনি সমস্ত সহ্য করিয়াছেন, অন্তিমে সেই ধরণীর ক্রোড়েই শয়ন করিব।

 ২৯। উপকার করিয়া কেহ কেহ প্রতিদানস্বরূপ তোমার নিকট হইতে কৃতজ্ঞতা চাহিয়া থাকে; কেহ কেহ ইহা অপেক্ষা বিনীত; তাহারা তোমার যে উপকার করে, তাহা মনে করিয়া রাখে, এবং তুমি যে তাহার নিকট ঋণী কতকটা সেই ভাবে তোমাকে দেখে। আর এক প্রকৃতির লোক আছে, তাহারা উপকার করে অথচ জানে না তাহারা উপকার করিতেছে। উহারা কতকটা দ্রাক্ষালতার মত; দ্রাক্ষালতা ফল ধারণ করিয়াই সন্তুষ্ট; গুচ্ছ গুচ্ছ আঙ্গুর ধারণ করে অথচ তাহার জন্য ধন্যবাদ প্রত্যাশা করে না। একটা শীকারী কুকুর যখন ভাল করিয়া তাহার কাজ করে কিংবা যখন কোন মৌমাছি একটু মধু সঞ্চয় করে তখন তাহারা কোন সোর-সরাবৎ করে না। যাহার উপকার করিয়া সে কথা কিছু মনে করে না, তাহাদিগেরই আচরণ আমাদের অনুকরণ করা কর্ত্তব্য।

 ৩০। চিকিৎসক কোন রোগীর জন্য অশ্বারোহণের ব্যবস্থা করেন, কোন রোগীকে ঠাণ্ডা জলে স্নান করিতে উপদেশ দেন। বিশ্বপ্রকৃতিও কতকটা এই উদ্দেশেই কাহারও জন্য পীড়া, কাহারও জন্য অঙ্গনাশ, সম্পত্তিনাশ, এবং এইরূপ অন্যান্য বিপদ নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। যেরূপ প্রথম স্থলে “ব্যবস্থার” অর্থ রোগীর স্বাস্থ্যসম্বন্ধে উপদেশ, সেইরূপ শেষোক্ত স্থলে “ব্যবস্থার” অর্থ, প্রত্যেক মনুষ্যের প্রকৃতি ও অদৃষ্টের উপযোগী বিশেষ বিশেষ প্রয়োগ। দেয়ালে পাথরগুলা ভাল করিয়া যোড়া দেওয়া হইলে কারিগরেরা বলিয়া থাকে, পাথরগুলা বেশ খাপে খাপে বসিয়াছে; আমাদের জীবনের কঠোর ঘটনাগুলিকে এইরূপ ভাবে দেখা উচিত। যেমন এই জগৎ বিশ্বপ্রকৃতির উপাদানেই গঠিত, বিশ্বপ্রকৃতি হইতেই এই জগৎ স্বকীয় রূপ ও সমগ্রতা লাভ করিয়াছে, সেইরূপ ইহার মধ্যে যে কার্য্যকারণ-পরম্পরা রহিয়াছে তাহারই যোগাযোগে অদৃষ্টের বিশেষ ফলাফল প্রসূত হয়। সাধারণ লোকে এ কথা বেশ বোঝে। তাহাদের বলিবার ধরণটা এইঃ—“অমুকের এইরূপ ঘটিয়াছে, কেন না, ইহা তাহার অদৃষ্টে ছিল।” চিকিৎসকের ব্যবস্থা-পত্র অনুসারে যেমন আমরা চলিয়া থাকি, সেইরূপ আমাদের ললাট-লিপির কথাও যেন আমরা অকাতরে পালন করি। অরুচিকর ও তিক্ত হইলেও, স্বাস্থ্যের খাতিরে ঔষধ যেমন আমরা হৃষ্টচিত্তে গলাধঃকরণ করি; সেইরূপ, প্রকৃতি যাহাকে হিতজনক ও সুবিধাজনক বলিয়া মনে করেন, তাহাকে তোমার নিজের স্বাস্থ্যের মত মনে করিবে। অতএব যখন কোন দশা বিপর্য্যয় ঘটিবে, তখন তাহা শান্ত ভাবে গ্রহণ করিবে। ইহা বিশ্বজগতের স্বাস্থ্যের উদ্দেশেই ঘটিয়া থাকে। ইহা নিশ্চিত জানিও, যদি জগতের হিত না হইত, তাহা হইলে কখনই এই দুর্ঘটনা তোমার নিকট প্রেরিত হইত না। আর প্রকৃতি কখনই খামখেয়ালি তাবে কাজ করেন না, তিনি এমন কোন কাজ করেন না, যাহা তাঁহার শাসনাধীন জীবসমূহের অনুপযোগী। অতএব, দুই কারণে তোমার নিজ অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকিবেঃ—প্রথমতঃ,—অতীব উচ্চ ও অতীব পুরাতন কারণসমূহ হইতে তুমি এই অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছ এবং ইহা গোড়া হইতেই নির্দ্দিষ্ট হইয়া আছে। দ্বিতীয়তঃ, সমগ্র জগতের সাধারণ হিতের জন্য ব্যক্তিবিশেষের অদৃষ্ট নিৰ্দ্ধারিত হয়। সমগ্র হইতে কিয়দংশ ছাঁটিয়া ফেলিলে সমগ্রকে বিকলাঙ্গ করিয়া ফেলা হয়, সমগ্রের ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়। অতএব, তুমি যদি আপনার অবস্থায় অসন্তুষ্ট হও,—তাহার অর্থ এই, তুমি বিশ্বপ্রকৃতির অঙ্গহানি করিতে চাহ, তোমার যতটা সাধ্য, জগৎকে টুক্‌রা টুক্‌রা করিয়া ভাঙ্গিতে চাহ।

 ৩১। বস্তু ও রূপ লইয়া—অর্থাৎ শরীর ও আত্মা লইয়াই আমার সত্তা; ইহার কোনটাই ধ্বংস হইবার নহে; কেন না, উহারা ‘নাস্তি’ কিংবা ‘কিছু না' হইতে উৎপন্ন হয় নাই। সুতরাং আমার সত্তার প্রত্যেক অংশ জগতের কোন-না-কোন কাজে লাগিবে, এবং এই অংশ আবার অপর অংশে পরিবর্ত্তিত হইবে—এবং এই পরিবর্ত্তন-পরম্পরা অনন্তকাল পর্য্যন্ত চলিতে থাকিবে। এই চিরপরিবর্ত্তনের পদ্ধতি হইতেই আমার সত্তা উৎপন্ন হইয়াছে,—আমার পূর্ব্বে, আমার পিতার সত্তাও এইরূপে উৎপন্ন হইয়াছে—এইরূপ অনাদি অতীত কাল হইতেই এই প্রবাহ চলিতেছে।

 ৩২। প্রজ্ঞা ও যুক্তি আপনাতেই আপনি পর্য্যাপ্ত—অপরের সাহায্য উহাদের প্রয়োজন হয় না। উহারা আপনার মধ্যেই বিচরণ করে এবং অব্যবহিতরূপে কার্য্য করে; প্রজ্ঞা ও যুক্তি অনুসারে আমরা যে কাজ করি তাহাই ঠিক্‌ কাজ, উহা ঠিক্‌ পথ দিয়া আমাদিগকে লইয়া যায়।

 ৩৩। মানুষের হিসাবে যে সমস্ত জিনিস মানুষের তাহাই মানুষের নিজস্ব, তাহা ছাড়া মানুষের নিজস্ব কিছুই নহে। কেন না, মনুষ্যত্বের ভাবের মধ্যে ঐ সমস্ত জিনিসের সমাবেশ নাই, সুতরাং মানুষের হিসাবে সে সমস্ত জিনিসে আমাদের প্রয়োজন নাই; আমাদের মনুষ্যত্ব সেই সকল জিনিস দিবে বলিয়া অঙ্গীকার করে না, এবং সেই সকল জিনিসে আমাদের মনুষ্যত্বের পূর্ণতাও সম্পাদিত হয় না। সুতরাং সেই সমস্ত মানুষের প্রধান লক্ষ্য নহে। যদি এই সমস্ত বাস্তবিকই আমাদের একান্ত আবশ্যক হইত, তাহা হইলে ঐ সকলের জন্য কেন আমাদের অবজ্ঞা উপস্থিত হয়, এবং সেই সমস্ত ছাড়িয়া সুখী হইতে পারিলে কেন উহা এত প্রশংসার বিষয় হইয়া থাকে? যদি বাস্তবিকই ঐ সকল জিনিস আমাদের পক্ষে ভাল হয়, তাহা হইলে এই সমস্ত সুবিধা ছাড়িয়া দেওয়া কি নিতান্ত বাতুলতার কাজ নহে? কিন্তু প্রকৃত অবস্থা অন্যরূপ। কেন না, আমরা ইহা বেশ জানি,—এই সকল বিষয়সম্বন্ধে আত্মত্যাগ ও ঔদাসীন্য আবশ্যক, এবং ঐ সকল বিষয় আমাদের নিকট হইতে চলিয়া গেলে যে ধৈর্য্য আবশ্যক সেই ধৈর্য্যই সাধু ব্যক্তির লক্ষণ।

 ৩৪। জগতের মধ্যে যাহা সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ তাহার পূজাতেই আপনাকে নিয়োগ করিবে। সেটি কোন পদার্থ?—তিনি সেই পরম পুরুষ যাঁহার দ্বারা সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড পরিচালিত ও পরিশাসিত হইতেছে। বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে যাহা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তাহাকে যেমন তুমি পূজা করিয়া থাক, সেইরূপ তোমার অন্তরের মধ্যে যাহা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তাহাকেও তোমার পূজা করা কর্ত্তব্য, তাহা পরমদেবতারই কাছাকাছি। সেটি যে তোমার অন্তরের প্রভু, তোমার কার্য্য ও ভাগ্যের কর্ত্তা–তাহা তাহার কার্য্যগুণেই প্রকাশ পায়।

 ৩৫। জগতের অনিত্যতা সম্বন্ধে সর্ব্বদা চিন্তা করিবে,—কত শীঘ্র প্রকৃতির দৃশ্যসমূহ পরিবর্ত্তিত হয় তাহা তাবিয়া দেখিবে। ভৌতিক জগৎ নিত্য নিয়ত আবর্ত্তিত হইতেছে। সর্ব্বকালে ও সর্ব্বত্রই পরিবর্ত্তনের কার্য্য চলিতেছে—কার্য্যকারণের মধ্য দিয়াই সেই পরিবর্ত্তন চলিতেছে, তাহার কোন স্থায়িত্ব নাই। তাহার পর, আমাদের খুব নিকটেই, অতীত ও ভবিষ্যৎরূপ দুইটা রসাতল মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে—তাহার অভ্যন্তরে সমস্ত পদার্থ অন্তৰ্হিত হইতেছে। অতএব সে কি মূঢ় যে এই সমস্ত ক্ষণিক পদার্থের জন্য গর্ব্বিত হয়, উদ্বিগ্ন হয়, দুঃখিত হয়—হায়! যেন এই সমস্ত পদার্থ চিরকাল থাকিবে।

 ৩৬। মনে রাখিবে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় তুমি একটি পরমাণু অপেক্ষাও ক্ষুদ্র; তোমার ভাগ্যে যে কালাংশ পড়িয়াছে তাহারও কি অপরিমেয় স্বল্পতা, এবং অদৃষ্টরাজ্যের মধ্যেও তুমি কি নগণ্য!

 ৩৭। তোমার দৈহিক অনুভূতিসমূহ প্রীতিজনকই হউক, বা অপ্রীতিজনকই হউক, তোমার অন্তরে যে কর্ত্তৃপুরুষ অধিষ্ঠিত আছেন—সেই সকল অনুভূতির সহিত যেন তাঁহার বিশেষ কোন সংস্রব না থাকে। দেহের বিশেষ বিশেষ অংশের অনুভূতি সেই সেই অংশের মধ্যেই বদ্ধ থাকুক; তোমার মন যেন তাহাদের হইতে তফাতে থাকে,—তাহাদের সহিত যেন মিশ্রিত না হয়। এ কথা সত্য, সমবেদনার নিয়ম-প্রভাবে আমরা দেহের প্রত্যেক অংশের বেদনা ন্যুনাধিক পরিমাণে অনুভব করিয়া থাকি; কেন না প্রকৃতির নিয়মকে একেবারে অতিক্রম করা যায় না। তবে, দৈহিক অনুভূতি একেবারে নিবারণ করিতে না পারিলেও, উহাকে অতিমাত্র প্রাধান্য দেওয়া কিংবা উহাকে আমাদের ভাল মন্দের প্রধান হেতু বলিয়া বিবেচনা করা উচিত নহে।

 ৩৮। দেবতাদিগের সহিত আমাদের একত্র বাস করা উচিত। তিনিই দেবতাদিগের সহিত বাস করেন যিনি বিধাতার বিধানে নিত্য তুষ্ট এবং যিনি সেই অন্তর্দেবতার আজ্ঞা পালন করেন যে দেবতা বিধাতারই প্রতিনিধি ও ঈশ্বরের আত্মজ। এই দেবতা আর কেহই নহেন—ইনি সেই অন্তরাত্মা—সেই বিবেকবুদ্ধি যাহা সকলেরই অন্তরে নিহিত আছে।

 ৩৯। মনে করিয়া দেখিবে, দেবতাদিগের প্রতি, পিতা মাতার প্রতি, ভ্রাতাভগিনীর প্রতি, স্ত্রীপুত্রের প্রতি শিক্ষকের প্রতি, বন্ধুর প্রতি, ভৃত্যের প্রতি তুমি বরাবর কিরূপ ব্যবহার করিয়াছ। লোকে তোমার সম্বন্ধে এ কথা বলিতে পারে কি না,—“ও ব্যক্তি কার্য্যে কিংবা বাক্যে কাহারও কোন অনিষ্ট করে নাই।” আরও মনে করিয়া দেখিবে, কি পরিমাণ কাজ তুমি করিয়াছ, এবং তাহা সমাধা করিবার জন্য তোমার যথেষ্ট বল ও দৃঢ়তা ছিল কি না; তোমার কার্য্য যদি শেষ হইয়া থাকে তাহা হইলে তোমার জীবনের ইতিহাসও শেষ হইয়াছে জানিবে। আরও মনে করিয়া দেখিবে, কত সুন্দর দৃশ্য তুমি দেখিয়াছ, কত সুখ দুঃখ তুমি অবজ্ঞা করিয়াছ, কত যশকীর্ত্তি তুমি উপেক্ষা করিয়াছ, এবং অপকারী ব্যক্তির কত উপকার করিয়াছ।

 ৪০। তুমি শীঘ্রই ভস্ম ও কঙ্কালে পরিণত হইবে। পৃথিবীতে হয় ত তোমার নাম থাকিয়া যাইবে কিংবা যাইবে না। কিন্তু নাম জিনিস্‌টা কি? ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি ছাড়া উহা আর কিছুই নহে। তার পর, এ সংসারে যে সকল জিনিসের খুব আদর সে সমস্তই শূন্যগর্ভ, অসার, গলিত, ও অকিঞ্চিৎকর। ইহা কুকুরের হাড়-কাড়াকাড়ির মত; ইহা ছেলেদের খেলনা কাড়াকাড়ির মত—তাহারা পাইলে উৎফুল্ল হয়, আবার না পাইলে অশ্রুজলে ভাসে। তবে, এই পৃথিবীতে, কোন জিনিস্‌ তোমার অবলম্বন হইতে পারে? যদি ইন্দ্রিয়ের বিষয় সকল ভাসমান ও পরিবর্ত্তনশীল হয়, যদি ইন্দ্রিয়গণ কুয়াসাচ্ছন্ন ও ভ্রমপ্রবণ হয়, যদি অন্তঃকরণ রক্তমাংসেরই রূপান্তরমাত্র হয়, এবং ক্ষুদ্র মানুষের নিন্দাপ্রশংসা যদি নিতান্তই তুচ্ছ জিনিস হয়—আমাদের অবস্থা যদি বাস্তবিকই এইরূপ হয়, তবে যতক্ষণ না তোমার প্রাণবায়ু দেহ হইতে অপসারিত হইতেছে ততক্ষণ ধৈর্য্যসহকারে একটু অপেক্ষা করিয়া থাক না কেন;—কিন্তু ততক্ষণ আমি কি করিব? ইহার সহজ উত্তর এই—দেবতাদের পূজা কর, দেবতাদের মহিমা কীর্ত্তন কর; মানুষের উপকার কর; এবং সকলের শেষে এই কথাটি মনে রাখিও, তোমার রক্তমাংস ও নিঃশ্বাসের বাহিরে যাহা কিছু অবস্থিত, তাহা তোমার নহে, তোমার আয়ত্তাধীন নহে।

 ৪১। তুমি যদি কোন কাজ ভাল করিয়া আরম্ভ কর এবং যদি তোমার চিন্তা ও কার্য্যকে সুপ্রণালীক্রমে নিয়োগ কুর, তাহা হইলে তুমি নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ করিবে। ঈশ্বর, মনুষ্য ও জ্ঞানবান্‌ জীবমাত্রেরই অন্তরে দুইটি তত্ত্ব বিদ্যমান;—একটি—বাহ্য বিষয়ের বাধা না মানা; আর একটি—এই কথাটি উপলব্ধি করা যে, সাধুভাব ও সাধু কার্য্য আর কিছুরই আকাঙ্ক্ষা রাখে না, উহারা আপনারাই পরম সন্তোষের হেতু।

 ৪২। শুধু তোমার কর্ত্তব্য করিয়া যাও, আর কিছুর জন্য উদ্বিগ্ন হইও না। শীত হউক, গ্রীষ্ম হউক, লোকে তোমায় ভাল বলুক, মন্দ বলুক, কিছুরই জন্য চিন্তা করিও না; এমন কি মৃত্যুকেও ভয় করিও না। জানিবে, জীবনকে ত্যাগ করাও জীবনের একটা কাজ; বর্ত্তমান কালের সদ্‌ব্যবহার করিতে পারিলেই যথেষ্ট।

 ৪৩। সকল বস্তু তলাইয়া দেখিবে; কোন জিনিসের আসল গুণটি যেন তোমার দৃষ্টিকে এড়াইয়া না যায়।

 ৪৪। কোন অনিষ্টাচরণের অনুকরণ না করাই প্রতিশোধ লইবার প্রকৃষ্ট পন্থা।

 ৪৫। জগতে যাহা কিছু হইতেছে সমস্তই একজন জ্ঞানস্বরূপ পুরুষের দ্বারাই হইতেছে। এই বিশ্ব-কারণের অন্য কোন সহকারী নাই; কি বাহিরে, কি অভ্যন্তরে—আর কোন মূলতত্ত্ব আসিয়া উহার স্থান অধিকার করে নাই।

 ৪৬। হয় এই জগৎ কতকগুলা পরমাণুর সমষ্টি—যদৃচ্ছাক্রমে একবার মিশিতেছে আবার পৃথক হইয়া পড়িতেছে; নয় এই জগৎ সুশৃঙ্খল ও সুব্যবস্থিত নিয়মের অধীন। যদি পূর্ব্বোক্ত কথাই ঠিক্‌ হয়, তবে কি জন্য আমি এমন জগতে থাকিতে যাই যেখানে এরূপ বিশৃঙ্খলা এবং সেখানে সমস্ত পদার্থ এরূপ অন্ধভাবে একত্র মিশ্রিত হইয়াছে; তবে, যত শীঘ্র পারি পঞ্চভূতের সঙ্গে পুনর্ব্বার মিশিয়া যাওয়া ছাড়া আমার আর কিসের ভাবনা? তবে আর কিসের জন্য আমি এত কষ্ট পাই? যাই আমি করি না কেন, আমার পঞ্চভূত ত চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইবেই। কিন্তু জগতের যদি কোন বিধাতা পুরুষ থাকেন,—তবে সেই জগতের মহান্‌ নিয়ন্তা ও শাসয়িতাকে আমি পূজা করিব, এবং তাঁহারই আশ্রয়ে নিশ্চিন্তমনে ও প্রফুল্লচিত্তে জীবন যাপন করিব।

 ৪৭। কোন প্রতিকূল ঘটনা তোমার চিত্তকে বিচলিত করিবামাত্র—তুমি তোমার অন্তরের জ্ঞান-মন্দিরে প্রবেশ করিবে, প্রয়োজন না হইলে সেখান হইতে একপাও বাহির হইবে না; সেখানে গেলে, সে ঘটনা তোমার নিকট আর বেসুরা বলিয়া ঠেকিবে না—আবার সামঞ্জস্য লাভ করিয়া উহা তোমার আয়ত্তের মধ্যে আসিবে।

 ৪৮। এই দৃষ্টান্তটি গ্রহণ কর, যদি তোমার সৎমা ও মা উভয়ই থাকেন, তুমি তোমার সৎমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর, কিন্তু মার সঙ্গেই তোমার বেশী কথাবার্ত্তা হয়। সংসার ও তত্ত্বজ্ঞানের মধ্যে এইরূপ সম্বন্ধ; সর্ব্বদা তত্ত্বজ্ঞানের নিকট থাকিয়াই তুমি বেশী আরাম ও আনন্দ লাভ করিবে। তত্ত্বজ্ঞানসন্মত ধর্ম্মজীবন যাপন করিলেই সংসার তোমার নিকট সহনীয় হইবে, তুমিও সংসারের নিকট সহনীয় হইবে।

 ৪৯। যখন কোন আমিষ-ব্যঞ্জন আমাদের নিকট আনীত হয়—তখন আমরা যেন মনে করি, ইহা একটা মৎস্যের মৃত শরীর, ইহা একটা পাখীর মৃত শরীর, এবং অন্যটি শূকরের মৃত শরীর; এই যে মদ্য—ইহা কতকগুলা আঙ্গুরকে পিষিয়া প্রস্তুত হইয়াছে; এই যে আমার রাজপরিচ্ছদ—ইহা মেষের কতকগুলা লোম পাকাইয়া শামুকের রক্ত দিয়া রঞ্জিত। এইরূপ, অন্যান্য ইন্দ্রিয়সুখের সামগ্রীর কথা যদি ভাবিয়া দেখি ত দেখিব, উহারা ঐরূপ স্থুল উপাদানেই নির্ম্মিত; এবং এই ধারণাটিকে যেন আমাদের জীবনের সমস্ত বাহ্যাড়ম্বরে আমরা প্রয়োগ করি। যখন কোন বস্তুর বাহ্য চাকচিক্যে আমরা মুগ্ধ হই তখন তাহাকে যেন আমরা পরোখ করিয়া দেখি; যে সকল বাক্য তাহাকে সপ্তমস্বর্গে উত্তোলন করে সেই বাক্যাবরণটা তাহা হইতে খসাইয়া ফেলিলেই তাহার অসারতা উপলব্ধি হইবে। এইরূপ সতর্কতা অবলম্বন না করিলে, বাহ্যরূপ ও আকারে বড়ই বিড়ম্বিত হইতে হয়। বাহ্যরূপের ন্যায় প্রবঞ্চক আর দ্বিতীয় নাই। যখনই কোন পার্থিব পদার্থে মুগ্ধ হইবে, তখনই জানিবে তুমি প্রবঞ্চিত হইয়াছ।

 ৫০। যদি দেখ, কোন একটা বিষয় খুবই কঠিন, তাহা হইতে এরূপ সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাৎ করিও না যে, কেহই উহা আয়ত্ত করিতে পারে না। যদি বিষয়টা যথোপযুক্ত হয় এবং আর কোন ব্যক্তির পক্ষে সুসাধ্য হয়, তাহা হইলে বিশ্বাস করিও—উহা তোমারও সাধ্যায়ত্ত।

 ৫১। আমার ভুল যদি আমাকে কেহ বুঝাইয়া দিতে পারে, তাহা হইলে আমি হৃষ্টচিত্তে আমার মত পরিবর্ত্তন করিব। কেন না, আমার কাজ—সত্যানুসন্ধান করা, এ পর্য্যন্ত সত্যের দ্বারা কাহারও কোন অনিষ্ট হয় নাই। যে ব্যক্তি অজ্ঞতা ও ভ্রমকেই ধরিয়া থাকে, তাহারই অনিষ্ট হয়।

 ৫২। আমি আমার কর্ত্তব্য করিতেছি—ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট; আর কোন বিষয়ের জন্য আমি উদ্বিগ্ন হইব না।