মার্কাস্‌ অরিলিয়সের আত্মচিন্তা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 ১। আমাদের স্মরণ করা উচিত, জীবন ক্রমশঃ ক্ষয় হইতেছে এবং প্রতিদিনই উহার অল্প অংশ অবশিষ্ট থাকিতেছে; এবং সেই সঙ্গে ইহাও বিবেচনা করা উচিত, যদি মানুষের পরমায়ু এখনকার অপেক্ষা অধিক হইত, তাহা হইলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মন সমান চালে চলিতে পারিত কি না, কাজ করিবার বুদ্ধি থাকিত কি না, ঐহিক ও পারত্রিক বিষয় চিন্তা করিবার শক্তি থাকিত কি না, তাহারও কোন নিশ্চয় নাই। কেন না, একথা সত্য, মানুষ জরাগ্রস্ত হইলেও তাহার প্রাণী-শরীরের ক্রিয়াগুলি চলিতে থাকে; সে নিশ্বাস গ্রহণ করিতে পারে, তাহার দেহ পুষ্ট হইতে পারে, তাহার কল্পনা থাকিতে পারে, তাহার প্রবৃত্তি বাসনাদি থাকিতে পারে; কিন্তু জীবনের সদ্ব্যবহার করা, পূর্ণমাত্রায় কর্ত্তব্যসাধন করা, বুদ্ধিবিবেচনার সহিত কাজ করা, বস্তু ও অবস্তু বিচার করিয়া দেখা,—এসমস্ত বিষয়ের পক্ষে সে মৃত বলিলেও হয়। অতএব আমাদিগকে খুব দ্রুত পদে চলিতে হইবে, সমস্ত কাজ যত শীঘ্র পারি গুছাইয়া লইতে হইবে; কেন না, মৃত্যু ক্রমাগত অগ্রসর হইতেছে তা’ছাড়া, কখন কখন, আমাদের পূর্ব্বেই আমাদের বুদ্ধির মৃত্যুদশা উপস্থিত হয়।

 ২। নৈসর্গিক বস্তুর যাহা কিছু নৈসর্গিকভাবে ঘটে তাহাই মনোহর ও আনন্দপ্রদ। ডুমুর যখন খুব পাকিয়া উঠে, তখন আপনা হইতেই তাহার মুখ খুলিয়া যায়; জলপাইগুলা যখন পাকিয়া ভূতলে পতিত হয় তখন তাহাদিগকে কেমন সুন্দর দেখায়। ধান্য-শীষের বাঁকিয়া পড়া, সিংহের ভ্রকুটি, ভল্লুকের ফেন-ফুৎকার—এ সমস্ত যদি এক-এক করিয়া পৃথক্ভাবে দেখা যায়, তাহা হইলে উহাদিগকে সুন্দরের বিপরীত বলিয়াই মনে হয়, কিন্তু উহাদিগকে যদি বিশ্বপ্রকৃতির কার্য্য বলিয়া দেখা যায় তবে উহাই সুশোভন ও চিত্তাকর্ষক হইয় উঠে। এইরূপ মার্জ্জিত দৃষ্টিতে দেখিলে, ফুটন্ত যৌবনের ন্যায়, বাৰ্দ্ধক্যের পরিপক্বতার মধ্যেও সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করা যায়। অবশ্য, এ সৌন্দর্য্য সকলেই দেখিতে পায় না, যাহারা বিশ্বপ্রকৃতির সহিত সুর মিলাইয়া তন্ময় হইয়াছে তাহারাই এই সৌন্দর্য্য দেখিতে পায়।

 ৩। যে হিপক্রিটিস্ কত রোগ সারাইয়াছেন, শেষে তিনি নিজেই পীড়িত হইয়া মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইলেন। যে চ্যাল্‌ডীয় জাতি অন্যের মৃত্যু গণনা করিত, অবশেষে তাহাদের নিজেরই সেই দশা উপস্থিত হইল। আলেক্‌জাণ্ডার, পম্পে, জুলিয়াস্‌-সীজার, কত নগর ধ্বংস করিয়াছিলেন, শেষে তাঁহারাও কালগ্রাসে পতিত হইলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কালানলে ভস্মীভূত হইবে বলিয়া যে হিরাক্লিটস্ কত তর্কবিতর্ক করিয়াছেন, তাঁহার জলজনিত উদরী রোগে মৃত্যু হইল। ডেমক্রিটস্‌কে পোকায় খাইল; আর একপ্রকার কীট সক্রেটিস্‌কে বিনাশ করিল। এই সকল দৃষ্টান্ত কিসের জন্য? দেখ; তোমরা জাহাজে চড়িয়া সমুদ্র পার হইয়াছ, বন্দরে আসিয়া পৌঁছিয়াছ; ইতস্ততঃ না করিয়া এইবার তবে জাহাজ হইতে নামিয়া পড়। যদি আর এক জগতের ডাঙ্গায় আসিয়া নামিয়া থাক,—তাহাতে ভয় নাই, সেখানে অনেক দেবতা আছেন, তাঁহারা তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন; আর যদি তুমি শূন্য নাস্তিত্ত্বের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া থাক তাহাতেই বা কি? তাহা হইলে তুমি ত সুখ দুঃখের হাত হইতে একেবারেই নিষ্কৃতি পাইলে। তাহা হইলে দেহরূপ বহিরাচ্ছাদনের জন্য আর তোমাকে গাধার খাটুনি খাটিতে হইবে না। যে যে-পরিমাণে যোগ্য, তাহার বহিরাচ্ছাদনটি সেই পরিমাণে অযোগ্য; কেন না, একটি আত্মময়, জ্ঞানময়, দেবপ্রকৃতি;—আর একটি, ধূলা আবর্জ্জনা বই আর কিছুই নহে।

৪। অন্যের সহিত যেখানে তোমার স্বার্থ সমান সেই স্থল ছাড়া আর কোন স্থলেই অন্যের বিষয় লইয়া তোমার মনকে ব্যাপৃত রাখিবে না। পরচর্চ্চায় মন দিলে—অর্থাৎ অপরে কি কথা বলিতেছে, কি ভাবিতেছে, কি ফন্দি করিতেছে, কি মৎলবে কি কাজ করিতেছে—এই সমস্ত বিষয় ভাবিতে গেলে, আপনাকে ভুলিয়া যাইতে হয়,—আপনার জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য হইতে পরিভ্রষ্ট হইতে হয়। অতএব নিরর্থক কোন বিষয়ে আপনার মনকে ব্যাপৃত রাখিবে না, কিংবা তোমার চিন্তার প্রবাহের মধ্যে আর কোন অপ্রাসঙ্গিক কথা অনিয়া ফেলিবে না। বিশেষতঃ এইরূপ অনুসন্ধানে অযথা কৌতুহল ও দ্বেষহিংসা বর্জ্জন করিবে। অতএব যাহার বিষয়ে তোমাকে কেহ জিজ্ঞাসা করিলে তুমি মন খুলিয়া প্রকাশ করিতে পার না এমন সকল চিন্তা হইতে বিরত হইতে অভ্যাস করিবে। তুমি যাহা অন্যের নিকট প্রকাশ করিবে, তাহাতে অকাপট্য, সদ্ভাব, সাধারণের শুভচিন্তা ভিন্ন আর কিছুই যেন স্থান না পায়; তাহার মধ্যে যেন কোন প্রকার খেয়াল-কল্পনা, দ্বেষ, অসূয়া কিংবা অন্যায় সন্দেহের ভাব না থাকে। অর্থাৎ এমন কোন কথা বলিবে না যাহা বলিতে লজ্জা হয়। যিনি সাধনার দ্বারা এইরূপ যোগ্যতা লাভ করিয়াছেন, তিনি মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তিনি দেবতাদের নিয়োজিত একপ্রকার আচার্য্য ও পুরোহিত; তাঁহার অন্তরে যে দেবতা অধিষ্ঠিত তিনি সেই দেবতার সদ্ব্যবহার করিয়াছেন। সেই দেবতার সাহায্যেই তিনি সংরক্ষিত; সুখ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না, দুঃখ তাঁহার হৃদয়কে ভেদ করিতে পারে না, তিনি সুখের স্পর্শে অনাকৃষ্ট, দুঃখের বাণে দুর্ভেদ্য, তাঁহার কেহই অনিষ্ট করিতে পারে না, তিনি দুষ্ট লোকের দ্বেষ হিংসার বহু ঊৰ্দ্ধে অবস্থিত। এইরূপে অন্তরের রিপুগণকে দমন করিবার জন্য তিনি নিয়তই ধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত রহিয়াছেন; এবং ন্যায়ের ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া, তাঁহার ভাগ্যে যাহা কিছু ঘটিতেছে তিনি তাহা অম্লান বদনে গ্রহণ করিতেছেন। সাধারণের প্রয়োজন ও হিতের জন্য আবশ্যক না হইলে, তিনি অন্যের বাক্য চিন্তা ও কার্য্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না। তিনি আপনার কাজ লইয়াই ব্যাপৃত থাকেন, এবং বিধাতা তাঁহাকে যেরূপ অবস্থায় স্থাপন করিয়াছেন তিনি তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন এবং সন্তুষ্টচিত্তে তাঁহার নির্দ্দিষ্ট কর্ত্তব্য সকল পালন করেন। তিনি ভাবেন তাঁহার ভাগ্য যখন তাঁহার উপযোগী, তখন প্রত্যেক ব্যক্তিরই ভাগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিরই উপযোগী। তিনি বিবেচনা করেন, জ্ঞানের মূলতত্ত্বটিই সকল মনুষ্যের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছে, এবং ভূতদয়া ও সমস্ত জগতের ইষ্টচিন্তা, মানব-প্রকৃতিরই একটি অংশ। যাঁহারা বিশ্ব প্রকৃতির সহিত মিল করিয়া জীবন যাপনের চেষ্টা করেন, তাঁহাদের প্রশংসা ছাড়া আর কাহারও প্রশংসার কোন মূল্য নাই। যাহারা নিজেকেই সুখী করিতে পারে না, তাহাদের প্রশংসা অপ্রশংসার আবার মূল্য কি?

 ৫। অনিচ্ছুক হইয়া, স্বার্থপর হইয়া, পরামর্শ না করিয়া, কিংবা মনের আকস্মিক আবেগে কোন কাজ করিবে না। অদ্ভুত ধরণধারণ কিংবা রসিকতা প্রকাশ করিবারও চেষ্টা করিবে না। যতটা আবশ্যক তাহা অপেক্ষা বেশী কথা কহিবে না, অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবে না। তোমার যে অন্তর্দেবতা তোমার ভার গ্রহণ করিয়াছেন, সাবধান তুমি যেন তাঁহার বিশ্বাস না হারাও। তুমি যদি পুরুষ হও তো ঠিক পুরুষের মতন যদি স্ত্রীলোক হও তো ঠিক স্ত্রীলোকের মতন, তোমার যে বয়সই হউক ঠিক সেই বয়সের মতন আচরণ করিবে। পূর্ব্ব হইতেই এমন ভাবে লোকের নিকট তোমার বিশ্বাস ও পসার বজায় রাখিবে যে, হিসাব নিকাশের ছাড়পত্র চাহিবার সময়ে যেন তোমার শপথ করিতে না হয়—খরচের স্বাক্ষর-নিদর্শন দেখাইতে না হয়। তোমার মুখ যেন সর্ব্বদাই প্রসন্ন থাকে। বাহ্য অবলম্বনের উপর নির্ভর করিবে না, কিংবা অপরের নিকট হইতে শান্তি যাচ্‌ঞা করিবে না। এক কথায়—যষ্টির উপর ভর দিয়া থাকিবার জন্য আপনার পা দুটাকে দূরে নিক্ষেপ করিবে না।

 ৬। সমস্ত মানব-জীবন-ক্ষেত্র খুঁজিয়া তুমি যদি এমন কিছু পাও যাহা ন্যায় ও সত্য হইতে, মিতাচার ও ধৈর্য্য হইতে, সদাচার-জনিত আত্মপ্রসাদ ও বিধাতার হস্তে আত্মসমর্পণ-জনিত চির-সন্তোষ হইতে অধিক বাঞ্ছনীয়, তাহা হইলে আমি বলি, তুমি তাহাকেই উত্তম মনে করিয়া সর্ব্বান্তঃকরণে সেই দিকে গমন কর। কিন্তু, যে দেবতা তোমার অন্তরে নিহিত, যিনি তোমার প্রকৃতি ও বাসনা-সমূহের প্রভু, যিনি তোমার মনের ভাব পরীক্ষা করিতেছেন এবং যিনি (সক্রেটিস্ এই কথা বলিতেন) আপনাকে ইন্দ্রিয়াদি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছেন, যিনি দেবতাদের শাসন মানিয়া চলেন, যিনি সমস্ত মানব জাতির শুভ কামনা করেন, সেই অন্তর্দেবতা অপেক্ষা মূল্যবান্‌ জিনিস যদি তোমার আর কিছুই না থাকে, যদি আর সমস্তই ইহার নিকট তুচ্ছ বলিয়া তোমার মনে হয়, তাহা হইলে আর কাহারও হস্তে আপনাকে সমর্পণ করিও না। কেন না, যদি আর কোন দিকে তুমি ঝুঁকিয়া পড়, তাহা হইলে, যাহা তোমার প্রকৃত মঙ্গল তৎপ্রতি তোমার অবিভক্ত মন প্রয়োগ করিতে পারিবে না; কেন না যাহার প্রকৃতি স্বতন্ত্র ও যাহা ভিন্ন জাতীয়—এরূপ কোন জিনিসকে (যেমন, লোক-প্রশংসা, ধন ঐশ্বর্য্য সুখ ইত্যাদি) যুক্তি-সঙ্গত ও রাষ্ট্র-সঙ্গত প্রকৃত মঙ্গলের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে দেওয়া উচিত নহে। এই সকল জিনিস যদি একবার মনোরঞ্জন করিতে আরম্ভ করে তবে আর রক্ষা নাই, ক্রমে উহার প্রবল হইয়া মানুষের সমস্ত মনকেই বিকৃত করিয়া ফেলে। অতএব তোমার সমস্ত মনের ঝোঁক যেন একদিকেই যায়, যাহা সর্ব্বোত্তম সেই দিকেই যেন তোমার মন ধাবিত হয়। যাহা হিতকর তাহাই সর্ব্বোত্তম। বুদ্ধি-জ্ঞান-বিশিষ্ট জীবের পক্ষে যাহা হিতকর বিবেচনা করিবে তাহাই দৃঢ়হস্তে ধরিয়া থাকিবে, কিন্তু যদি উহা শুধু পাশব জীবনের পক্ষেই ইষ্টজনক হয়,—তখনই উহা ত্যাগ করিবে, এবং ঔদ্ধত্য পরিত্যাগপূর্ব্বক স্থির বুদ্ধির সহিত বিচার করিয়া দেখিবে। কিন্তু সাবধান, অনুসন্ধানে যেন কোন প্রকার ক্রটি না হয়।

 ৭। যে কাজে তোমার বাক্যস্খলন হয়, লজ্জা চলিয়া যায়, যে কাজে কাহার প্রতি তোমার দ্বেষ, সন্দেহ, অভিসম্পাত প্রকাশ পায়, কিংবা এমন কোন কাজে তোমার প্রবৃত্তি হয়, যাহা দিনের আলোক সহিতে পারে না, যাহা জগতের মুখের দিকে তাকাইতে সাহস পায় না, জানিবে, সে কাজ তোমার স্বার্থের অনূুকূল নহে। যে ব্যক্তি আপনার মনকে, এবং আপনার অন্তর্দেবতার পূজাকে সর্ব্বাপেক্ষা মূল্যবান্‌ বলিয়া মনে করে, তাহার কোন শোকের অভিনয় করিতে হয় না, কোন দুর্দ্দশায় পড়িয়া পরিতাপ করিতে হয় না, তাহার বিজনতাও আবশ্যক হয় না, লোকসঙ্গও আবশ্যক হয় না; সে জীবনকে প্রার্থনাও করে না, জীবন হইতে পলায়নও করে না; তাহার শরীর, তাহার আত্মাকে দীর্ঘকাল কি অল্পকাল আবৃত করিয়া রাখিবে,—সে বিষয়ে সে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। যদি তাহার এই মুহূর্ত্তেই মৃত্যু হয়,—জীবনের অন্য সমস্ত নিয়মিত কাজের জন্য সে যেমন প্রস্তুত, ইহার জন্যও সে তেমনি প্রস্তুত। যতদিনই সে বাঁচিয়া থাকুক,— যাহাতে তাহার মন, জ্ঞানবুদ্ধি-বিশিষ্ট সামাজিক জীবের যোগ্য কাজে নিয়ত ব্যাপৃত থাকিতে পারে,—তাহার সমস্ত দীর্ঘ জীবনে, তাহাই তাহার একমাত্র চিন্তা।

৮। যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা সংযত হইয়াছে, বিশোধিত হইয়াছে, তাহাকে যদি পরীক্ষা কর ত দেখিতে পাইবে, তাহার মধ্যে বিকৃতভাব, মলিনভাব, কিংবা মিথ্যাভাব কিছুই নাই। মৃত্যু তাহার অসম্পূর্ণ জীবনের সম্মুখে হঠাৎ আসিয়া তাহাকে বিস্ময়বিহ্বল করিতে পারে না; কেহ এ কথা বলিতে পারে না যে জীবনের নাট্যমঞ্চে তাহার অভিনয় শেষ না হইতে হইতেই সে প্রস্থান করিল। তা’ছাড়া, তাহার মধ্যে এমন কিছুই নাই, যাহা দাসত্বব্যঞ্জক, কিংবা যাহা আড়ম্বরসূচক, সে অন্যের সহিত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আসক্তও হয় না, কিংবা তাহাদের হইতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হইয়াও থাকে না; তাহাদের নিকট তাহার দায়িত্বও নাই, তাহাদিগকে সে একেবারে বর্জ্জনও করে না।

 ৯। বিবেকবুদ্ধিকেই নিয়ত মানিয়া চলিবে; কেননা, যদি তুমি কোন ভাবের বশবর্ত্তী হইয়া এমন কোন কাজে প্রবৃত্ত হও, যাহা বিশ্বপ্রকৃতির বিরুদ্ধ, যাহা বুদ্ধিজ্ঞান বিশিষ্ট জীবের প্রকৃতির বিরুদ্ধ, তাহা হইলে, সেই বিবেকবুদ্ধিই তোমাকে সেই কাজ হইতে বিরত করিবে। এই জ্ঞানবুদ্ধি সমন্বিত মানব-প্রকৃতির অনুশাসন এই যে, অবিবেচনার সহিত কোন কাজ করিবে না, সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করিবে এবং স্বেচ্ছাপূর্ব্বক দেবতাদের আদেশ পালন করিবে।

 ১০। আর যত চিন্তা আলোচনা, সমস্তই তোমার মস্তিষ্ক হইতে দূর করিয়া দেও; কেবল উপরিউক্ত দুই চারিটি উপদেশ মনে রাখিও; আর মনে রাখিও, প্রতি মনুষ্যের জীবন বর্ত্তমানেই অবস্থিত,—যে বর্ত্তমানকাল কালের একটি বিন্দুমাত্র; কেননা, যাহা অতীত, তাহা অতিবাহিত হইয়াছে এবং ভবিষ্যৎকাল অনিশ্চিত। জীবনের গতি সঙ্কীর্ণ পরিসরের মধ্যে বদ্ধ; এবং মানুষ যেখানে অবস্থিতি করে, তাহাও জগতের একটি ক্ষুদ্র কোণ মাত্র। যে যশ খুব দীর্ঘস্থায়ী, তাহাই বা কতদিনের জন্য? হায়! যে সব ক্ষণস্থায়ী দীন মর্ত্ত্য মানব পৃথিবীতে একটু যশ রাখিয়া যায়, তাহারা আপনাদের সম্বন্ধে অল্পই জানে; এবং তাহাদের সম্বন্ধেও আরও কম জানে, যাহারা তাহাদের বহুপূর্ব্বে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে।

 ১১। উপরে যে সকল বিষয়ের ইঙ্গিত করিলাম, তাহার সহিত এই কথাটিও যোগ করিতে পারঃ—তোমার মনে যে কোন বিষয় উপস্থিত হইবে, তাহার লক্ষণ ও কার্য্যাদি-সম্বন্ধে সবিশেষ পরিচয় লইবে; তাহা হইলে তাহার আসল প্রকৃতি কি, সে বস্তুটা স্বরূপতঃ কি, তৎসম্বন্ধে পৃথক্ভাবে ও সম্পূর্ণরূপে আলোচনা করিতে পরিবে। কেননা, এই জীবনে যাহা কিছু ঘটে, তাহা যদি পদ্ধতিক্রমে পরীক্ষা ও আলোচনা কর, তাহাদের অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া যদি জানিতে পার, প্রত্যেক বস্তুর প্রয়োজন কি, কি প্রকারে বিশ্বপ্রকৃতি তাহার ব্যবহার করে—সমগ্র বিশ্বের সম্বন্ধে, ও যে মানুষ সেই বিশ্বরূপ রাজধানীর একজন নাগরিক, সেই মানুষের সম্বন্ধে তাহার মূল্য কি, সেই বস্তু আমার মনের উপর কিরূপ ছাপ দেয়, উহা কত দিন স্থায়ী হয়, উহাকে ব্যবহার করিতে গেলে আমার মধ্যে কি গুণ থাকা আবশ্যক—সুশীলতা, ধৈর্য্য, সত্যপরায়ণতা, সরলতা, ও আত্মনির্ভরশীলতা থাকা আবশ্যক কি না—এই সমস্ত যদি আলোচনা কর, তাহা হইলে তোমার মন যেরূপ মহত্ত্ব, লাভ করিবে, এমন আর কিছুতেই করিবে না।

 ১২। তুমি যদি বিবেকের শাসন মানিয়া চল, যদি শ্রম, বীর্য্য ও ধীরতার সহিত তোমার হাতের কাজগুলি সম্পাদন কর, তুমি যদি কোন নূতন আকর্ষণের প্রতি ধাবিত না হও, যদি তোমার অন্তর্দেবতাকে বিশুদ্ধ রাখ—এমনিভাবে বিশুদ্ধ রাখ যে এখনি বিধাতার দান বিধাতাকে বিশুদ্ধ অবস্থায় ফিরাইয়া দিতে পার, যেন তোমার জীবনের শেষ পরীক্ষা—এই ভাবে যদি তোমার মনকে দৃঢ় ও সুসংযত কর, তুমি যদি এই সকল উপদেশবাক্যকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাক, তোমার যেটি শ্রেষ্ঠ অংশ, তাহারই অনুগত হইয়া চল,—কিছুরই ভয় না করিয়া, কিছুরই আকাঙ্ক্ষা না করিয়া তোমার প্রকৃতির অনুসারে চল, নির্ভীকভাবে তোমার কথার সত্যতা রক্ষা কর, এবং তাহাতেই সন্তুষ্ট থাক, তাহা হইলেই তুমি সুখী হইবে—এ কাজে সমস্ত জগৎও তোমাকে বাধা দিতে পারিবে না।

 ১৩। যেমন অস্ত্রচিকিৎসকেরা আকস্মিক ঘটনার জন্য তাহদের অস্ত্রাদি সর্ব্বদাই সঙ্গে রাখে, সেইরূপ তুমি সেই সব তত্ত্বজ্ঞানের মূলসুত্র ও নিয়ম ঠিক্‌ করিয়া রাখিবে, যাহার দ্বারা তুমি মানব বিষয়ের ও ঐশ্বরিক বিষয়ের জ্ঞান লাভ করিতে সমর্থ হও; এবং ইহাও মনে রাখিও যে তোমার প্রত্যেক ক্ষুদ্র কাজে, মানব-বিষয়ের সহিত ঐশ্বরিক বিষয়ের বিশেষ যোগ আছে; কারণ, ঐশ্বরিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি না রাখিলে, মনুষ্যের প্রতি তোমার ব্যবহার যথোচিত হইবে না।

 ১৪। উদ্দেশ্যহীন হইয়া আর ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিবে না। বাৰ্দ্ধক্যে তোমার কাজে লাগিবে বলিয়া তুমি যে তোমার জীবনের দৈনিক ঘটনা-সকল লিখিয়া রাখিয়াছিলে, তাহাও পড়িবার সময় পাইবে না। তোমার গন্তব্য পথের দিকে দ্রুতপদে চল। আর আত্মবঞ্চনা করিও না, যদি তোমার নিজের উপর কিছুমাত্র মমতা থাকে, যতদুর পার, এখনও তোমার নিজের হিত সাধনে প্রবৃত্ত হও।

 ১৫। মানুষের তিনটি জিনিষ আছে;—শরীর, হৃদয় ও মন। শরীরের ইন্দ্রিয়বোধ, হৃদয়ের আবেগ, মনের জ্ঞান। ইন্দ্রিয়ের উপর বাহ্যপদার্থের ছাপ পড়ে—এই বিষয়ে মানুষ, গো-মহিষাদি পশুর সমান; প্রবৃত্তির আবেগ ও আবেশে অধীর হইয়া পড়া—ইহা হিংস্ৰজন্তু, ফ্যালারিস্‌, ও নীরোর ন্যায় ভোগবিলাসীদের ধর্ম্ম—নাস্তিক ও বিশ্বাসঘাতকদের ধর্ম্ম, এবং যাহারা লোক-লোচনের অগোচরে কাজ করে, তাহাদের ধর্ম্ম। এগুলি যদি মনুষ্য ও পশুর সাধারণ ধর্ম্ম, হইল, তবে এখন দেখা যাক্‌, সাধুব্যক্তির বিশেষ লক্ষণ কি? সাধুব্যক্তির বিশেষত্বটি এই যে, তাঁহার বিবেকবুদ্ধিই তাঁহার জীবনের নেতা; তাঁহার ভাগ্যে যাহা কিছু আইসে, তাহাতেই তিনি সন্তুষ্ট; বহির্ব্বিষয়ের কোলাহলে অবিচলিত থাকিয়া, তিনি তাঁহার অন্তর্দেবতাকে পরিশুদ্ধ রাখেন, শান্ত রাখেন, এবং তাঁহার আদেশবাণী দেববাণীর ন্যায় পালন করেন। বাক্যে তিনি সত্যপরায়ণ, কার্য্যে তিনি ন্যায়-পরায়ণ হয়েন। যদি সমস্ত জগৎ তাঁহার সততায় অবিশ্বাস করে, তাঁহার আচরণে প্রতিবাদ করে, তিনি যে সুখী, সে বিষয়ে সন্দেহ করে,—তথাপি তিনি তাহাতে কিছু মাত্র ক্ষুব্ধ হয়েন না, কিংবা, তাঁহার জীবনের গন্তব্য পথ হইতে তিলমাত্র পরিভ্রষ্ট হয়েন না। তিনি শুদ্ধচিত্ত হইয়া, শান্ত-দান্ত হইয়া, সর্ব্বতোভাবে প্রস্তুত হইয়া, নিজ অদৃষ্টের উপর সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিয়া, সেই গন্তব্য পথের দিকে অগ্রসর হয়েন।