আঁধার রজনী।

আইল রজনী নীলাম্বর পরি
বদনে বসন ঢাকিয়া ধনী।
বিনা সে সুধাংশু বিষাদে সুন্দরী
নামিল ধরায় ওই রজনী।
সন্ধ্যা সখী সহ করি সম্ভাষণ
তাহারে এখন বিদায় করি।
শঙ্খ ঘণ্টা রোলে মুখরি ভুবন
গিয়াছে চলিয়া সেই সুন্দরী।
সে চির অনূঢ়া নাহি তার পতি
নাহি তার হৃদে বিরহ জ্বালা।
দেবতা পূজায় সদা তার মতি
করে দেব পূজা দেবের বালা।
নামে ধরাধামে দেবতা পূজনে
নানা আয়োজন লইয়া সাথে।
ল’য়ে ধূপ দীপ অতি পূত মনে
করে পূজা সে যে জগৎনাথে।


আসিলে ধরায় সেই সন্ধ্যাদেবী
হয় দেব-গৃহে দেবতা পূজা।
শোক তাপে ভরা যে সকলি হৃদি
ধনী কিবা দীন ভিখারী রাজা।
ক্ষণ তরে সবে স্মরে বিভুনাম
ক্ষণতরে ভুলি শোকের তাপ।
ক্ষণতরে ত্যজি জীবন সংগ্রাম
ক্ষণতরে ভুল সকল পাপ।
গিয়াছে সে চলি নিজ কাজ সারি
ক্ষণিকের তরে আ সয়া ভবে।
দিয়াছে রজনী তারে দূর করি
সমদুঃখী বিনা কেন সে চাবে।
একাকিনী বসি ওই নীরবেতে
হুতাশ নিশ্বাস বহিছে তায়।
নহে তো সে শ্বাস ভরা সুরভিতে।
না বহে তাহাতে মৃদুল বায়।
আহা মনোছঃখে প’ড়েছে কালিমা।
অমল ধবল সে শোভা নাশি।
না হেরিয়া ধনী গগনে চন্দ্রমা
বদনে নাহিক মধুর হাসি।

কুটিল কুন্তলে কবরী বাঁধিয়ে
 নাহি দেয় তাহে তারার ফুল।
রজত বসনে না রয় শােভিয়ে
 নাহি আছে কানে হীরার দুল।
নাহি গন্ধরাজ বেলা যাঁথি যুঁথি
 সুরভি কুসুমে কণ্ঠেতে হার।
নাহি সে লাবণ্য, মলিন মূরতি
 সেই সুধাহাসি হাসে না আর।
মণিবন্ধে আর নাহি সে কাঁকন
 চরণে নাহিক নূপুর ধ্বনি।
নাহি শােভে গায় কুসুম ভূষণ
 বিষাদে বিবশা বেশে যামিনী।
পরি শােক বেশ রহিয়াছে হায়
 নাহিক বিমল রজত বেশ।
বিরহেতে আহা দহিছে হৃদয়
 নাহিক হাতে সুখের লেশ।
জোছনা কিরণে হয়ে ধবলিত
 জুড়াত চাঁদের সুধা পরশে।
চঁদের আলােকে হয়ে আলােকিত
 হাসিত যামিনী কত হরষে।

নাহি আছে চাঁদ গগন মাঝারে।
নাহি সে বিমল রজত ভাতি!
আঁধারে ব্যাপিয়া দিক্‌ চরাচরে
প্রকাশিত এই আঁধার রাতি।
আঁধারে জগৎ আবরিয়া আজি
আঁধার করিয়া রজনী প্রাণ।
আঁধার করিয়া তরুলতা রাজি
আঁধারে রজনী ঢাকে বয়ান।
আঁধার করিয়া সকলের মন
কোথায় গমন করেছে শশী।
আঁধার করিয়া নীলিম গগন
তোমার বিহনে আঁধার নিশি।
নদ নদী আর বিমল সরসী
হাসেনাক আজ তোমা বিহনে।
নাহি কার মুখে হরষের হাসি
সুখ নাহি আছে কাহার মনে।
শুন প্রাণ সখি শুনলো রজনী
দেখিয়া কি তুমি আমার দুঃখ।
বিবরিয়া মোরে কহলো সজনি
কেন বা ঢেকেছ বিষাদে মুখ।


হেরি মম বেশ তুমি কিলো সখি!
খুলেছ কাঁকন কণ্ঠের হার।
তাইকি রজনী আমারে নিরখি।
কুসুম ভূষণে সাজনি আর?
হেরি মোর মুখ বুঝি বা সজনি
বদন ঢেকেছ কালিমা বাসে।
সম দুঃখী মোরা, এসলো ভগিনী
গাহি দুঃখ গাথা তব সকাশে।
তোমার মতন আমিও দুঃখিনী
হায় অভাগিনী নাথ বিহনে।
নয়ন নীরেতে ভাসেগো মেদিনী
রহি মনোদুখে কাতর মনে।
কুটিল কুন্তল দিয়াছি ফেলিয়া
কাজ কিলো আর চিকুর দামে।
সীমন্তের মাঝে ভস্ম বিলেপিয়া
সাজি সন্ন্যাসিনী মরি মরমে।
খুলিয়া ফেলেছি যত আভরণ
তেয়াগি বসন ভূষণ সাজ।
করিয়াছি সার এ শ্বেত বসন
এ দেহে এখন নাহিক কাজ।


খুলিয়া ফেলেছি দূরে মতিমালা
খুলিয়া ফেলেছি বলয় দূরে।
কটিদেশে নাহি শোভিছে মেখলা
চরণ শোভে না আর নূপুরে।
কাজ কিবা আর এছার রতনে
হৃদয় রতন হারায়ে সই!
কাজ কিবা আর বসন ভূষণে
প্রাণের ভূষণ প্রাণেশ বই।
নাথের বিরহে দহি দিবানিশি
কাহারে কহিব প্রাণের জ্বালা।
রহিয়াছে প্রাণে অনলের রাশি
বিরহ অনলে দহে অবলা।
ধরি তব গলা কহিব কাতরে
পরাণে আমার যতেক দুঃখ।
তব কাছে বসি রব দুঃখ ভরে
জীবনেতে কিছু নাহিক সুখ।
আলোকনাশিনী ওলো নীলাম্বরা
ছাড়ি গেছে তোরে প্রাণের পতি।
বিরহে তাহার হয়েছ কাতরা।
শোক-বেশে তুমি সেজেছ সতী।


তোমার আমার বিভিন্ন যে সাজ
করেছেন বিধি এই নিয়ম।
বদনেতে তুমি ঝাঁপ নীলাম্বর
আমি শ্বেত বাসে ঢাকি সরম।
পুনঃ গো সজনি তোমার আবার
এ দুঃখ-রজনী হইবে ভোর।
পুনঃ পাবে তুমি নাথেরে তোমার
ভাসিবে লো সুখে জীবন তোর।
হাসিবি লো সুখে চাঁদের কিরণে
প্রণয়-জোছনা হৃদয়ে মাখি।
হরষে হাসিবি প্রাণেশের সনে
শশীর মিলনে হইয়া সুখী।
আসিবে আবার হাসিতে হাসিতে
ত্যজিয়া ত্বরিতে ঘুমের ঘোরে।
প্রসারিয়া ভুজ লইবি হৃদেতে।
ধরিয়া রাখিবি হৃদয়চোরে।
চির দিন তরে আমার যে সখি!
সে সুখ-চন্দ্রমা গিয়াছে চলি।
না যাবে আঁধার সে চাঁদ নিরখি
আঁধার জীবন রবে কেবলি।


না পোহবে আর এই দুঃখ-রাতি
না হবে এ দুঃখ-রজনী ভোর।
এ অনলে আমি জ্বলিব গো নিতি
জ্বলিয়া যাইবে জীবন মোর।
যবে শেষ হবে নিয়তির খেলা
যাব পর পারে মিলন-দেশে।
শেষ দিনে শেষ হবে এই জ্বালা
সে শেষ অনলে স্মরি প্রাণেশে