মালা/জীবনের সেই দিন
জীবনের সেই দিন।
জীবনের সেই দিন জাগে মনে পুনরায়,
যেই স্মৃতি রহিয়াছে ব্যাপি এ হৃদয় হায়!
যে শুভ মুহুর্ত্তে হায় জীবনের এ সংগ্রাম,
করিতে হয়েছি রত চলিতেছি অবিরাম।
সন্ধিবিচ্ছেদের হায় মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া,
উৎসর্গ করিনু প্রাণ আপনারে বলি দিয়া।
কর্ত্তব্যের সে কঠিন শৃঙ্খল পরিয়া পায়,
করিলাম আত্মদান বিকাইনু আপনায়।
পিতা-মাতা-হৃদয়ের কুসুম-কোরক প্রায়,
পড়িবে ঝরিয়া তাহা অকালে শুকাবে হায়!
নাহি জানি সেই দিন বহিব এ দুঃখ-ভার;
দহিবেক সদা হৃদি হইবেক ছারখার!
হইবে যে এ জীবন শুষ্ক মরু সাহারার!
যাইবে সকল সাধ রবে শুধু হাহাকার!
জানি না তখন আমি জীবন বিষাদময়;
এত দুঃখ কাতরতা তাহাতে ভরিয়া রয়।
রহিবে অনল-রাশি ভস্ম-বিলেপিত কায়,
দহিবে সে অবিরত এ সারা জীবন হায়!
শুভ বিবাহের দিন উল্লাসে আকুল প্রাণ,
নাহি জানি কোন দুঃখ সদা সুখ এই জ্ঞান।
নাহি জানি সংসারের দুঃখ জ্বালা অনুভব;
মধুর এ ধরাতল মধুর হেরিনু সব।
নব প্রাণে নব আশা করিলাম সংস্থাপন;
বিবাহ উৎসবে মগ্ন হইল যে মম মন॥
নাহি জানি বিবাহের শুভাশুভ পরিণাম;
নাহি জানিতাম মনে বিধি মোরে হবে বাম।
জানিতাম রব সুখে সমভাবে চিরদিন;
রহিব ফুটিয়া সদা হব না কভু মলিন।
রাখিতাম হৃদয়েতে কত প্রেম কত আশা;
সমগ্র হৃদয় ভরি অফুরন্ত ভালবাসা।
বাসিতাম ভাল আমি প্রাণ ভরি সেই ক্ষণে,
নিবেদিনু প্রাণ মন প্রাণেশের সে চরণে।
অতীতের সুখ স্মৃতি জাগে মনে পুনর্ব্বর;—
ফুলময় সেই বেশ গলদেশে ফুলহার।
চন্দনচর্চ্চিত ভালে মাথায় শোভে টোপর;
গলে দোলে ফুলমালা পরিধান রক্তাম্বর।
প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া হ’য়ে স্থির,
অচঞ্চল আঁখি তারা অবনত করি শির।
করিতেছে হুলুধ্বনি যত পুরনারীগণ;
হইতেছে শঙ্খরব ভেদিত করি গগন।
ঘোষিতেছে শুভ বার্ত্তা-ধ্বনি দিক্ দিগন্তর,
মুখরিয়া অট্টালিকা উঠিতেছে সেই স্বর।
বিজয়ের পাঞ্চজন্য যেন বাজে এ সময়,
অধিকার করিবারে বালিকার সে হৃদয়।
শোভিতেছে চন্দ্রাতপ করিতেছে ঝলমল,
শত শত আলোকেতে করিছে পুরী উজ্জ্বল
বাজিছে সাহানা সুরে নহবৎ আঙ্গিনায়,
সে সুর বাজিল তবে মম এ হৃদি-বীণায়।
কহিতেছে রামাগণ আহা কি সুন্দর বর,
মিলিয়াছে মনোমত রূপে গুণে মনোহর।
কত জন্ম জন্মান্তর পূজিয়া ভবানীপতি,
সাধনার এই ধন লভিয়াছে আজি জ্যোতি।
নবীন কৈশোের রূপ বদনে মধুর হাসি,
গগন ত্যজিয়া যেন ভূতলে উদয় শশী।
করে তবে স্ত্রী-আচার যত পুরবালাগণ,
হুলাহুলি শঙ্খ-ধ্বনি করিতেছে ঘন ঘন।
বাজিল মঙ্গল বাদ্য গাইল মঙ্গল গীত,
ঘোযিল মঙ্গল রোল করি দিক্ মুখরিত।
বাজিল সাহানা সুরে নহবৎ পুনরায়;
ক’নে আন বলে সবে সময় বহিয়া যায়।
আইলাম তব পাশে প্রীতি-প্রফুল্লিত মনে,
আনমিত রহে আঁখি বদন ঢাকি বসনে।
ঝাঁপিল সে রক্তাম্বর ঢাকিয়া মোদের কায়;
শুভক্ষণে দেখ দেখি কহে সব মহিলায়।
তখন হইল সেই চারি চোখে সম্মিলন;
কি শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে হেরিলাম সে বদন।
মরি কি ললিত রূপ কমনীয় মনোহর!
ভুলিলাম মজিলাম সঁপিলাম এ অন্তর।
বালিকা সরলমতি নাহি সরমের দায়;
গোপন চাতুরি ছলা নাহি ছিল এ হিয়ায়।
কমনীয় বরবপু চিত্ত-উন্মাদনকর,
হেরিলাম অনিমেষে সেই রূপ মনোহর।
না পড়ে পলক আঁখি নাহি রহে বাহ্য জ্ঞান;
হারাইয়া আপনারে বিকাইনু মন প্রাণ।
তুমিও মধুর হাসি হাসি তবে প্রাণময়!
চেয়েছিলে মুখপানে ঢালি প্রীতি সমুদয়।
প্রেম অনুরাগ ভরে চাহিলে যে প্রাণাধার!
করিল সে আঁখি দুটি এ হৃদয় অধিকার।
শত আকাঙ্ক্ষার ছবি ফুটে ছিল বদনেতে।
প্রণয়ের স্রোত যেন উছলিল নয়নেতে।
হৃদয়েতে ভরা ছিল প্রীতি প্রেম ভালবাসা—
চাহিলে আমার পানে লয়ে প্রাণে কত আশা।
ভাসিনু হরষে আমি লভি সেই প্রতিদান।
হৃদয়ের বিনিময় করিনু হৃদয় দান।
মানস দর্পণে হ’ল প্রতিবিম্ব প্রতিভাত।
সেইরূপ আজ মনে জাগিতেছে দিবারাত।
সুমধুর মধুনিশি চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত।
কলকণ্ঠে গাহে পিক্ করি দিক্ মুখরিত।
বহিল যে মৃদু মৃদু মধুর দখিণা বায়।
ফুটি’ রহে নানা জাতি সুরভি কুসুমচয়।
পুলকে পূর্ণিত প্রাণ হইল যে দোঁহাকার।
নয়ন নীরব ভাষা প্রকাশিল অনিবার।
নয়নে নয়নে হ’ল এ হৃদয় বিনিময়।
কত প্রেম ভালবাসা সে নয়নে ভরি রয়।
অধরে মধুর হাসি করিতেছে সুধা তায়।
কুন্দ পুষ্প দর্শনেতে রক্ত রাগ আভাময়।
হইয়া আপনা হারা হেরিলাম সে বদন।
সঁপিনু প্রাণেশ করে চির তরে এ জীবন।
ভাসিলাম সুখনীরে আনন্দে উৎফুল্ল কায়।
ভাসি আজি দুঃখনীরে করিতেছি হায় হায়!
বাঁধিল সুদৃঢ় করি পবিত্র দাম্পত্য ডোর।
প্রণয় প্রেমের ফাঁসি হইল জীবনে মোর।
কোথা সেই হৃদয়েতে আনন্দ ভরা উচ্ছ্বাস?
হৃদয়েতে ভরা এবে রহে সদা শোকোচ্ছ্বাস!
কোথা সেই সুখ সাধে পুলকে পূরিত প্রাণ?
কোথা হায় হৃদয়েতে শত আশা গাহে গান?
কোথা সেই নয়নেতে নব রাগ বিকশিত—
অনুরাগে রহিত যে লাজ-ভরে আনমিত?
কোথা সেই জীবনের চিরস্মরণীয় ক্ষণ?
পরিলাম জীবনেতে এ দৃঢ় চির বন্ধন।
দিবানিশি ঝরে হায় নয়নেতে অশ্রুজল!
নিরাশার বিদ্রূপেতে দহে প্রাণ অবিরল—
হইয়াছে এ জীবন নাথ বিনা অন্ধকার।
তাপিত এ প্রাণে সদা উঠিতেছে হাহাকার।
কোথা সেই বিবাহের শুভ সে মঙ্গল গীত।
মাঙ্গলিক শুভকার্য্য যাহা আছে প্রচলিত।
অমঙ্গল অশুভের করি সদা আয়োজন—
অমঙ্গল সাধিবারে যাপিতেছি এ জীবন।
অমঙ্গল হেতু নাথ! হইলাম তব আমি—
হারাইনু অভাগিনী আরাধ্য-দেবতা স্বামী!
শত সাধনার ধন বাঞ্ছনীয় সে রতন—
নারিলাম রাখিবারে বৃথা মম এ জীবন।
জ্বলে প্রাণ দিবাদিশি হৃদয় জ্বলিয়া যায়—
দহিতেছে মন মম—দহিতেছে সদা কায়।
সহিতেছি যে যাতনা কহিব কাহারে হায়!
নিবেদিব নীরবেতে কাতরেতে বিভু-পায়।