মালা/অনুরাগ
অনুরাগ।
মনে পড়ে সেই দিন প্রথম তোমার
হেরিলাম আমি নাথ মোহন মূরতি।
জানিনাক কারে বলে প্রেমের ব্যাপার,
তখন বালিকা আমি সুকোমলমতি।
সবিস্ময়ে অনিমেষে চাহি মুখপানে,
ভাবিলাম যেন কোন দেবের কুমার।
ঈশ্বর গড়েছে ইহা কোন্ উপাদানে?
হয়নি তখন মনে প্রণয়সঞ্চার।
জানিনাক কারে বলে প্রেমের বন্ধন;
পবিত্র দাম্পত্য বিধি হয় নাই জ্ঞান।
বালিকা তখন আমি খেলাতে মগন,
জানিনা কাহারে বলে দান প্রতিদান।
জানিনাক বিধাতার এ ঘোর চাতুরি,
জানিনা কাহারে বলে হারাণ হৃদয়।
জানিনা তখন কোন কাজ লুকোচুরি,
তথাপি অজ্ঞাতে হ’ল প্রাণ বিনিময়!
ভাবিলাম পরমেশ নিজ করে করি,
সযতনে লয়ে বুঝি উপাদান যত;
প্রকাশিতে শিল্প নিজ করি কারিকুরি,
গড়েছেন তোমারে যে করি মনোমত।
হেরিনু হইয়া আমি হরষে বিহ্বল,
রহিলাম স্থির ভাবে পুতুলের প্রায়।
না হ’ল তখন মম নয়ন চঞ্চল;
অনিমিষে হেরিলাম সাধ যত যায়।
কি হেরিনু কি সুন্দর সে রূপ ললিত!
কি হেরিনু অপরূপ সৃষ্টি বিধাতার!
বালিকা-কোমল-মন হ’ল বিগলিত,
ফেলি পলক আঁখি চাহি অনিবার।
তুমিও সতৃষ্ণনেত্রে মোর মুখ পানে,
চেয়ে ছিলে স্নেহ-ভরে হে সরলমতি!
মিলিল যে দোহাকার নয়নে নয়নে,
সে চাহনি আজো মনে পড়ে দিবারাতি।
বালিকা সরলমতি তথাপি আমার
হইল সে আঁখি হেরি আকুল এ মন!
কি যে কি সে মোহশক্তি নয়নে তোমার!
জানিনা কি শর প্রাণে বিঁধিল তখন।
ফিরাইতে নারি আঁখি আর কোনমতে,
আসিতে চাহেনা ফিরে আর যে চরণ।
ভাবিলাম হেন রূপ নাহিক জগতে;
অপূর্ব্ব এ দেবমূর্তি বিধির গঠন।
মনে পড়ে সেই রূপ প্রতি পালে মোর;
মনে পড়ে সেই তব সরল চাহনি।
পড়ে মনে সেই রূপ নবীন কৈশোর,
অস্ফুট মুকুল সম সেই মুখখানি।
ছিল না তখন মনে এ প্রেম-পিপাসা,
ছিল না তখন মনে প্রণয়ের জ্বালা।
তথাপি আসিল যে গো প্রাণে ভালবাসা,
বাসিলাম ভাল আমি বালিকা সরলা।
কি জানি কি ক্ষণে সেই প্রথম মিলন!
কি জানি কি ক্ষণে আমি হেরিনু তোমায়!
আজো মনে পড়ে সদা সেই শুভক্ষণ।
সে বাল্য প্রণয়-স্মৃতি অতি মধুময়।
নবীন হৃদয়-ভূমি না ছিল খনন;
হইল যে ভালবাসা-বীজ অঙ্কুরিত।
আমার হৃদয়-ক্ষেত্রে করিলে বপন,
করিলে যে তুমি নাথ সে ভূমি কর্ষিত।
শরৎ সে শুভ কাল, সারদীয়া পাশে,
তোমারে নিরখি আমি সেই শুভ ক্ষণে।
এসেছিনু পিতা সনে মনের উল্লাসে,
প্রণাম করিতে দশভূজার চরণে॥
স্নেহময় জনকের স্নেহ-তরুতলে,
রাখিতেন সদা মোরে আদরে সাজায়ে।
হরিতাম সুখে দিন জননীর কোলে,
আজো মনে সুখ পাই সে দিন স্মরিয়ে।
সাজিয়া পিতার সনে বালকের বেশে,
ফিরিলাম নানা স্থানে সারি নিমন্ত্রণ—
আসিনু হেথায় আমি ঘুরি অবশেষে,
পরিবারে জীবনেতে এ চির বন্ধন।
হেরিলাম দশভুজা বরাভয় করে,
বিরাজিতা র’য়েছেন রম্য হর্ম্মোপর।
পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করে উচ্চৈঃস্বরে,
সবে তথা দাঁড়াইয়া রহে যুড়ি কর।
বসি তথা একমনে স্তিমিত নয়নে,
বসিয়াছিলেন ধীর প্রশান্ত মূরতি।
রাজচক্রবর্ত্তী পিতা বিদিত ভুবনে,
ধ্যানমগ্ন র’য়েছেন হৃদয়ে ভকতি।
ক্ষণপরে চাহিলেন, বিশাল নয়ন
স্নেহভরে মম প্রতি উত্তোলন করি,
করিলেন মোর প্রতি স্নেহ সম্ভাষণ,
বসালেন পিতৃদেব জানুর উপরি।
বলিলেন “এস এস মা লক্ষ্মী আমার!
হবে মম পুত্রবধূ আদরে গৃহীতা।
শুধাইব কিবা ইচ্ছা পিতারে তোমার,
অমূল্য ভূষণে তোরে করিব ভূষিতা।
বড় সাধ হ’ল মাগো হেরিয়া তোমারে;
মনের বাসনা যত উঠিল জাগিয়া।
পুত্রবধূ করি তোরে আনিব মা ঘরে,
পুত্র সনে করি তোর পরিণয়-ক্রিয়া।
দেখ চেয়ে ওমা ফিরে দেখ তব বর;
মনোমত হ’ল কিনা বল গো মা শুনি।
শোভিত করিবে তুমি আসি মম ঘর,
আশীর্ব্বাদ করি তুমি হও রাজরাণী।”
মম পিতা কহিলেন “বাড়িল যে বেলা;
গৃহে কিরিবার কাল বহিয়া যে যায়।
নবনীত দেহে দুঃখ পাবে মম বালা,
আসিয়া কহিব কথা আমি পুনরায়।”
কহিলেন বাধা দিয়া শ্বশ্রূদেব মম;
“হয়নি কি মনোমত তনয়ে আমার?
কেন বা যাইতে চাই সোদরপ্রতিম?
বিবাহ নাহি কি দিবে তব তনয়ার?”
শুনিয়া এ বাণী পিতা কহিলেন হাসি—
“একি কথা মহারাজ! ইহা কি সম্ভব?
মনোমত ধন এই নিষ্কলঙ্ক শশী—
হইবে কুমার সহ বিবাহ উৎসব।
মিলিয়াছে নাম সহ দেখি শিষ্টাচার,
বিনয় সুনম্র ধীর সুবোধ বালক।
রূপে গুণে কুলে শীলে ভূষিত কুমার,
হইবে এ রাজকুল-ললাটে তিলক।
বড় আদরের মম স্নেহের কলিকা
হৃদি বৃন্তে ফুটিয়াছে আলোকিত ক’রে;
ইহারে অর্পিব মম স্নেহের বালিকা
বরিব জামাতৃ-পদে ইহারে সাদরে।
হেরিয়াছি কত শত বালক কৈশোর,
হেরিয়াছি যুবা বৃদ্ধ কত বা না জানি।
ইহারে হেরিয়া মন দ্রবীভূত মোর,
নেহারিয়া কুমারের সরল চাহনি।
মানস উদ্যানে মম ফুটিয়াছে ফুল,
সুসৌরভ বিতরিছে ভবনে আমার;
মিলালেন বিধি আজি তার সমতুল,
এ তরু-তমালে শোভা হবে লতিকার।
এক বৃন্তে দুটি ফুল ফুটিবে যখন,
মন্দার কুসুম সম ছুটিবে সৌরভ।
স্বর্গীয় বন্ধনে বদ্ধ হবে দুই জন,
মরতে অমরাপুরী হবে অনুভব।
জীবন-খনিতে মোর তনয়া রতন,
করিতেছে আলোকিত সমুজ্জ্বলভাবে।
মিলিবে তখন হ’তে যুগল রতন,
এক গ্রন্থি দুটি মণি গ্রথিত করিবে।”
হাসিয়া কহেন তবে শ্বশ্রূদেব মম—
“করে ধরি লয়ে যাও,অন্দরমহলে।”
লাজভরে মম হাত ধরি প্রিয়তম!
পিতৃ আজ্ঞা শিরে ধরি আনন্দে চলিলে।
হেরিলাম অন্তঃপুরে পুরবালাগণ,
আমা দোঁহাকারে হেরি হুলাহুলি করে।
সবে বলে—দেখি ক’নে হয়েছে কেমন,
বসাইয়া দিল মোরে তব অঙ্কোপরে।
রজত-আধারে রহি সে অমৃতাধার,
মনোরঞ্জনের রূপে সে মনোরঞ্জন,
কি মনোরঞ্জন তবে করি দোঁহাকার
করিল সে সুধা চির পবিত্র জীবন।
তাম্বুল লইয়া করে কহে সব নারী—
কর সবে সমাদরে ইহা বিনিময়।
মনোহরা হরিয়াছে মন দুজনারি,
রঞ্জিত তাম্বুল রাগে কর ওষ্ঠদ্বয়।
কি জানি কি শুভক্ষণে সে অমৃত সহ,
লইনু অমৃতস্বাদ ৩ জনম লাগি।
এখন অনল প্রাণে জ্বলে অহরহ,
আদরিণী হইয়াছে দুঃখিনী অভাগী।
গৃহে ফিরি পিতাসনে, হারাইয়া মন,
বিকাইয়া এ হৃদয় নিকটে তোমার;
অজ্ঞাতে তোমার করে সঁপিয়া জীবন,
শূন্য হৃদি লয়ে গৃহে ফিরি পুনর্ব্বার।
সর্ব্বদাই উড়ু উড়ু করে যেন মন;
খেলা ধূলা হাসি ভাল নাহি লাগে মনে।
সদাই অন্বেষি যেন চমকিত মন,
যেন কি অভীষ্ট-দ্রব্য মনোমত ধনে।
খেলিবার সাথী যেন এসেছি ছাড়িয়া,
নাহি হয় খেলা শেষ সে সাথী বিহনে।
আহারে বিহারে মুখ না পাই খুঁজিয়া,
না হয় সুস্থির চিত্ত রহি আন্মনে।
বালিকা কোমলমতি তবু কেন হায়,
ব্যাকুলিত তব লাগি দিবানিশি মন?
তোমারে হেরিতে যেন সদা আঁখি চায়,
তোমার বিহনে যেন নীরস জীবন।
প্রজাপতি একি খেলা খেলেন নীরবে!—
কোমল হৃদয় বিদ্ধ করি তার শরে,
নাহি জানে কোন জ্বালা যেই বালা ভবে,
তাহারে বধেন তিনি সে শর প্রহারে।
কি মধুর সুখময় সে পবিত্র স্মৃতি!
সেই বাল্যসুখস্মৃতি অজানা প্রণয়!
যে অনলে দগ্ধ এবে হই দিবারাতি,
সে স্মৃতি স্মরণে কিছু প্রশমিত হয়।
নাহি জানিতাম মনে ভাঙ্গিবে কপাল—
নাহি জানিতাম মনে হারাব এ নিধি—
জীবনের সঙ্গী মম হরিয়াছে কাল,
হায়রে দারুণ বিধি! একি তব বিধি?