জীবন-তরী।

ভাসিছে জীবন-তরী অকূল দুঃখ-সাগরে।
কি জানি কবে বা তাহা যাইবে সে পরপারে।
নাহি কূল নাহি সীমা নাহি আর পারাপার।
নাহি হেরি বেলাভূমি দুস্তর এ পারাবার॥
অসীম অনন্তে ইহা ধূ ধূ করে চারিধার।
ভাঙ্গা তরী ভাসে তাহে নাহি হেরি কূল তার
উত্তাল তরঙ্গ করে দেহতরী আন্দোলিত।
ঘূর্ণাবর্ত্তে করিতেছে এ হৃদয় আকুলিত॥
ভীষণ শোকের ঝড় বহিতেছে নিশিদিন।
শোকাচ্ছন্ন জীর্ণতরী রহে সদা শীর্ণ ক্ষীণ॥
নাহিক বাহিতে শক্তি প্রবল তরঙ্গে আর।
জীর্ণ শীর্ণ তরী বুঝি হইবেক চুরমার॥
অনন্ত এ দুঃখ রাশি বিস্তৃত জীবনময়।
জলধি বিস্তৃত যথা ব্যাপে দিক্ সমুদয়॥
সুবিশাল এ জলধি নাহিক ইহার কূল।
দুঃখের কল্লোলে প্রাণ সতত করে আকুল॥
প্রবল বন্যার স্রোত নয়নেতে বারি বয়।
গরজিছে ভীমরবে দুঃখ-ঝঞ্ঝা অতিশয়॥


দুঃখ-কুজ‍্ঝটিকা রহে ব্যাপি দিক্‌ দিগন্তর।
জীবন-তরণী তাহে ভাসিতেছে নিরন্তর॥
প্রাণপণে বহিতেছে যাইতে সে পরপার।
উন্মত্ত তরঙ্গ আসি রোধিতেছে গতি তার॥
বাহুতে নাহিক শক্তি হৃদয়ে নাহিক বল।
প্রতিকূল বায়ু বাধা দিতেছে যে অবিরল॥
দিক্‌-দরশন যন্ত্র হারায়েছে তরণীর।
কর্ণধার নাহি তাহে কিসে তরী রবে স্থির?
ছিঁড়িয়াছে সুখ-পাল ডুবিয়াছে দাঁড়ি সব।
গেছে সাধ গেছে আশা উঠিয়াছে হাহারব॥
খাইতেছে ঘূর্ণপাক অকূল জলধি মাঝে।
কি জানি কখন সে যে ধাইবে কোন্ বা সাজে
ভীষণ কালের ঝড়ে ভাঙ্গিয়াছে হাল তার।
এ দুঃখ-তুফানে সদা করিতেছে হাহাকার॥
চলেছিল প্রভাতের সুমন্দ মলয় ভরে।
আনন্দেতে চলেছিল কোন সে সুখ নগরে॥
সুখ-সাগরের মাঝে মধ্যাহ্নেতে উপনীত।
সুখেতে বহিল তাহা সুখ-স্রোতে প্রবাহিত।
সায়াহ্নে প্রবল ঝড় আসি হায় অকস্মাৎ।
ভাসাইল দুঃখনীরে ভীমবেগে ঝঞ্চাবাত।৷


কত কাল চলিবে যে যাইতে সে পারে আর।
কবে কোন্ শুভক্ষণে মিলিবে সে কর্ণধার॥
জীবনের পরপারে আছে সেই মহাদেশ।
চলিবে জীবন-তরী করি এই দুঃখ শেষ॥
প্রশান্ত সাগর সেই দুঃখ-বাত্যা নাহি বয়।
না আছে বিরহ দুঃখ সতত মিলনে রয়॥
সুমন্দ আনন্দ বায়ু বহে তথা অনুকূল।
সুখ-পাল-ভরে চলে হরষে হ’য়ে আকুল।
নাহি দুঃখ-কুজ্ঝটিকা নাহি তথা ঝঞ্ঝাবাত।
নহে শোক-সমাচ্ছন্ন না হয় অশনিপাত।
বহিতেছে দিবানিশি তথা সুখ-সমীরণ।
প্রবল বন্যার ন্যায় নাহিক ঝরে নয়ন॥
নাহি সদা দুঃখাবর্ত্ত সদা সুখে ভাসমান।
ভাসিবে আনন্দ নীরে করি দুঃখ সমাধান॥
আছে সেই শান্তি-স্থান বহু দূরে সন্নিবেশ।
পথে বাধা বিঘ্ন শত যাইতে সে মহাদেশ।
সেই শান্তি-মহাদেশে গিয়া শান্তি-নিকেতন।
হেরিব সে শান্তিময়ে যে শান্তি চাহে জীবন॥
শান্তি-রাজ্যে শান্তি-সুখে রহিয়াছে প্রাণময়।
শান্ত সৌম্য মূর্ত্তি হেরি জুড়াইব এ হৃদয়।৷


চির-শান্তিনিকেতনে রব সুখে চিরদিন।
রব সুখে হরষিত দুঃখে না হব মলিন॥
ভগ্ন তরী গড়া হবে দিয়া নব উপাদান।
আশা প্রেম ভালবাসা সকলি পাইবে স্থান॥
জীবন-তরীতে মোর কর্ণধার প্রিয়তম।
মিলিয়া নাথের সহ বাহিব এ তরী মম॥
ভিড়াইব এই তরী নাথের চরণ তলে।
ভেসেছিল যাহা এই দুঃখের জলধিজলে॥
নঙ্গর করিয়া রব সদা সে চরণোপর।
ছাড়িব না দুঃখ-স্রোতে রব যুগ যুগান্তর॥
মনোমত কর্ণধার জীবন-তরীতে গতি।
আরাধ্য দেবতা স্বামী পূজনীয় প্রাণপতি।৷