বাসনা ত্যাগ।

ত্যজিয়াছি সংসারের সকল বাসনা।
মায়া মোহ আশা তৃষা প্রণয় কামনা॥
ভুলিয়াছি জীবনের সুখ সাধ যত।
গিয়াছে সকলি চলি এ জনম মত॥
প্রেম প্রীতি ভালবাসা কিছু নাহি আর।
এ হৃদয় মরুভূমি সমান আমার॥
এ জীবন আজীবন নিরাশা-অনলে।
সতত হইবে দগ্ধ প্রতি পলে পলে॥
পরিয়াছি শ্বেতবাস শাঁখাশূন্য কর।
ধরেছি বৈধব্য-ব্রত করিয়া কঠোর॥
করিয়াছি বিদূরিত চিকুর চাঁচর।
তাম্বুলে রঞ্জিত নাহি হয় ওষ্ঠাধর॥
সুরভী চন্দন অঙ্গে না করি লেপন।
কুসুমের সুবাসেতে তৃপ্ত নহে মন॥
সহিতেছি এত দুঃখ যাহার কারণে।
সে কভু ভ্রমেও ভুলে ভাবেনাক মনে॥
জ্বলিতেছি যার লাগি এই অনলেতে।
এখন আমারে তার নাহিক মনেতে।৷


যাহারে না হেরি দহে বিষাদে হৃদয়।
এখন হয়েছে সে যে নিঠুর নির্দ্দয়॥
যার অদর্শনে মন সতত ব্যাকুল।
দুঃখের সাগরে ভাসি নাহি তার কূল॥
দিবানিশী যাতনার প্রবল পবন।
আন্দোলিত আকুলি করে মোর মন॥
ঝরে আঁখি নিশীদিন অবিরল ধারে।
প্রবল সে বন্যা-স্রোত কেবা রোধে তারে?
শূন্য প্রাণে ফিরি সদা হাহাকার করি।
অবিরত ডাকি তারে দিবা বিভাবরী॥
কোথা নাথ কোথা নাথ ডাকি অনিবার।
তাপিত এ প্রাণে শান্তি নাহিক আমার॥
যাহার সান্ত্বনা বাণী শুনিলে শ্রবণে।
সুশীতল হইতাম তাপদগ্ধ প্রাণে॥
করেনা এখন মোরে আশ্বাস প্রদান।
হইয়াছে হৃদি তার পাষাণ সমান॥
পাষাণে গঠিত হৃদি করিয়া এখন।
ভুলিয়াছে দুঃখিনীরে জনমমতন।৷
কভু ভাবি দিব মন ঈশ্বর-চরণে।
ভুলিবনা আর সেই মোহ প্রলোভনে।৷


ভক্তিভরে ভগবানে করি আরাধনা।
প্রশমিত হবে ভাবি হৃদয়-যাতনা॥
অনাহারে অনিদ্রায় দেহ করি ক্ষয়।
ঈশ্বরে সেবিতে প্রাণ দিব সমুদয়॥
জগৎ-নাথের পদে সমর্পিয়ে মন।
তপস্বিনী ভাবে আমি যাপিব জীবন॥
কিন্তু হায় এ বাসনা নাহি লয় মনে।
উৎসর্গ করেছি প্রাণ নাথের চরণে॥
নিবেদিত বস্তু লয়ে কিরূপে এখন।
পুনরায় বিলুপদে করি সমর্পণ?
নাহি হবে এ বাসনা পূরণ আমার।
নাহি হবে মোহ দূর এ জনমে আর॥
নাহি প্রাণ চাহে কভু ভজিতে ঈশ্বরে।
সতত কাতর প্রাণে ডাকি প্রাণেশ্বরে॥
কাঁদিতেছি দিবানিশী যাহার লাগিয়া।
সে নাম স্মরণে চিত্ত উঠে উথলিয়া॥
কাটিতেছে দিবানিশী দারুণ সন্তাপে।
সে নাম স্মরিবামাত্র এ হৃদয় কাঁপে॥
কাঁপিতে কাঁপিতে করি সে নাম স্মরণ
প্রতি পলে করি আমি অশ্রু বরিষণ।৷


কখন সে নাম স্মরি পুলকে শিহরি।
কভু বা উন্মত্ত ভাবে হাহাকার করি॥
কত সুখ কত দুঃখ ওই নামে রয়।
কত যে গরলভরা-কত সুধাময়॥
কতবার ধীরে ধীরে করি উচ্চারণ।
কখন বা উচ্চৈঃস্বরে করি যে ক্রন্দন॥
কভু বহে দীর্ঘশ্বাস সে নাম স্মরণে।
কভু বা উল্লাসে হাসি হরষিত মনে॥
কতই আনন্দ আর কত নিরানন্দ।
কত সুখ কত দুঃখ বিধির নির্ব্বন্ধ।
যার জন্য জ্বলে প্রাণ সদা কেন হায়!
উন্মত্ত হৃদয় কেন তারে সদা চায়?
সতত জ্বলিছে বহ্নি না হয় নির্ব্বাণ।
তথাপি তাহার কাছে ধাইতেছে প্রাণ॥
কেন রে উন্মাদ মন কেন এ বাসনা?
যে তোমারে ভুলিয়াছে ভুলিতে পার না?
হায় রে উন্মত্ত মন একি মোহ তোর?
এ জনমে পারিবে না ত্যজিতে এ ঘোর॥
আয় স্মৃতি রাখি তোরে হৃদয়ে যতনে।
স্মরিব এ স্মৃতি আমি জীবনে মরণে।৷


এ জীবনে সেই স্মৃতি ভুলিবার নয়।
রহিবে সে চিরদিন ভরিয়া হৃদয়॥
করিয়া সংযত চিত্ত হয়ে একমন।
দিবানিশী সেই দেব করিব ভজন॥
তপস্বিনী সাজি রব তার আরাধনে।
সন্ন্যাসিনী হইয়াছি যাহার বিহনে॥
করিব কঠোর তপ যাবত জীবন।
লভিবারে মম সেই বাঞ্ছিত চরণ॥
সেই নাম মূল মন্ত্র হইবে আমার।
সে রূপ স্মরণে ধ্যানে রব অনিবার॥
বিভূতি করিব অঙ্গে সেই সুধা হাসি।
জটাজাল হবে মম প্রণয়ের ফাঁসি॥
কমণ্ডলু পূতবারি নয়নের নীরে।
করিয়া পূজিব আমি মম প্রাণেশ্বরে॥
মৃগচর্ম্ম সমাসীন নিরাশা আসনে।
গালবাদ্য হাহারব করুণ রোদনে॥
আহার্য্য যে হবে মম সেই নাম-সুধা।
প্রণয় পীযূষ পানে নিবারিব ক্ষুধা॥
লইয়াছি প্রেম-ব্রত প্রেমের সাধনা।
প্রেমময়ে লভিবারে এ প্রেম-কামনা।৷


প্রেমের তপস্যা করি এ সারা জীবন।
প্রাণনাথে আরাধিব করি প্রাণপণ।
প্রেম-ধামে বিচরিব প্রেম-ভিখারিণী।
প্রেমে তার মগ্ন রব দিবস রজনী।৷
প্রেমের তপস্যা সদা করি কায়মনে।
জন্মান্তরে লভিবারে সে অভীষ্ট ধনে॥
সাধনার ধন সেই আরাধ্য দেবতা।
লভিবারে এ সাধনা, এ ঘোর ব্যগ্রতা
জন্মজন্মান্তরে যেন সেই গুণনিধি।
মিলান এ দুঃখিনীরে দয়াময় বিধি।৷