মা/দ্বিতীয় খণ্ড/আঠারো

—আঠারো—

 পরদিন জানা গেল, আইভানোভিচ ধরা পড়েছে। ডাক্তার আইভানও এসে পড়লো কিছুকালের মধ্যে। বললো, মা, তুমি এখানে? তোমাকেও খুঁজছিল। আইভানোভিচ আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলো।

 তাতে বিপদ কাটানো যাবেনা, মা। সে যাক। জনকয়েক ছেলে কাল পেভেলের বক্তৃতাটা হেক্‌টোগ্রাফে পাঁচশ কপি ছাপিয়েছে···শহরে ছড়াতে চেয়েছিল। আমি তার বিরুদ্ধে—ছাপানো কপি শহরে ছড়ানো ভালো···এগুলো অন্যত্র পাঠানো যাবে।

 মা সোৎসাহে বললেন, আমায় দাও, আমি ন্যাটাশাকে দিয়ে আসছি।

 ডাক্তার বললেন, এখন তোমার একাজ করতে যাওয়া ভালো হবে কিনা জানিনে। এখন বারোটা, দুটো পাঁচে গাড়ি। পৌঁছাবে পাঁচটা পনেরোয়—সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছবে, দেরি তেমন হবে না। কিন্তু কথা তা নয়।

 কথাটা কি? কাজটা ভালোভাবে হাঁসিল করা, এই তো! তা আমি পারবো।

 লিউদ্‌মিলা বললো, কিন্তু তোমার পক্ষে এ বিপজ্জনক।

 কেন?

 ডাক্তার বললেন, কারণ হচ্ছে এই—আইভানোভিচ ধরা পড়ার এক ঘণ্টা আগে তুমি উধাও হয়েছো; তারপর মিলে তুমিও গেলে আর ইস্তাহারের আবির্ভাব হলো।···

 মা জেদ ক’রে বললেন, না আমি যাবো। ফিরে এলে যখন ধরতে আসবে, তখন একটা-কিছু ব’লে তাদের ফেরাতে পারব।

 ডাক্তার বললেন, বেশ তাই হ’ক। স্টেশনে বসে ইস্তাহার পাবে।

 ডাক্তার চ’লে যেতে লিউদ্‌মিলা বললেন, চমৎকার তুমি, মা। আমারও এক ছেলে আছে তেরো বছর তার বয়স, কিন্তু সে আজ থেকেও নেই। তার বাপ··· আমার স্বামী সহকারী সরকারি উকিল। হয়তো এদ্দিনে সবকাবী উকিল হ’য়ে গেছেন। ছেলে তার সঙ্গে। ছেলে কেমন হ’বে সময় সময় ভাবি।···যাদের আমি সেরা মানুষ ব’লে মনে করি তাঁদের শত্রু যে, তার হাতে পড়েছে আমার ছেলে। আমার কাছে থাকতে পারছে না! আমি আছি এক ছদ্মনামে। আট বছর তাকে দেখিনা, আট বছর···

 ধীরে ধীরে জানালার কাছে যেয়ে বাইরে ম্লান আকাশের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, সে যদি আমার সঙ্গে থাকতো, কত জোর পেতাম আমি। বুকে সর্বক্ষণ এই ব্যথাটা লেগে থাকতোনা।···এর চেয়ে যদি মরতোও সে, আমার পক্ষে তাও সওয়া ববঞ্চ সহজ হ’তো। জানতাম সে মৃত, কিন্তু শত্রু নয়। মাতৃস্নেহের চাইতেও যা মহৎ, যা প্রিয়তর, যা বেশি দরকার সেই ব্রতেব শত্রু নয়।

 আহা মা···ব’লে মা লিউদ্‌মিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

 লিউদ্‌মিলা তেমনি তদ্গতভাবে বললো, হাঁ, তুমি সুখী, মা তুমি সুখী। কী মহান দৃশ্য— মা আর ছেলে একসাথে, পাশাপাশি···এ খুব কম মেলে।

 মা যেন নিজের অজ্ঞাতে বলে ফেলেন, হাঁ, মা, এত সুন্দর···অভিনব··· এ যেন এক নবীন জীবন। তোমরা সবাই সত্যপথের যাত্রীদল পাশাপাশি চলেছো···যাদের আগে দেখিনি, তারা হঠাৎ যেন পরম আত্মীয় হ’য়ে গেছো। সব কথা আমি বুঝি না, কিন্তু এটা বুঝি, মা···বুঝি ছেলেরা দুনিয়ার পথ বেয়ে এগোচ্ছে সকলে একটি লক্ষ্যের দিকে···সমস্ত অন্যায়কে পায়ে দলে, সমস্ত অন্ধকারকে দূরীভূত ক’রে, সমস্ত তত্ত্বকে আয়ত্ত ক’রে, সমস্ত মানুষের পক্ষ নিয়ে···তারা এগিয়ে চলেছে। তরুণ তারা, শক্তিমান তারা, তাদের অদম্য শক্তি নিয়োজিত হচ্ছে, এক উদ্দেশ্য সাধনে, সে হচ্ছে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। মানুষের সকল দুঃখকে তারা জয় করতে চলেছে। পৃথিবীর বুক হতে দুঃখকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য তারা অস্ত্রধারণ করছে, যা-কিছু বীভৎস তা দমন করতে বেরিয়েছে তারা,— দমন করবে। একজন বলেছিল আমায়, আমরা এক নতুন সূর্য প্রজ্বালিত কববো— হাঁ, তারা তা করবে। সমস্ত জীবনকে একপ্রাণে গাঁথবে তারা, সমস্ত ছিন্ন হৃদয়কে একত্র সম্মিলিত করবে তারা। জীবনকে শুদ্ধ, পবিত্র, উজ্জ্বল করবে তারা।···

 ভাবে তন্ময় হ’য়ে মা আকাশের দিয়ে আঙুল তুলে বললেন, ঐ সেই সূর্য—গৌরবময় স্বর্ণ-সুষমাদীপ্ত মানুষের সুখ-সূর্য। সমস্ত ভুবনকে চিরকালের জন্য উজ্জ্বল ক’রে রাখবে এ··· পৃথিবীর সবাই, সমস্তখানি দীপ্ত হ’বে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমে বিশ্বের সমস্ত-কিছুর ওপর মানুষের প্রীতিতে।···এই সত্য এবং যুক্তি-পন্থীরা সকলের কাছে ব’য়ে নিয়ে যাবে প্রেমের আলোক। সমগ্র দুনিয়াকে ছেয়ে ফেলবে তারা এক নতুন আশমানে, সমস্ত-কিছুকে ভাম্বর ক’রে তুলবে তারা অন্তরের অনির্বাণ জ্যোতিতে, নবযাত্রীদের এই বিশ্বপ্রেম হতে উদ্ভুত হবে এক নবজীবন। কে নির্বাণ করবে এ শক্তিকে? কোন্ শক্তি এর চাইতে মহত্তর? কে দমিত করবে এ শক্তিকে? পৃথিবী এর জন্ম দিয়েছে, সমস্ত মানুষ এর জয়-কামনা করেছে! রক্তের নদী···শুধু তা কেন, সমুদ্র বইয়ে দাও, এ নিভবে না।···

 লিউদ্‌মিলার হাত ধরে তিনি বললেন, মা, মানুষের কাঙ্ক্ষিত আলোক যে তার নিজের মধ্যেই আছে, একথা জানা যে কতো হিতকর তা তোমায় কি ক’রে বলবো! এমন দিন আসবে যখন মানুষ এটা বুঝবে, মানুষের প্রাণ সে আলোকে মণ্ডিত হবে। এর অনির্বাণ শিখায় সকলের প্রাণ জ্বলে উঠবে।···পৃথিবীতে আজ জন্ম নিয়েছে এক নব দেবতা সে দেবতা মানুষ···সমস্তের জন্য সমস্ত কিছু, সমস্ত কিছুর জন্য সমস্ত, প্রত্যেকের জন্য ষোলো আনা জীবন, ষোলো আনা জীবনের জন্য প্রত্যেকে ···এমনিভাবে আমি তোমাদের সবাইকে বুঝেছি। এই দুনিয়ায় তোমাদের আবির্ভাব এরি জন্য। সত্যি-সত্যিই—তোমরা সবাই কমরেড, আত্মীয়, সাথী, কারণ তোমরা সবাই সত্যের সন্তান···সত্য তোমাদের জনম দিয়েছে—সত্যের দৌলতে তোমরা বেঁচে আছো···যখনই নিজের মনে উচ্চারণ করি, কমরেড, তখনই যেন প্রাণ দিয়ে শুনি,— তোমরা যাত্রা করেছো·· সর্বস্থান হ’তে···দলেদলে···একই কার্যের সঙ্কল্প নিয়ে। কানে যেন ভেসে আসে মত্ত হর্ষধ্বনি। দুনিয়ার সমস্ত মন্দিরের সব ক’টা ঘণ্টা যেন একসঙ্গে বেজে উঠেছে অপূর্ব এক উৎসব-সমারোহে।

 লিউদ্‌মিলা আশ্চর্য হয়ে মার মুখের দিকে চেয়ে বললো, অপূর্ব, এ যেন উচ্চগিরিশিরে সূর্যোদয়।