মা/দ্বিতীয় খণ্ড/এগারো

—এগারো—

 মা সরাইয়ে ফিরে এলেন। ক্ষুধা নেই, খাবার পড়ে রইলো প্লেটে! কেবল চোখের ওপর নাচতে লাগলো রাইবিনের সেই নির্যাতন।

 পরিচারিকাটি এসে বললো বেশ একটু উত্তেজিত স্বরে, উঃ পুলিশ সাহেব কী মারটা মারলে! আমি কাছে দাঁড়িয়ে দেখলুম, সব-কটা দাঁত ভেঙে গেছে···থুথু ফেললো, পড়লো ভাঙা দাঁত আর রক্তের চাপ। চোখ এতো ফুলে উঠেছে যে, তা দেখা যায় না। ওরা বললো, দলে আরো লোক ছিল···এ ছিল নেতা···তিনজনকে ধরেছিল···একজন পালিয়েছে···এরা নাকি ঈশ্বর মানে না। লোকজনকে বলে, গির্জা লুঠ করো···এমনি লোক এরা। অনেকে চোখের জল ফেললো ওদের জন্যে··· আবার কোন কোন হতভাগা বলে কিনা, বেশ হয়েছে, বাছাধনেরা একেবারে ঠাণ্ডা! কী নীচ অন্তকরণ দেখেছেন?—

 মা বুঝলেন, টাউন হলের ভিতর নিয়ে গিয়ে রাইবিনকে আরো একচোট মারা হয়েছে। চুপ ক’রে রইলেন তিনি। দরদী শ্রোতা পেয়ে মেয়েটি বলতে লাগলো, বাবা বলেন,··· অজন্মার দরুণ এসব হয়!··· পরপর এই দু’বছর অজন্মা। লোকজন হয়রান্ হয়ে গেলো।···তাই এব হাঙ্গামা।···এই তো সেদিন ভসিনকভের যথাসর্বস্ব বিকিয়ে গেলো দেনার দায়ে। মরিয়া হ’য়ে শেষে বেচারা বেলিফের মুখে লাগালো এক ঘুষি, বললো, এই নাও তোমার পাওনা।···

 নীল-চোখ চাষীটি এসে হাজির হ’লো। মা তার সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলে বুঝেছেন, সেও তাঁদের দলের লোক; কাজেই তার ওখানে রাত্রিবাস করা স্থির করেন। চাষীটি মেয়েটিকে বললো···ওকে আমাদের ওখানে নিয়ে যেয়ো। তারপর মার ব্যাগটা তুলে নিয়ে মুচকি হেসে বললো, একদম খালি যে···এটা আমি নিয়ে গিয়ে সাবধান ক’রে রাখছি। আপনি ওর সঙ্গে আসুন,···বলে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলো।

 খানিক বাদে মাও মেয়েটির সঙ্গে চাষীর বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। ছোট্ট একখানি ঘর, কিন্তু পরিষ্কার ঝক্‌ঝকে। এক কোনে টেবিলের ওপর একটা ল্যাম্প জ্বলছে। মাকে অভ্যর্থনা ক’রে চাষী বউকে বললো, তেতিয়ানা, যাও, শীগগির পিওরকে ডেকে আন।

 তেতিয়ানা চ’লে যেতে মা জিগ্যেস করলেন, আমার ব্যাগ?

 নিরাপদ জায়গায় আছে।···মেয়েটি সামনে ছিল ব’লে খালি বলেছিলুম···নইলে ও তো দেখচি বেজায় ভারি।

 তাতে কি হল?

 তারপর উঠে মার কাছে গিয়ে চাষীটি ফিস্ ফিস্ ক’রে বললো, সেই লোকটাকে চেনেন আপনি?

 মা একটু চমকে উঠলেন, কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন, হাঁ।

 তা-ই আন্দাজ করেছিলুম। তাকেও জিগ্যেস করতে বললো, আরো অনেক আছে আমাদের দলে। বেশ লোক রাইবিন...আচ্ছা আপনার ও ব্যাগে তো বই আর কাগজ আছে, না?

 হাঁ, ওদের জন্যই নিয়ে এসেছিলুম।

 আমাদের হাতেই বই-কাগজ পড়েছিল···আমরাও ওই চাই।··· খাঁটি কথা লিখেছে···আমি নিজে বড় একটা পড়তে পারিনে— আমার এক বন্ধু পারে। তাছাড়া আমার বউও প’ড়ে শোনায়।···তা, বই-কাগজগুলোর ব্যবস্থা কি করবেন?

 তোমাদের দিয়ে যাবো।

 চাষী শুধু বললো, আমাদের! কিন্তু কোনো রকম আশ্চর্যের ভাব দেখালো না!

 রাইবিনের কথা ভেবে মার চোখ বারে বারেই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু কণ্ঠ তার অকম্পিত, বলেন, মানুষের যথা-সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তার কণ্ঠরোধ ক’রে তাকে পায়ে মাড়িয়ে যায় ঐ ডাকাতের দল! প্রতিবাদ করলে জবাব মেলে প্রহার এবং নির্যাতন।

 চাষী বললো, শক্তি···শক্তি ওদের বেশি কিনা!

 মা উত্তেজিত সুরে বললেন, কিন্তু সে শক্তি রা পেলে কোত্থেকে? ···এই আমাদেরই কাছ থেকে। যা-কিছু তাদের, সব আমাদের কাছ থেকেই পাওয়া।

 চাষী বললো, সে কথা ঠিক।···একটা চাকার মতো আর কি।... আমরা চালাই অথচ আমরাই তাতে কাটা পড়ি।···ঐ আসছে।

 কে?

 আমাদের দলেরই লোক। ওর কাছেই ব্যাগটা রেখেছি।

 বউ একটি চাষীকে নিয়ে এলো। এই পিওর। পিওরকে বসতে দিয়ে বউ মাকে লক্ষ্য ক’রে স্বামীকে জিগ্যেস করলো, উনি খাবেন না, স্টিপান?

 মা বললেন, না, মা।

 পিওর একটু বেশি কথা বলে। মার সঙ্গে মিনিটখানেকের মধ্যেই সে দিব্যি গল্প জুড়ে দিলো। রাইবিনের কথা উঠতে প্রশ্ন করলো, সে কি আপনার আত্মীয় কেউ?

 আত্মীয় নয়···বহুদিনের পরিচিত···দাদার মতো ভক্তি করি।

 অর্থাৎ বন্ধু। চরিত্রবান্ লোক বটে! আর নিজের কদর বোঝে··· একটা লোকের মতো লোক, বুঝলে, তেতিয়ানা!

 তেতিয়ানা জিগ্যেস করলো, বিয়ে করেছে?

 মৃত-দার।

 তাই এতো সাহস। বিবাহিতেরা এতো সাহস দেখাতে পারে না।

 পিওর বললো, কেন,—আমি?···

 তেতিয়ানা ঠোঁট উলটে বললো, তুমি? কাজ তো করছো ভারি? খালি বকর বকর আর ঘরের কোনে বসে এক-আধখানা বই পড়ে ফিস্-ফাস।

 পিওর আহত হ’য়ে প্রতিবাদ করলো, কেন, মেলা লোক তো শোনে আমার কথা। এটা বলা তোমার উচিত হলনা, বৌদি।

 তেতিয়ানা সে কথা কানে না তুলে বললো, তা ছাড়া, চাষীরা আবার বিয়ে করে কেন? চাকরের একজন চাকরানীর দরকার—তাই! কাজ কি তার?

 স্টিপান বললো, সে কি বউ, কাজের কি কোনো কমতি আছে তোমার?

 ছাই কাজ। এ কাজ করে লাভ?...ছেলে-মেয়ে বিয়ানো, অথচ তাদের যত্ন করার ফুরসুৎ নেই···খাওয়ানোর কড়ি নেই। খালি খেটে মর। আমারও, মা, দুটি ছেলে ছিল···একটি দু’বছর বয়সে ফুটন্ত জলে পড়ে মারা যায়। আর একটি মারা পড়ে, এই পোড়া খাটুনির ফলেই। আমি বলি, চাষীরা যেন বিয়ে না করে, হাত না বাঁধে। তাহ’লেই তারা সত্যের জন্য খোলাখুলি লড়াই চালাতে পারবে। তাই নয়, মা?

 হাঁ।

 তারপর মা আবেগের সঙ্গে বিপ্লব কাহিনী, নামজাদা বিপ্লবীদের জীবনী এবং কার্য-প্রণালী ও দেশ-বিদেশের মজুর-প্রগতির কথা চাষীদের কাছে বর্ণনা ক’রে গেলেন।

 তেতিয়ানা বললো, তাইতো আমি ওকথা বলি, মা। তারা আর আমরা! আমরা তো জীবন কাটাই ভেড়ার মতো। এইতো ধরুন, আমি লিখতে পড়তে জানি, বই পড়ি আর ভাবি,···এমনও অনেকদিন হয় যে ভাবনায় রাতে ঘুম হয় না?···কিন্তু লাভ? না ভাবলে জীবনটা ঠেকে ফাঁকা, আর ভাবলেও জীবনটাকে ফাঁকাই ঠেকে। পৃথিবীর কোনকিছুর যেন কোন উদ্দেশ্য নেই। এই যে চাষীরা···দিনরাত খেটে মরে এক টুকরো রুটির জন্য···কিন্তু কি পায়? কিছুই না। তাইতো দুঃখ পায়, রেগে ওঠে, মদ খায়, মারামারি করে, তারপর আবার কাজ করে। কাজ·· কাজ···কাজ·· কিন্তু কাজ করে লাভ?···বিন্দুমাত্র না।

 স্টিপান হঠাৎ বললো, তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আলোটা নিভিয়ে দেওয়া ভাল।

 পিওর বললো, হাঁ, সতর্ক থাকবে বৈকি, স্টিপান। কাগজ যখন ছড়িয়ে পড়বে লোকদের মধ্যে তখন···

 স্টিপান অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মার দিকে চেয়ে বললো, কিন্তু আমি আমার কথা বলিনি।···আমার মতো মানুষের দামই বা কি! একশো এক আনা।

মা বললেন, ভুল করছো তুমি। বাইরের লোক···তোমায় শোষণ করায় যার স্বার্থ···সে তোমার যে দাম কষবে তা গ্রাহ্য নয়! তোমার, দাম কষবে তুমি নিজে।


 পিওর বিদায় নিয়ে চ’লে গেলো। তেতিয়ানা মাকে বিছানা পেতে দিতে দিতে বললো, আজকাল চাই মানুষের মধ্যে এই বিদ্রোহকে উস্‌কে দেওয়া। ভাবে তো সবাই, কিন্তু গোপনে নিজের মনে। তাতে চলবে না। মানুষকে মুক্তকণ্ঠে জোর গলায় বলতে হবে। আর, একজনকে প্রথম এই কাজে ব্রতী হয়ে পথ দেখাতে হবে। কতকগুলি অসংবদ্ধ ছাড়া-ছাড়া চিন্তায় চলবে না, একটা কর্তব্য স্থির ক’রে কাজের সূত্রে সেগুলোকে গেঁথে তুলবে হবে।···

 বিছানা পাতা হ’লে মা শুয়ে পড়লেন। তেতিয়ানা বললো, আপনিও প্রার্থনা করেন না?···আমিও মনে করি, ভগবান নেই, মানুষকে বোকা বানাবার জন্য এসবের আমদানি হয়েছিল।

 মা বললেন, আমি যীশুতে বিশ্বাস করি। কিন্তু ভগবান? জানিনে! তিনি যদি থাকবেনই তা’হলে তাঁর মঙ্গল-শক্তি হতে আমরা বঞ্চিত কেন? কেন তিনি মানুষকে দুটো ভাগে বিচ্ছিন্ন হ’তে দিলেন? কেমন ক’রে তাঁর রাজ্যে সম্ভব হয়, মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং উপহাস, অন্যায় ও পাশব আচরণ?

 আমার সন্তান দু’টির মৃত্যুর জন্য দায়ি কে···মানুষই হ’ক আর ঈশ্বরই হ’ক—আমি তাকে কখনো ক্ষমা করবো না···কখ্‌খনো না।

 মা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তোমার তো ছেলে হবার বয়স যায়নি, মা!

 তেতিয়ানা খানিকক্ষণ চুপ ক’রে রইলো, তারপর ধীরে ধীরে, বললো, না, মা, ডাক্তার বলেছে, আমার আর ছেলে হবে না।

 এই রিক্ত-সন্তান নারীর বুকের ব্যথা বুঝে মা নীরব হ’য়ে রইলেন।

 স্বামী-স্ত্রী মাকে শুইয়ে রেখে নিজেরাও শুয়ে পড়লো।