মা/দ্বিতীয় খণ্ড/চার

—চার—

 সন্ধ্যার সময় রাইবিনরা কাজ থেকে ফিরে এসে চা খেতে বসলো। হঠাৎ ইয়াফিম বলে উঠলো, ঐ কাশির শব্দ···শুনচ?

 রাইবিন কান পেতে শুনে শোফিকে বললো, হাঁ, ঐ সে আসছে··· সেভলি আসছে। পারলে আমি ওকে শহরের পর শহরে নিয়ে যেতুম, পাবলিক স্কোয়ারে দাঁড় করিয়ে দিতুম, লোকে ওর কথা শুনতো। ও একই কথা বলে সব সময়, কিন্তু সে কথা সকলেরই শোনার যোগ্য।

 বনের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে লাঠি ভর ক’রে বেরিয়ে এলো এক আনত, শীর্ণ, কঙ্কাল··· তার নিশ্বাসের শব্দ কানে এসে বাজছে। গায়ে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা একটা কোট, শুকনো খাড়া কটা চুল, মুখ আদ্দেক হা-করা, চোখ কোটরাগত, ধক্ ধক্ করে জ্বলছে···রাইবিন শোফির সঙ্গে তার পরিচয় করে দিতেই বললো, আপনিই চাষীদের জন্য বই এনেছেন?  হাঁ।

 চাষীদের পক্ষ হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি! ওরা এখনো এই বই, যাতে সত্য প্রচার করা হয়েছে, তার মর্ম বোঝে না। এখনো ওদের চিন্তা-শক্তির স্ফুরণ হয়নি, কিন্তু আমি সব নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি এবং সেই জন্যই ওদের হ’য়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।···

 এত কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো, কাঠির মতো আঙুলগুলি দিয়ে বুক চেপে অতি কষ্টে সে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো শুকনো মুখের মধ্য দিয়ে। শোফি বললো, সন্ধ্যাবেলায় এতো ঠাণ্ডায় বেরোনো ভাল হয়নি আপনার।

 ভালো! আমার পক্ষে ভালো এখন একমাত্র মরণ আমি মরতে চলেছি। মরব, কিন্তু মরার আগে লোকের একটা উপকার করে যাবো, সাক্ষ্য দিয়ে যাবো—কত পাপ, কত অনাচার, আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমার দিকে চেয়ে দেখুন, আটাশ বছর বয়স আমার কিন্তু এখনই আমি মরতে চলেছি! দশ বছর আগে অনায়াসে পাঁচশো পাউণ্ড আমি কাঁধে তুলে নিতে পারতুম···এ শক্তি নিয়ে সত্তর বছর বাঁচার কথা, কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই আমি শেষ হ’য়ে গেলুম। কর্তারা ডাকাত···তারা আমার জীবন থেকে চল্লিশটা বছর ছিনিয়ে নিয়েছে, চল্লিশটা বছর চুরি করেছে!

 রাইবিন শোফির দিকে চেয়ে বললো, শুনলেন তো— এই হচ্ছে ওর সুর।

 সেভ্‌লি বললো, শুধু আমার নয়, হাজার হাজার লোকের সুর এই। কিন্তু তারা আওড়ায় এটা তাদের নিজেদের মনে মনে। বোঝেনা, তাদের এই মন্দভাগ্যজীবন দেখে মানুষ কতবড় একটা শিক্ষা পেতে পারে। কতলোক মরণের কোলে হেলে পড়েছে শ্রমের নিপীড়নে; কত লোক পঙ্গু বিকলাঙ্গ হ’য়ে ক্ষুধায় ধুকতে ধুকতে নীরবে প্রাণ দিচ্ছে। বজ্রকণ্ঠে আজ সেই কথা প্রচার করা দরকার, ভাইসব, বজ্রকণ্ঠে সেই কথা প্রচার করা দরকার।

 উত্তেজনায় সেভ্‌লি কাঁপতে লাগলো।

 ইয়াফিম বললো, তা কেন? মানুষ আমি, সুখ যতটুকু পাই, তার কথাই জানুক, দুঃখ আমার মনে মনেই থাক, কারণ সে আমার একান্ত নিজস্ব জিনিস।

 রাইবিন বললো, কিন্তু সেভ্‌লির দুঃখ শুধু ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, ইয়াফিম্,·· লক্ষ লক্ষ মানুষ আমরা যে দুঃখ ভুগছি, ও তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। ওর মাঝে আমরা নিজেদের ভাগ্যই প্রতিফলিত দেখতে পাই। ও একদম তলা পর্যন্ত নেবেছে···ভুগেছে···তার পর দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, হুসিয়ার, এদিক পানে পা বাড়িয়ো না।

 ইয়াকব সেভ্‌লিকে ধরে নিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে বসালো। বসে সেভ্‌লি আবার বলতে আরম্ভ করলো, কাজের চাপে মানুষকে পিষে মারে ওরা। ধ্বংস করে মানুষের প্রাণ! কেন? কিসের জন্য? আজ জবাব চাই তার। আমার মুনিব···তার কাপড়ের কলে আমার জীবন দিলুম আমি···আর তিনি? তিনি করলেন কি?—এক প্রণয়িনীকে সোনার হাত-ধোয়ার পাত্র উপহার দিলেন।···শুধু তাই নয়, প্রণয়িনীর প্রত্যেকটি প্রসাধন-দ্রব্য হ’ল সোনার। সেই পাত্রের মধ্যে আমার বুকের রক্ত, সেই পাত্রের মধ্যে আমার সমগ্র জীবন। ওরই জন্য জীবন গেছে আমার! একটা লোক আমাকে খাটিয়ে খুন করলো! কেন? না, —আমার রক্ত ছাড়া তার প্রণয়িনীর সুখ-সুবিধা হয় না, তার প্রণয়িনীর জন্য সোনার পাত্র কেনা হয় না।

 ইয়াফিম মৃদু হেসে বললো, ঈশ্বরের মূর্তি ধরে নাকি মানুষ তৈরি হয়েছে—সেই ঈশ্বরের মূর্তির এই অবস্থা! চমৎকার বলতে হ’বে।

 রাইবিন টেবিল চাপড়ে বললো, আর আমরা চুপ ক’রে থাকবো না।

 ইয়াকব যোগ করলো, সহ্য করবো না।

 মা শোফির দিকে ঝুঁকে পড়ে আস্তে আস্তে শোফিকে জিগ্যেস করলেন, যা’ বলছে তা সত্যি?

 হাঁ। খবরের কাগজে এরকম উপহারের কথা বেরোয়। আর ও যেটা বললো, ও ব্যাপারটা মস্কোর।

 রাইবিন প্রশ্ন করলো, কিন্তু সেই মুনিবের—ফাঁসি হ’ল না তার? কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। তাকে ঘর থেকে টেনে বের ক’রে জনসাধারণের সামনে হাজির ক’রে, টুকরো টুকরো ক’রে ছিঁড়ে তার অপবিত্র নোঙরা মাংস-পিণ্ড কুকুরের মুখে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। একবার মানুষ জাগুক, তখন তারা এক বিরাট বধ্যমঞ্চ প্রস্তুত করবে, আর সেখানে ওদের অজস্র রক্তধারায় ধৌত করবে এতদিনের অন্যায়। ওদের রক্ত ওদের নয়···ও আমাদের···আমাদের রক্ত আমাদের শিরা থেকে শোষণ ক’রে নিয়েছে ওরা।···

 সেভ্‌লি ব’লে উঠলো, শীত করছে।

 ইয়াকব তাকে ধরে আগুনের কাছে বসিয়ে দিলো। রাইবিন সেভলিকে দেখিয়ে অনুচ্চস্বরে শোফিকে বলতে লাগলো, বইয়ের চেয়ে ঢের বেশি মর্মস্পর্শী এই জীবন-গ্রন্থ। মজুরের হাত যখন কাটা পড়ে—দোষ মজুরের নিজের। কিন্তু এমনিভাবে একটা লোকের রক্তমোক্ষণ ক’রে তার শবটাকে যখন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, তখন?—তখন কি বুঝতে হ’বে? হত্যার অর্থ বুঝি, কিন্তু এই নির্যাতন, এর মানে বুঝতে পারিনে। আমাদের ওপর ওদের এ নির্যাতন···ওরা কেন করে জানো?— করে দুনিয়ার আমোদ-উৎসব, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব আত্মসাৎ করবে বলে— করে যাতে মানুষের রক্ত দিয়ে ওরা সব-কিছু কিনতে পারে—সুন্দরী গণিকা, ব্যার্মিজ টাট্টু, চাঁদির ছুরি, সোনার থালা, ছেলেমেয়ের খেলনা। তোরা কাজ কর, কাজ কর, আরো কাজ কর, কেবল কাজ কর, আর আমরা? আমরা তোমাদের মেহনতের কড়ি জমাই, আমাদের প্রণয়িনীকে সোনার পাত্র কিনে এনে দিই।···

 সেভ্‌লি বললো, আমি চাই তোমরা এর প্রতিশোধ গ্রহণ কর। এই রিক্ত-সর্বস্ব জনগণের ওপর অনুষ্ঠিত অন্যায়ের প্রতিশোধ নাও।

 রাইবিন বললো, রোজ ও আমাদের এই কথা শোনাবে।

 মা ব’লে উঠলেন, আর কি শুনতে চাও তোমরা? হাজার হাজার মানুষ যেখানে দিনের পর দিন কাজ ক’রে মরছে, আর মুনিব তাদের মেহনতের কড়ি দিয়ে মজা লুঠছে, সেখানে আর কি শুনতে চাও তোমরা?

 শোফি তখন দেশ-বিদেশের মজুর-প্রগতির কথা জ্বলন্ত ভাষায় বর্ণনা করে গেলো, তারপর বললো, দিন আসছে, যেদিন সারা দুনিয়ার মজুরেরা মাথা তুলে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করবে, এ জীবন আর চাইনে আমরা। এ জীবনের এইখানেই পরিসমাপ্তি হোক। সেদিন লুব্ধ ধনীর কাল্পনিক শক্তি তাসের ঘরের মত লুটিয়ে পড়বে, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, তাদের অবলম্বন অন্তর্হিত হ’বে।

 রাইবিন বললো, আর তার জন্য চাই একটা জিনিস—নিজেদের হীন মনে করোনা, তাহলেই তোমরা সমস্ত-কিছু জয় করতে পারবে।

 মা উঠে দাঁড়ালেন, এবার তাহলে আমরা যাই।

 শোফি বললো, হাঁ চলো।

 চাষীরা তাদের বিদায় দিলো—পরম আত্মীয়কে মানুষ যেমনভাবে বিদায় দেয়।

 পথে আস্‌তে আস্‌তে মা বললেন···এ যেন একটা সুন্দর স্বপ্ন। মানুষ আজ সত্য জানবার জন্য উন্মুখ।...উৎসবের দিন, প্রত্যুষে দেখেছি মন্দির জনহীন অন্ধকার···ধীরে ধীরে সূর্যও ওঠে, আলো জাগে, নরনারী সম্মিলিত হয়! এও তেমনি আমাদের প্রত্যুষ—

 শোফি বললো, হাঁ, আর আমাদের মন্দির এই সমগ্র পৃথিবী।