মা/দ্বিতীয় খণ্ড/পাঁচ

—পাঁচ—

 এমনি বিচিত্র গতিতে ব’য়ে চললো মা’র জীবন-স্রোত। শোফিও টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে দেশময়—দু’দিন থাকে, তারপর কোথায় উধাও হ’য়ে যায়, কেউ টের পায় না, তারপর আবার অকস্মাৎ এসে হাজির হয়। আইভানোভিচ রোজ ভোর আটটায় চা খেয়ে মাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনায়, তারপর ন’টায় আফিসে চলে যায়। মা ঘরের কাজ করেন, বই পড়তে শেখেন। আর ছবির বইয়ের দিকে মনসংযোগ করেন —ছবি দেখতে ভারি ভালো লাগে তাঁর—সমস্ত দুনিয়ার সমস্ত কিছু জিনিস তাঁর চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তারপর চলে তাঁর প্রধান কাজ—নিষিদ্ধ পুস্তক এবং ইস্তাহার ছড়ানো। নানা ছদ্মবেশে, নানা স্থানে, নানারকম লোকের সঙ্গে তিনি চলেন, ফেরেন, গল্প করেন, মনের কথা কৌশলে বার করেন। গোয়েন্দারা তাঁকে কোনোদিনও ধর্‌তে পারেনা। এমনিভাবে ঘোরার ফলে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তাঁর কাছে আরো জীবন্ত হ’য়ে উঠলো। দুনিয়ায় অফুরন্ত ধন, আর তার মাঝে মানুষ দরিদ্র···রাশি রাশি অন্ন, আর তার মাঝে মানুষ উপবাসী! ···শত সহস্র জ্ঞানভাণ্ডার, আর তার মাঝে মানুষ নিরক্ষর, শিক্ষাহীন ··মানুষ পথের ধুলোয় বসে হাঁকে, একটি কড়ি ভিখ্‌ দাও, বাবা—আর তারই সামনে স্বর্ণশীর্ষ, স্বর্ণগর্ভ দেব-মন্দির!···এই সব দেখে দেখে যে মা এতো প্রার্থনাপরায়ণা ছিলেন, তাঁরও যেন ধীরে ধীরে প্রার্থনার প্রতি আগ্রহ ক’মে এলো।

 পেভেলের বিচারের তারিখ এখনো স্থির হয়নি। পেভেলের কথা ভেবে মা আর তত আকুল হন না। পেভেলের সঙ্গে সঙ্গে আর সকল শহীদের কথাও তাঁর মনে জাগে—দুঃখের পরিবর্তে জাগে এক অনাস্বাদিত-পূর্ব গৌরব আর আরব্ধ ব্রতে নিষ্ঠা।

 শশেংকা মাঝে মাঝে দেখা করতে এসে পেভেলের কথা সুধোয়, ব’লে, সে কেমন আছে? আমার কথা জানিয়ো তাকে—তারপর চলে যায়। শশেংকা পেভেলকে ভালোবাসে, মা জানেন। তাঁর বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।

 অবসর পেলেই মা বই নিয়ে বসেন।

 আইভানোভিচ মার চোখের সামনে এক গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরে বলে, মানুষ আজ অর্থের কাঙালী, কিন্তু একদিন···যখন অর্থের চিন্তা আর তার থাকবেনা, শ্রম-দাসত্ব থাকবে না, তখন সে চাইবে সোনার চাইতেও বড় সম্পদ—জ্ঞান।

 মা মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, কবে—কতকাল পরে সে শুভদিন আসবে?