মা/দ্বিতীয় খণ্ড/ছয়
—ছয়—
আইভানোভিচ রোজ সময়মত আফিস থেকে ফেরে। সেদিন সে অনেকটা দেরি করে ফিরলো— আর ফিরলো এক গরম খবর নিয়ে,— কোন একজন মজুর-কয়েদী জেল পালিয়েছে, কে তা জানা যায়নি এখনো।
মার প্রাণ যেন আশায় উত্তেজিত হ’য়ে উঠলো, কিন্তু কণ্ঠকে জোর ক’রে সংযত ক’রে বললেন, হয়তো পেভেল।
আইভানোভিচ বললো, খুব সম্ভব। আমি রাস্তায় বেড়াচ্ছিলুম দেখতে পাই কি না—বোকামি আর কাকে বলে! যাক্, আবার বেরুচ্ছি।
মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও যাচ্ছি।
হাঁ, তুমি ইয়েগরের কাছে গিয়ে দেখো, সে কিছু জানে কি না।
মা বেশ জোর পায় ইয়েগরের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাচ্ছেন, হঠাৎ দুয়োরের দিকে চেয়ে চোখ তাঁর বিস্ফারিত হল···নিকোলাই না? ঐ তো গেটের কাছে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে! কিন্তু···না, কেউ তো নেই? তবে কি চোখের ধাঁধা! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আবার থমকে দাড়ালেন···মৃদু সন্তর্পিত পদশব্দ··· কিন্তু আবার নিচে চেয়েই মা চীৎকার করে উঠলেন, নিকোলাই, নিকোলাই,—তারপরই ছুটলেন তার দিকে। নিকোলাই হাত নেড়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, যাও, যাও,—
মা যেমন নেবেছিলেন, তেমনি উঠে গিয়ে ইয়েগরের ঘরে ঢুকে ফিস্ফাস করে বললেন, জেল পালিয়েছে নিকোলাই।
ইয়েগর হেসে বললো, তোফা। কিন্তু উঠে সম্বর্ধনা করবো এমন শক্তি তো আমার নেই।
বলতে না বলতে পলাতক নিজেই ঘরে এসে ঢুকে দোর বন্ধ করে হাসি মুখে দাঁড়ালো। ইয়েগর বললো, বস ভাই। নিকোলাই নিঃশব্দে হাসিমুখে মার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত চেপে ধরে বললো, ভাগ্যিস তোমায় দেখলুম, মা। নইলে জেলেই আবার ফিরতুম। শহরের কাউকে আমি চিনিনে; তাই খালি ভাবছিলুম, কেন পালালুম? এমন সময় তোমার সঙ্গে দেখা।
কেমন করে পালালে?
সোফার একপাশে বসে ইয়েগরের হাতে হাত দিয়ে নিকোলাই তার পলায়নকাহিনী ব্যক্ত করে গেলো। ওভারশিয়ারদের ধরে কয়েদীরা ঠ্যাঙাতে শুরু করে···পাগলা-ঘণ্টি বেজে ওঠে···গেট খুলে যায় এই ফাঁকে সে পালায়···তারপর ছন্নছাড়া হ’য়ে ঘুরে বেড়ায় একটা লুকোবার স্থান আবিষ্কার করার জন্য!
পেভেল কেমন আছে?
ভালোই আছে। আমাদের একজন মাতব্বর সে···কর্তাদের সঙ্গে বাদানুবাদ করে···আর সবাই তাকে মানে।···কি খাবো? ভবানক ক্ষুধা পেয়েছে।
ইয়েগর বললো, সেলফের ওপর রুটি আছে, ওকে দাও। তারপর বাঁ পাশের ঘরটায় গিয়ে লিউদ্মিলাকে ডেকে বল, খাবার নিয়ে আসুক। মা গিয়ে ডাকতেই লিউদ্মিলা বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলো, কি? অবস্থা খারাপ নাকি?
না, খাবার চাইছে।
চলো— খাবার সময় হয়নি এখনো।
দু’জনে ইয়েগরের ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই ইয়েগর বললো, লিউদ্মিলা ভ্যাসিলিয়েমা, ইনি কর্তাদের হুকুম না নিয়ে জেল থেকে চলে এসেছেন— পয়লা একে কিছু খেতে দাও, তারপর, একে দিন-দু’তিন লুকিয়ে রাখো।
লিউদ্মিলা মাথা নেড়ে রোগীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো, তা’ রাখছি কিন্তু মুখটা থামাও দেখি, ইয়েগর। জানো, এ তোমার পক্ষে ক্ষতিকর! ওরা আসামাত্র আমায় খবর দেওয়া উচিত ছিল। আর দেখছি ওষুধও খাওনি—এসব গাফেলি করার মানে কি? ওষুধ এক ডোজ খেলে একটু আরাম বোধ কর, এতো তুমি নিজেই বলো···তোমরা আমার ঘরে এসো···এ হাসপাতালে যাবে।
ইয়েগর বললো, হাসপাতালে না পাঠিয়ে ছাড়বে না তাহ’লে?
আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।
অর্থাৎ হাসপাতালে গিয়েও তোমার হাত থেকে নিস্তার নেই!
বোকোনা বলছি।
তারপর ইয়েগরের বুকে কম্বলটা টেনে দিয়ে শিশিতে ওষুধ কতটা আছে দেখে মার দিকে ফিরে বললো, আমি চললুম একে নিয়ে। তুমি ইয়েগরকে এক দাগ ওষুধ দিয়ো।···কথা বলতে দিয়ো না।
তারা চলে যেতেই ইয়েগর বললো, চমৎকার মহিলাটি। ওর সঙ্গে যদি কাজ করতে, মা! ওই আমাদের কাগজপত্র সব ছাপিয়ে দেয়।
চুপ, ওষুধ খাও।—
ইয়েগর ঢক ঢক ক’রে ওষুধ গিলে বললো, মরব ঠিকই, মা, কথা না বললেও। আর তার জন্য কুচপরোয়া নেই···বাঁচার আনন্দের সঙ্গে মরার বাধ্য-বাধকতা থাকবেই।
কথা কয়োনা।
কথা কবো না? বলো কি, মা। চুপ ক’রে থেকে লাভ? মাত্র কয়েক সেকেণ্ড বেশি বেঁচে থাকবো···বেশি দুঃখ সইবো। আর হারাবো সুলোকের সঙ্গে কথা কইবার আনন্দ। পরলোকে কি আর এমন কথা কইবার লোক খুঁজে পাবো, মা!
চুপ কর, ঐ মহিলাটি এসে এর জন্য আমায় বকবেন।
মা, ও আমাদের দলেরই একটি কর্মী। বকবে ও তোমায় নিশ্চয়ই। কারণ বকা ওর অভ্যাস।
লিউদ্মিলা এসে ঘরে ঢুকে দোর ভেজিয়ে বললো, নিকোলাইর পোশাক বদলে এক্ষুণি এস্থান ত্যাগ করা দরকার। এক্ষুণি গিয়ে পোশাক নিয়ে এসো।
মা কাজ পেয়ে খুশি হ’য়ে পথে বেরোলেন। তারপর ধারে-কাছে স্পাই আছে কিনা ভালো করে দেখে নিয়ে গাড়ি ক’রে বাজারে গেলেন। পলাতকের পোশাক বদলি করার জন্য কেউ কাপড় কিনতে আসে কিনা তা লক্ষ্য করার জন্যই স্পাই ঘুরছিল বাজারে। মা তাদের চোখে ধুলি দিয়ে পোশাক কিনলেন, আর কেবল বগর-বগর করতে লাগলেন···এমন লোক নিয়েও পড়েছি, খালি মদ, খালি মদ···আর মাস গেলেই এক-এক সুট পোশাক। পুলিস ভাবলো, ওর মাতাল স্বামীর জন্য পোশাক কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
পোশাক এনে নিকোলাইর ভেল বদলে তাকে নিয়ে মা আবার বাস্তায় বেরুলেন। তারপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে চল্লেন।
পথে খবর পেলেন ইয়েগরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁর যাওয়া দরকার। মা তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শুনলেন, ইয়েগর ডাক্তারকে বলছে, আরোগ্য হচ্ছে এক রকম সংস্কার! নয় কি, ডাক্তার?
ডাক্তার গম্ভীর কণ্ঠে বললো, বাজে বোকোনা।
ইয়েগর বললো, কিন্তু আমি বিপ্লবী···আমি সংস্কারকে ঘৃণা করি।
মা দেখলেন, ডাক্তারও তাদেরই একজন সহকর্মী। তাঁর সঙ্গে আলাপ হ’ল।
ইয়েগরকে আধা-শোয়া অবস্থায় রাখা হয়েছিল। এবার সে বলে উঠলো, ও, ···বিজ্ঞান···আর পারিনে—একটু শুই, ডাক্তার?
না।
তুমি গেলেই শোবো।
ডাক্তার মাকে বললো, দিয়োনা যেন শুতে। শুলে ওর ক্ষতি হবে।
ডাক্তার চলে যেতে ইয়েগর ধীরে ধীরে চোখ না খুলে বলে যেতে লাগলো, মরণ যেন আমার দিকে এগোচ্ছে আস্তে আস্তে-অনিচ্ছার সঙ্গে···আমার জন্য যেন ওর দরদ জাগছে···‘আহা এমন সুন্দর অমায়িক লোক তুমি···’
চুপ করো, ইয়েগর।
একটু সবুর কর, মা, শীগগিরই চুপ করবো, চিরদিনের মতে। চুপ করবো।···
তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আস্ছে। তবু ধীরে ধীরে, একটু একটু করে বলতে লাগলো সে,···তোমার সঙ্গ চমৎকার লাগছে, মা···তোমার চোথ, তোমার মুখ, তোমায় ভাবভঙ্গি অতি সুন্দর। কিন্তু এর পরিণাম?—অন্তরকে প্রশ্ন করি।—ভাবতে দুঃখ লাগে—কারাগার, নির্বাসন, নিষ্ঠুর অত্যাচার অন্যান্য সবাইর মতো তোমারও অপেক্ষা করছে।···মা তুমি কারাগারকে ভয় কর?
না।
কর না? কিন্তু কারাগার সত্যিই নরক। এই কারাগারই আমায় মরণ-আঘাত দিয়েছে, মা।···সত্যি কথা বলতে কি, আমি মরতে চাইনে, মা—আমি মরতে চাইনে।
মা সান্ত্বনা দিতে গেলেন, এখনই মরার কি হয়েছে; কিন্তু ইয়েগরের মুখের দিকে চেয়ে কথাগুলো যেন জমে গেলো মুখে।
ইয়েগর বলতে লাগলো, অসুখ না হলে আজও কাজ করতে পারতুম। কাজ যার নেই···জীবন তার লক্ষ্যহীন···বিড়ম্বনা।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার ছেয়ে এলো। মা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে দুয়োর বন্ধ করার মৃদু শব্দে জেগে উঠে বললেন কোমলকণ্ঠে, ঐ যা, ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। মাপ করো।
ইয়েগরও তেমনি কোমল কণ্ঠে জবাব দিলো, তুমিও মাপ কোরো।
হঠাৎ তীব্র আলো ফুটে উঠলো ঘরে—লিউদ্মিলা এসে দাঁড়িয়েছে ঘরে, বলছে, ব্যাপার কি?
মার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে জবাব দিলো ইয়েগর, চুপ।
মুখ হা করে খুলে মাথা উঁচু করলো সে। মা তার মাথাটা ধরে মুখের দিকে চাইলেন। সে মাথাটা সজোরে ছিটকে নিয়ে বলে উঠলো, বাতাস···বাতাস। তার শরীর থর থর করে কেঁপে উঠলো, মাথাটা ভেঙে পড়লো কাঁধের ওপর। উন্মুক্ত চোখের মধ্যে প্রতিফলিত হল দীপের শুভ্র শিখা। মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ইয়েগর, বাপ আমার!
লিউদ্মিলা জানালার কাছে গিয়ে শূন্যের দিকে চেয়ে বললো, আর কাকে ডাকছে৷, মা!
মা নুয়ে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।