মা/প্রথম খণ্ড/আঠারো
—আঠারো—
দিন কয়েক পরে নিকোলাই এসে হাজির হ’লো। বললো, ব্যাটাকে আমিই সাবাড় করবো মনে করেছিলুম, কিন্তু মাঝখান থেকে কে এসে মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিলে।
পেভেল স্নেহভরা কণ্ঠে বললো, চুপ চুপ, যা-তা বলো না!
নিকোলাই বললো, কি করবো আমি। দুনিয়ার কোথায় আমার স্থান —কিছুই বুঝি না। চোখে সব দেখি, মানুষের ওপর যে অন্যায় হচ্ছে, তা’ মর্মে মর্মে অনুভব করি; কিন্তু তা খুলে বলার ভাষা পাই না।···বন্ধু, আমায় কাজ দাও···একটা কঠিন কাজ দাও···এই অন্ধ, অকেজো, জীবন আর সহ্য করতে পাচ্ছি না আমি···তোমরা এক মহান কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছো, সে কাজ ক্রমশ এগোচ্ছে, দেখছি···অথচ আমি দুরে দাঁড়িয়ে। কাঠ তুলি, তক্তা ফাঁড়ি···অসহ্য। আমায় একটা শক্ত কাজ দাও, ভাই।
পেভেল বললো, দেবো।
এণ্ড্রি ব’লে উঠলো, চাষীদের জন্য আমরা একথানা কাগজ বের ক’চ্ছি। তুমি টাইপ সাজানো শিখে তার কম্পোজিটারের কাজ কর। আমি তোমায় শিখিয়ে দেবো।
নিকোলাই বললো, তা’ যদি দাও, তাহ’লে এই ছুরিখানা তোমায় উপহার দেবো।
এণ্ড্রি হেসে উঠলো, ছুরি! ছুরি নিয়ে কি করব?
কেন,—ভালো ছুরি, দেখো না!
আচ্ছা, সে দেখা যাবে। এখন চল, বেড়িয়ে আসি।
তিন জনে বেড়াতে বেরিয়ে গেলো।
দিন ব’য়ে চললো এম্নি ক’রে। পয়লা মে’র উৎসবের আয়োজনও চলতে লাগলো পূর্ণ মাত্রায়। পথে, ঘাটে, কারখানায়, দেয়ালে, থানার গায়ে, লাল ইস্তাহারের ছড়াছড়ি। পেভেল এণ্ড্রি দিন-রাত সমানে খাটে। মার ওপরও বহুৎ কাজের ভার থাকে। মা সারাদিন তাই নিয়ে ছুটোছুটি ক’রে বেড়ান। স্পাইতে পল্লি ভ’রে গেছে কিন্তু কাউকে হাতে-কলমে ধরতে পাচ্ছেনা। পুলিসদের শক্তিহীনতা দেখে তরুণদের আশা এবং উৎসাহ বাড়ছে।
তারপর এলো সেই পয়লা মে।
মা সব্বার আগে জেগে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল চাপালেন। জল ফুটে গেলো, কিন্তু তিনি ছেলেদের ডাকলেন না। আজ ওরা একটু ঘুমোক, এ ক’দিন অতো খেটেছে।
কারখানার পয়লা বাঁশি বেজে গেলো। তখনো তাদের ঘুম ভাঙলো না। দ্বিতীয় বাঁশি বাজাতে এণ্ড্রি উঠে পেভেলকেও ডেকে তুললো। তারপর চা খেতে গেলো মায়ের কাছে।
মা এণ্ড্রিকে একান্তে বললেন, এণ্ড্রি, ওর কাছে-কাছে থাকিস বাবা!
নিশ্চয়ই। যতক্ষণ সম্ভব, থাকবো।
পেভেল বললো, চুপি-চুপি কি কথা হ’চ্ছে তোমাদের?
কিছু না। মা বলছিলেন, হাত-মুখ বেশ ক’রে ধুতে, যাতে মেয়েরা আমাদের দিকে চেয়ে আর না চোখ ফেরাতে পারে। ব’লে এণ্ড্রি হাতমুখ ধুতে চলে গেলো।
পেভেল গাইতে লাগলো মৃদুস্বরে, ওঠো, জাগো, মজুরদল···
মা বললেন, শোভাযাত্রার বন্দোবস্ত করলে পারতিস এখন।
বন্দোবস্ত সবই ঠিক হ’য়ে আছে, মা।
যদি আমরা ধরা পড়ি আইভানোভিচ এসে যা’ করার করবে। সে-ই তোমায় সব রকমে সাহায্য করবে।
বেশ···মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন।
ফেদিয়া মেজিন যৌবনোচিত উৎসাহ এবং আনন্দ-দীপ্ত হ’য়ে ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, শুরু হ’য়ে গেছে। সবাই রাস্তায় বেরিয়েছে। নিকোলাই, গুসেভ, শ্যামোয়লোভ কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। বেশির ভাগ লোক কারখানা ছেড়ে বাড়ি চ’লে এসেছে। চলো, আমরাও যাই, এই ঠিক সময়। দশটা বেজে গেছে।
যাচ্ছি।
দেখবে, মধ্যাহ্ন-ভোজের পর সবাই জেগে উঠবে।
মেজিন, এণ্ড্রি, পেভেল, মা— চারজনেই বেরিয়ে পড়লেন পথে। দোরে, জানালায়, পথে, সর্বত্র লোকের ভিড় এবং কোলাহল। সবাই এণ্ড্রি পেভেলের দিকে চাইছে, সবাই তাদের অভিনন্দিত করছে। এক জায়গায় একজন চিৎকার ক’রে উঠল, পুলিস ধরবে ওদের; তা’ হ’লেই সব শেষ।
আর একজন জবাব দিলো, ধরুক, তাতে কি হয়েছে!
আর একটু দুরে জানালা দিয়ে ভেসে আসছে এক রমণীর অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠস্বর··· একবার ভেবে দেখ, তুমি কি একা?—একা নও। ওরা সব অবিবাহিত। ওদের কি···
যোশীমভের পা কবে কাটা পড়েছিল ব’লে কারখানা থেকে সে মাসোয়ারা পেতো। তার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে সে জানালা দিয়ে মুখ বের ক’রে চেঁচিয়ে উঠলো, পেভেল, পাজি, তোর মুণ্ডুটা ওরা ছিঁড়ে না নেয় তো কি বলেছি!
মা শিউরে উঠলেন, ক্রুদ্ধ হলেন। তারা কিন্তু কিছুমাত্র গায়ে না মেখে দিব্যি সাত-পাঁচ গল্প করতে করতে চল্লো। মিরোনোভ ব’লে এক মজুর এসে তাদের বাধা দিয়ে বললো, শুন্চি নাকি তোমরা দাঙ্গা করতে যাচ্ছ, সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের জানালা ভাঙতে যাচ্ছো?
পেভেল বললো, সে কি! আমরা কি মাতাল?
এণ্ড্রি বললো, আমরা যাচ্ছি শুধু নিশান নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতে, আর মজুরদের গান গাইতে। সে গান তোমরাও শুনতে পাবে। সেতো শুধু গান নয়···সে মজুরদের মন্ত্র, মজুরদের মতবাদ!
মিরোনোভ বললো, সে সব আমি জানি। আমি তোমাদের লেখা পড়ি কিনা··· তারপর মা, তুমিও বুঝি বিদ্রোহ করতে চলেছো।
হাঁ। মৃত্যু যদি আসে, আমি সত্যের সঙ্গে গলাগলি হ’য়ে পথ চলবো।
ওরা দেখছি নেহাৎ মিথ্যে বলেনি যে, তুমিই কারখানায় নিষিদ্ধ ইস্তাহার ছড়াও।
কারা বলেছে? পেভেল জিগ্যেস করলো।
লোকেরা! আচ্ছা, আসি তাহ’লে।···
মিরোনোভ চ’লে যেতে পেভেল বললো, তুমিও দেখছি, মা, জেলে যাবে।
যাই যাবো—মা ধীরে ধীরে বলেন।
সূর্য ওপরে উঠলো। বেলা বাড়ছে। লোকের উত্তেজনাও বাড়ছে। বড় রাস্তার গায়ে এক গলির মাথায় শ’খানেক লোকের ভিড়। তার মধ্য দিয়ে আসছে নিকোলাইর গলা··· মুগুরের ঘায়ের মতো···‘ওরা আমাদের রক্ত নিঙরে নিচ্ছে, ফল থেকে রস যেমন ক’রে নেওয়া হয়।···’
সত্যি কথা—একযোগে অনেকগুলি কণ্ঠ বেজে উঠলো।
এণ্ড্রি বললো, সাবাস, নিকোলাই! বলেই সে তার কর্কস্ক্রুর মতো দেহটা ভিড়ের মধ্যে গলিয়ে দিলো! পরক্ষণেই বেজে উঠলো তার গলা, বন্ধুগণ, ওরা বলে, পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন জাতি···ইহুদী, জার্মান, ইংরেজ, তাতার···কিন্তু আমি তা’ বিশ্বাস করিনে। দু’টি মাত্র পরস্পর-বিদ্বেষী জাত আছে দুনিয়ায়—ধনী এবং দরিদ্র। ধনীদের পোশাক বিভিন্ন হ’তে পারে, ভাষা স্বতন্ত্র হতে পারে, দেশ হিসাবে তারা ফরাসী, জার্মান অথবা ইংরেজ হ’তে পারে, কিন্তু মজুরদের সঙ্গে কারবারের বেলা তারা সবাই একজাত, সবাই তাতার। নিপাত যাক এই ধনীর দল!
শ্রোতাদের মধ্যে একটা উল্লাসের ঢেউ বয়ে গেলো।
এণ্ড্রি বলতে লাগলো, এবার চাও মজুরদের দিকে। ফরাসী মজুর, জার্মান মজুর, ইংরেজ মজুর—সবাই কাটাচ্ছে আমাদের রুশ-মজুরের মতোই কুকুরের জীবন!···
ভিড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। এণ্ড্রি গলা চড়িয়ে বলতে লাগলো, বিদেশের মজুররা আজ এই সোজা সত্য বুঝতে পেরেছে। আজ পয়লা মে’র এই উজ্জ্বল দিবসে তারা আবদ্ধ হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে; কাজ ছেড়ে, রাস্তায় এসে দলে দলে মিলিত হয়ে তারা আজ পরস্পরকে দেখছে, আর হিসাব নিচ্ছে তাদের বিপুল শক্তির। এইদিনে মজুরদের মধ্যে স্পন্দিত হচ্ছে একটি প্রাণ,—মজুরদের যে কী বিপুল শক্তি, এই জ্ঞানে সকল প্রাণ আলোকিত; সমস্ত হৃদয়ে আজ বন্ধুত্বের স্পন্দন; সঙ্গীদের সুখের জন্য, তাদের মুক্তি এবং সত্য লাভের জন্য যে যুদ্ধ, তাতে আত্মদান করতে সবাই আজ প্রস্তুত।···
কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো, পুলিস!