মা/প্রথম খণ্ড/সতেরো
সতেরো
দোর খুলে ঢুকলো রাইবিন।
রাইবিন সেই শহর ছেড়ে বেরুলো সত্য প্রচারে—আড্ডা গাড়লো গিয়ে এডিলজেভ ব’লে এক গ্রামে। যাবার সময় সে মেলাই গরম গরম বই ও ইস্তাহার নিয়ে গিয়েছিল, তাই দিয়ে সে সত্য প্রচার করতো। বইগুলোর বেশ চাহিদা ছিল। আরো বইয়ের দরকার বলে রাইবিন ইয়াফিম ব’লে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে শহরে এসেছে।
পেভেল রাইবিনকে সাদরে অভ্যর্থনা করলো।
রাইবিন সেই ক্রুদ্ধ বিদ্রোহীই আছে। কর্তাদের ওপর, বুর্জোয়াদের ওপর আজো সে তেমনি চটা। কথাপ্রসঙ্গে বললো, আমার বেশ সুবিধা আছে, নিষিদ্ধ বই ছড়াবো, আর পুলিস টের পেলে ধরবে ও অঞ্চলের দু’জন শিক্ষককে, আমায় সন্দেহ করতে পারবেনা।
পেভেল ব’ললো, কিন্তু এটাতো উচিত নয়, রাইবিন।
কোন্টা?
তুমি কাজ করবে, আর তার দুঃখ ভোগ করবে অন্যে!
রাইবিন জবাব দিলো, তুমি ভুল বুঝেছো, পেভেল! প্রথমত, শিক্ষকরা বুর্জোয়া, তাদের কোনো ভয় নেই। কর্তারা শাস্তি দেবেন যেসব পল্লিবাসীর কাছে বই পাবেন, তাদেরই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের বইয়েতে কি নিষিদ্ধ কথা কিছু নেই? আছে, তবে তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা, আমার বইয়ের মতো সোজ। খোলাখুলি লেখা নয়। তৃতীয়ত, বুর্জোয়াদের সঙ্গে বনিবনাও ক’রে চলতে চাই না আমি। পায়ে যে হাঁটছে তার কি সাজে ঘোড়-সওয়ারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা? সত্য কথা বলতে কি, ওদের এই গায়ে-পড়ে দেশের কাজ করাটাকে আমি দস্তুরমতো সন্দেহ করি। ওদের উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই খুব সাধু নয়। তাই ওরা বিপদে পড়লে আমি দুঃখিত হব না। সাধারণ পল্লিবাসীর ওপর অবশ্য এ রকমটা করতুম না।
মা বললেন, কিন্তু কর্তাদের মধ্যেও এমন দু’চারজন আছেন, যারা আমাদের জন্য প্রাণ দেন।
রাইবিন বললো, তাদের কথা স্বতন্ত্র কিন্তু বেশির ভাগের সঙ্গেই আমাদের অহি-নকুল সম্পর্ক। আমরা ‘হাঁ’ বললে, ওরা বলবে ‘না’ আর আমরা ‘না’ বললে, ওদের ‘হাঁ’ বলা-ই চাই—আমার পেট ভরে খেলে ওদের ঘুম হয় না, এই ওরা। পাঁচ বছর ধরে আমি শহরে শহরে, কারখানায় কারখানায় ঘুরেছি, তারপরে গেলুম গ্রামে—কিন্তু গিয়ে যা দেখলুম, তাতে বুঝলুম, আর এমন করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তোমরা শহরে থাকো, ক্ষুধা কি জানো না, অত্যাচার কি প্রত্যক্ষ কর না। কিন্তু গ্রামে সমস্ত জীবন ক্ষুধা মানুষের সঙ্গী হয় ছায়ার মতো— ক্ষুধা মানুষের আত্মাকে ধ্বংস করে—তার আকৃতি থেকে মানুষের ছাপ লোপ ক’রে দেয়। মানুষতো গ্রামে বেঁচে নেই, তারা অপরিহার্য অভাবে প’চে মরছে, আর তাই চারদিকে কর্তারা শ্যেন-দৃষ্টি বিস্তার করে বসে আছে— একটি টুকরোও যাতে তাদের মুখে এসে না পড়ে—পড়লে, যাতে তাদের মুখে ঘুসি মেরে তারা তা ছিনিয়ে নিতে পারে।
রাইবিন চারদিকে চাইলো, তারপর পেভেলের দিকে নুয়ে পড়ে টেবিলের ওপর হাত রেখে বলতে লাগলো, এমনি জীবন দেখে গা আমার রি রি করে উঠলো—ইচ্ছে হ’ল ছুটে শহরে চলে যাই। কিন্তু গেলুম না, গ্রামেই রইলুম। কর্তাদের চর্ব্যচোষ্য যোগাবার জন্য নয়, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। মানুষের ওপর অনুষ্ঠিত এই অন্যায়, এই অত্যাচারের জ্বালার বাহন আমি—শানিত ছুরিকার মতো এই অন্যায় অহর্নিশ আমার প্রাণে কেটে কেটে বসছে···আমায় সাহায্য কর পেভেল— এমন বই দাও, যা’ প’ড়ে মানুষ আর স্থির থাকতে পারবে না—তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠবে, এমন সত্য আজ তাদের শিক্ষা দাও যা গ্রামকে উত্তপ্ত ক’রে তুলবে, যা’ শুনে মানুষ মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়বে।···
তারপর হাত তুলে প্রত্যেকটা কথার ওপর জোর দিয়ে বলতে লাগলো, মৃত্যু আজ শোধ করুক মৃত্যুর ঋণ—মৃত্যু আজ উদ্বুদ্ধ করুক নব-জীবন। সহস্র সহস্র প্রাণ আজ উৎসর্গীকৃত হ’ক বিশ্বমানবকে নবভাবে জাগিয়ে তোলার জন্য।···এই চাই। শুধু মরা নয়—সে তো সোজা। চাই নব জীবন, চাই বিপ্লব···
মা চা নিয়ে এলেন। পেভেল বললো, বেশতো, মাল-মশলা দাও, পাড়াগাঁর জন্যও আমরা একটা কাগজ বের করছি।
দেবো। যতদুরসম্ভব সোজা ভাষায় লিখো···একটা ছোট ছেলেও যেন বুঝতে পারে।
তারপর হঠাৎ বলে উঠলো, আহা, যদি ইহুদী হতুম আমি! খৃস্টান সাধুরা অপদার্থ···ইহুদী প্রফেটরা এমন ভাষায় কথা কইতে পারতো, যা শুনলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। তারা গির্জায় বিশ্বাসী ছিল না, ছিল আত্ম-বিশ্বাসী; তাদের ভগবান ছিল তাদেরই অন্তরে। তাই তারা মানতো একমাত্র অন্তরের নীতি। মানুষ আইনের দাস নয়, সে মানবে তার অন্তরকে। তার অন্তরে সমস্ত সত্য নিহিত। সে পুলিসের দারোগাও নয়, গোলামও নয়— সে মানুষ, আর সমস্ত আইন তার মধ্যে।
রান্নাঘরের দোর খুলে এক যুবক এসে ঢুকলো। এই ইয়াফিম। রাইবিন তাকে পরিচিত করে দিলো পেভেলের সঙ্গে। তারপর বই বাছা শুরু হল। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে ইয়াফিম বললো, মেলাই বই দেখছি আপনাদের, কিন্তু পড়বার ফুরসুৎ বোধ হয় কম, গ্রামে কিন্তু পড়ার সময় প্রচুর।
কিন্তু ইচ্ছে বোধ হয় কম? —পেভেল বললো।
কম? কম কেন হবে। যথেষ্ট ইচ্ছে তাদের। দিনকাল কেমন পড়েছে জানেন তো! ভাববার শক্তি হারিয়ে যে নিশ্চিন্ত থাকতে চায়, তার মৃত্যু অবধারিত। মানুষ তো আর মরতে চায় না, তাই ভাবতে শুরু করেছে। তাইতো বই’র চাহিদা···ভূতত্ত্ব—এটা কি?
পেভেল ভূ-তত্ত্ব কি বুঝিয়ে বলতে ইয়াফিম বললো, জমির উদ্ভব হ’ল কি করে চাষীরা তা তত জানতে চায় না, যত জানতে চায় জমি কি ক’রে তাদের বেহাত হ’য়ে জমিদারের হাতে গেলো। পৃথিবীটা স্থির থাকুক, ঘুরুক, দাঁড়িতে ঝুলুক, যা’ খুশি হ’ক—কোনো আপত্তি নেই তাদের—তারা শুধু চায় খাবার।
এমনিভাবে বই বাছাই চলতে লাগলো। পেভেল ইয়াফিমকে জিগ্যেস করলো, তোমার নিজের জমি আছে?
হাঁ, ছিল, কিন্তু জমি চ’ষে আর রুটি মেলে না, তাই ছেড়ে দিয়েছি। ভাবছি, এবার সৈন্যদলে ঢুকবো। কাকা বারণ করেন, বলেন, সৈন্যদের কাজ তো লোকদের ধরে ঠেঙানো। কিন্তু আমি যাবো, বহুযুগ ধরে মানুষদের সৈন্যের সাজে সাজিয়ে রাখা হয়েছে—আজ তার অবসান করার দিন এসেছে। কি বলেন?
দিন এসেছে সত্য, কিন্তু কাজটা শক্ত। সৈনিকদের কি বলতে হবে, কেমন ক’রে বলতে হবে, তা জানা চাই।
তা জানবো, শিখবো।
কর্তারা টের পেলে গুলি ক’রে মারবে।
তা’ জানি। জানি যে তারা কোনো দয়া দেখাবে না। কিন্তু লোক তো জাগবে। আর এই জাগরণই তো বিদ্রোহ। নয় কি?
এবার ওঠা যাক।
রাইবিন, ইয়াফিম উঠে পড়লো। বইগুলো হাতে নিয়ে ইয়াফিম বললো, আজকাল এ-ই আমাদের আঁধারের আলো।
তারা চ’লে গেলে পেভেল এণ্ড্রি কে বলে, রাইবিনের তেজ আছে দেখছি।
এণ্ডি বললো, হাঁ, আমিও তা’ লক্ষ্য করেছি।···চাষীদের মন আজ বিষিয়ে উঠেছে। ওরা যখন জাগবে, ওরা যখন নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবে, সমস্ত জিনিস ওরা ওলট-পালট ক’রে দেবে। ওরা চায় যুক্তি, জমি—তাই সমস্ত কিছু প্রতিষ্ঠানকে ওরা ভেঙে-চুরে পুড়িয়ে ভূমিসাৎ করে দেবে···মুষ্টি-মুষ্টি ভষ্মের মধ্যে বিলুপ্ত হবে তাদের ওপর যুগযুগান্ত ধ’রে অনুষ্ঠিত অন্যায়।
পেভেল বললো, তারপর তারা লাগবে আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।
না পেভেল। আমরা তাদের দলে টানতে পারব। বোঝাতে পারব যে, মজুর আর চাষী একই ব্যথার ব্যথী, একই পথের পথিক। আমি জানি, তারা আমাদের কথায় বিশ্বাস করবে, আমাদের দলে যোগ দেবে।