—ষোল—

 পরদিন ভোর হ’তে না হ’তেই কর্সুনোভা ছুটে এলো, শীগ্‌গির এসো, আইছেকে কে খুন করেছে।

 শুনেই মার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আততায়ী ব’লে চকিতে একজনকে তিনি সন্দেহ করলেন। বললেন—কে খুন করলো?

 খুনী কি এখনো সেখানে ব’সে আছে?

 কর্সুনোভা বললো, ভাগ্যিস্ তোমরা সবাই বাড়ি ছিলে? আমি দুপুর রাতে জান্‌লা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে গিয়েছিলুম!

 পথে যেতে যেতে মা ভীত হ’য়ে বললেন, কি বলছ তুমি? আমরা খুন করেছি, একথা কারু স্বপ্নেও আসতে পারে?

 পারে। তোমরা ছাড়া মারবে কে! তোমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতো সে, এ তো রাজ্যশুদ্ধ লোক জানে।

 মার মনে আবার নিকোলাইর কথা জেগে উঠে।

 কারখানার দেয়ালের অদুরে লোকের ভিড়—সেখানে আইছের মৃত দেহ। রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। স্পষ্ট বোঝা যায়, কেউ গলা টিপে মেরেছে।

 একজন ব’লে উঠলো, পাজী ব্যাটার উচিত শাস্তি হয়েছে!

 কে-কে বললো একথা, ব’লে পুলিসরা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো শবের কাছে। লোকরা ছুটে পালালো। মাও বাড়ি চ’লে এলেন। এণ্ড্রি পেভেল বাড়ি এলে জিগ্যেস করলেন, কাউকে ধরেছে?

 শুনিনি তো, মা।

 নিকোলাইর কথা কিছু বলছে না?

 না। এ ব্যাপারে তার কথা কেউ ভাবছেই না। সে কাল নদীতে গেছে, এখনো ফেরেনি।

 মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।

 খেতে ব’সে চামচে রেখে পেভেল হঠাৎ ব’লে উঠলো, এইটেই আমি বুঝি নে।

 কি?—এণ্ড্রি বললো।

 পেভেল বললো, উদরপুরণ করার জন্য যে হত্যা, তা অত্যন্ত বিশ্রী! হিংস্র জানোয়ারকে হত্যা—হাঁ, তা বুঝতে পারি,—মানুষ যখন হিংস্র পশুতে পরিণত হ’য়ে মানবজাতির ওপর অত্যাচার করতে যায়, তাকে আমি নিজ হাতে হত্যা করতে পারি। কিন্তু এইরূপ ঘৃণ্য তুচ্ছ কীটকে হত্যা করা—আমি বুঝিনে কেমন ক’রে এ কাজে মানুষের হাত ওঠে।

 এণ্ড্রি বললো, কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের চাইতে সে বড় কম ছিল না ৷

 তা জানি।

 আমরা মশা মারি···যৎসামান্য রক্ত সে খায়, তা জেনেও।

 পেভেল বললো, আমি ও সম্বন্ধে কিছুই বলছিনে। শুধু বলছি, এ অত্যন্ত ছোট কাজ।

 এণ্ড্রি বললো, কিন্তু ও ছাড়া কি করতে পারো তুমি?

 পেভেল বহুক্ষণ নিরুত্তর থেকে বললো, তুমি পারো অমনভাবে একটা মানুষকে খুন করতে?

 এণ্ড্রি দৃঢ়কণ্ঠে বললো, নিজের জন্য কোনো জীবিত প্রাণীকে আমি ছোঁবও না; কিন্তু ব্রত-সিদ্ধির জন্য, বন্ধুদের হিতার্থে আমি সব-কিছু করতে পারি—এমন কি তার সর্বনাশ সাধনও করতে পারি—নিজের ছেলেকে পর্যন্ত···

 মা শিউরে বললেন, কি বলছ বাব৷!

 এণ্ড্রি হেসে বললো, সত্যি বলছি, মা, এ আমরা করতে বাধ্য···এই আমাদের জীবন।

 পেভেল চুপ ক’রে রইলো। এণ্ড্রি হঠাৎ যেন কি এক ভাবের প্রেরণায় উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, বললো, মানুষ কি ক’রে একে ঠেকিয়ে রাখবে? মাঝে মাঝে অবস্থার ফেরে প’ড়ে বাধ্য হয়ে এক একটা মানুষের ওপর এমন কঠোর হ’য়ে উঠ্‌তে হয়, সেই নবযুগকে আহ্বান ক’রে আনার জন্য, যখন মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে, পরস্পরের সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধে জড়িয়ে পড়ার। জীবনের অগ্রগতির পথে বিঘ্ন যারা নিজেদের শান্তি এবং সম্মানের খাতিরে মানুষকে বিক্রয় ক’রে যারা অর্থ সঞ্চয় করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার দাঁড়ানো চাই-ই। সাধু লোকদের পথে দাঁড়িয়ে গোপনে তাদের সর্বনাশ করতে চায় যে যুডাস তাকে বাধা না দিলে আমিও যুডাসের মতো অপরাধী হবো। এ পাপ? এ অন্যায়? আমি জিগ্যেস করি, ঐ যে কর্তারা—ওরা কোন অধিকারে সৈন্য রাখে? জল্লাদ রাখে? কারাগার, দণ্ডনীতি, ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে মানুষকে দাবিয়ে রেখে নিজেদের সুখ-সুবিধা, নিরাপত্তার পথ খোলসা করে? যদি কখনো এমন হয় যে, তাদের দণ্ড দেবার ভার আমি তুলে নিতে বাধ্য হই, তখন আমি কি করব? হাঁ, আমি দেবো ওদের দণ্ড, ভয় খাবো না। ওরা মারে আমাদের দশে দশে, শ’তে শ’তে। আমারও অধিকার আছে হাত তোলার,—সব চেয়ে কাছে যে শত্রু, সব চেয়ে যে বাধা জন্মায় তাকে আঘাত করার। এই হচ্ছে যুক্তি, কিন্তু···তবু আমি স্বীকার করি, ওদের মারা নিষ্ফল—বৃথা রক্তপাত। সত্য জন্মায় একমাত্র আমাদের নিজেদের বুকের রক্ত-ভেজা জমিনে। আমি জানি তা, কিন্তু আমি এ পাপ করব— দরকার যখন হ’বে তখন নির্মম হ’বো। আমি একমাত্র আমার কথাই বলছি। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এ পাপ মুছে যাবে, ভবিষ্যতের গায়ে তার কোনো চিহ্ন থাকবে না, আর কারুর নাম এতে কলঙ্কিত হবে না।···

 এণ্ড্রি অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো ঘরময়। তারপর বললো, জয়-যাত্রার পথে এমন অনেক সময় হ’বে যখন তোমার নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হ’বে নিজেকে, তোমার প্রাণ, তোমার যথা-সর্বস্ব ত্যাগ করতে হবে। প্রাণ দেওয়া, ব্রতকল্পে জীবন উৎসর্গ করা—সে তো সোজা। আরো চাই, আরো দাও। তাই দাও, যা’ তোমার জীবনের চাইতেও প্রিয়। তখনই তুমি দেখবে, জীবনের প্রিয়তম বস্তু যে সত্য, তার অদ্ভুত জীবনী-শক্তি।

 ঘরের মাঝখানে সে স্থির হ’য়ে দাঁড়ালো। তারপর চোখ আদ্দেক বুঁজে বিশ্বাস-দৃঢ়-কণ্ঠে বলতে লাগলো আবার··· এমন সময় আসবে জানি, যখন মানুষ মানুষের সাহচর্যে আনন্দ পাবে, যখন নক্ষত্রের মতে। একে অন্যকে আলো দেবে, যখন মানুষমাত্রের কানে বাজবে মানুষের কথা সঙ্গীতের মতো। মানুষ হ’বে সেদিন মুক্তিতে মহান, খোলা প্রাণে ঘুরবে ফিরবে তারা। হিংসা থাকবে না, বিদ্বেষ থাকবে না, লোভ থাকবে না, মানুষের যুক্তি অবজ্ঞাত হ’বে না। জীবন হ’বে মানুষের সেরা। মানুষ উন্নতির চরম শিখরে উঠবে— কারণ তখন সে মুক্ত। তখন আমরা জীবন কাটাবো সত্যে, স্বাধীনতায়, সৌন্দর্যে। তখন তারাই হ’বে তত শ্রেষ্ঠ, যারা যত বেশি প্রাণ দিয়ে পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরতে পারে, মানুষকে যত বেশি ভালোবাসতে পারে। সব চেয়ে মুক্ত যারা, তারাই হবে সব চেয়ে মহান্, সব চেয়ে সুন্দর। তখন গৌরবমণ্ডিত হ’বে জীবন, গৌরবমণ্ডিত হ’বে জীবনের অধিকারী মানুষদল।···এই জীবনের জন্য আমি সব-কিছু করতে প্রস্তুত। দরকার হলে আমি নিজ হাতে নিজের হৃৎপিণ্ড উপড়ে আনবো, নিজ পায়ে তা দলিত করব।···

 উত্তেজনায় এণ্ড্রি কাঁপতে লাগলো।

 পেভেল মৃদুকণ্ঠে জিগ্যেস করলো, কি হয়েছে তোমার, এণ্ড্রি?

 শোনো, আমিই তাকে খুন করেছি।

 পেভেল বুঝলো, তাই এণ্ড্রি আজ এত চঞ্চল। এণ্ড্রির জন্য সহানুভূতিতে তার বুক ভরে গেলো। মাও এই ব্যথিত ছেলেটিকে স্নেহ দিয়ে ঢেকে রাখতে চাইলেন।

 এণ্ড্রি বললো, তাকে কেন খুন করলুম, জানো? আমায় অপমান করেছিল—মানুষের পক্ষে চরম অপমান। এমন অপমান করতে আমায় কেউ কখন সাহস করেনি। আমি কারখানার দিকে যাচ্ছি, সে আমার পিছু নিয়ে বলতে লাগলো, আমাদের সবার নামই নাকি পুলিসের খাতায় আছে, পয়লা মের আগে সব্বাইকে শ্রীঘরে যেতে হবে। আমি কোনো জবাব দিলুম না, হাসলুম; কিন্তু রক্ত আমার টগ্ বগ্ ক’রে ফুটে উঠলো। তারপর সে বললো, তুমি চালাক লোক···এ পথে না চ’লে তোমার উচিত আইনের কাজে প্রবেশ করা, অর্থাৎ গোয়েন্দা হওয়া···ওঃ, কি অপমান, পেতেল! এর চাইতে মুখের ওপর ঘুসি মারলো না কেন সে! তাও হয়তো সইতে পারতুম। কিন্তু এ অসহ্য! মাথায় খুন চেপে গেলো। পেছন দিকে এক ঘুসি চালালুম···তারপর চ’লে গেলুম। ফিরে তাকালুমও না। শুনলুম সে ধপ ক’রে পড়ে গেলো নীরবে। মারাত্মক যে কিছু হয়েছে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি শান্তভাবে চ’লে গেলুম, যেন আর কিছু করিনি, একটা ব্যাঙকে লাথি মেরে পথ থেকে সরিয়ে রেখেছি।···তারপর কাজ করতে করতে শুনলুম, আইছে খুন হয়েছে। কথাটা আমার এমন-কি বিশ্বাসও হ’ল না—কিন্তু হাত যেন কেমন অসাড় হ’য়ে এলো...এ পাপ নয় আমি জানি, কিন্তু এ নোঙরা কাজ···সমস্ত জীবনেও যার কালিমা আমি ধুয়ে ফেলতে পারব না।

 পেভেল সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে বললো, তা এখন কি করতে চাও, এণ্ড্রি?

 কি কোরব?···আমি খুন করেছি, একথা কবুল করতে ভয় খাইনে আমি। কিন্তু লজ্জা হয়···এমন একটা তুচ্ছ কাজ ক’রে জেলে যেতে লজ্জা হয়। কিন্তু অন্য কেউ যদি এর জন্য অভিযুক্ত হয়, তা’হলে আমি গিয়ে ধরা দেবো; নইলে যেমন আছি তেমনি থাকবো।

 সেদিন কেউ আর কাজে গেলো না। পেভেল আর মা এণ্ডি র কথাই বলতে লাগলো। পেভেল বললো, এই তো দেখ, মা, আমাদের জীবন। এমনভাবে আমরা আছি পরস্পর সম্পর্কে যে ইচ্ছে না থাকলেও আঘাত করতে হয়। কাদের? ঐ সব ঘৃণ্য নির্বোধ জীবদের, সৈন্য, পুলিস, গোয়েন্দাদের···যারা আমাদের মত মানুষ, কিন্তু যাদের রক্ত আমাদেরই মতো শোষিত হচ্ছে অহর্নিশ, যারা আমাদেরই মত মানুষ হ’য়েও মানুষ বলে গণ্য হচ্ছে না। কর্তারা একদল লোকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন আর একদল লোক···ভয় দেখিয়ে তাদের অন্ধ ক’রে রেখেছেন···হাত-পা বেঁধে নিঙরে শুষে নিচ্ছেন তাদের রক্ত···এক দলকে দিয়ে আর একদলকে করছেন আঘাত। মানুষকে আজ তারা পরিণত করেছেন অস্ত্রে, আর তার নাম দিয়েছেন সভ্যতা।

 তারপর কণ্ঠ আরও দৃঢ় ক’রে বললো, এ পাপ, মা! লক্ষ লক্ষ মানুষকে, লক্ষ লক্ষ আত্মাকে হত্যা করার জঘন্য পাপ। হাঁ, আত্মাকে হত্যা করে তারা। তাদের আমাদের তফাৎ দেখ, মা। এণ্ড্রি না বুঝে খুন ক’রেও কেমন বিষণ্ণ, লজ্জিত; অস্থির হয়ে পড়েছে। আর তারা হাজার হাজার খুন ক’রে যাবে শান্তভাবে—একটু হাত কাঁপবে না, দয়া হবে না, প্রাণ শিউরে উঠবে না। তারা খুন করবে আমাদের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে। কেন জানো, মা? তারা সবাইকে—সমস্ত-কিছুকে টুটি টিপে ধ’রে মারে শুধু ওদের বাগান-বাড়ি, আসবাব-পত্র, সোনা রূপা কোম্পানীর কাগজ এবং লোককে দাবিয়ে রাখবার যত-কিছু সাজ-সরঞ্জাম, নিরাপদ রাখতে। ওরা খুন করে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে নয়— ওদের সম্পত্তি বাচিয়ে রাখতে।···এই অন্যায়, এই অপমান, এই নোঙরামি···এই-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, আমরা যে সত্য নিয়ে লড়াই করছি তা’ কত বড়, কত গৌরবময়।

 বাইরে লোকের পায়ের শব্দ হ’ল। দু’জনে চমকে চাইলেন, পুলিস নয় তো!