মিবাররাজ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
অন্য ভীলেরা যুবককে যেমন ভালবাসে, ভীলপুত্রও একদিন তাহাকে সেইরূপ ভাল বাসিত। যুবক যখন আট দশ বৎসরের বালক তখন হইতে ভীলদিগের সহিত তাহার আলাপ, তখন ভীলপুত্র কত আগ্রহভরে তাহাকে গৃহে লইয়া আসিত, কুন্তি শিখাইত, বাণ খেলা শিখাইত সঙ্গে লইয়া শীকার করিতে যাইত তাহাকে না পাইলে ভীল পুত্রের তখন খেলা করিয়া শীকার করিয়া আমোদই হইত না। কিন্তু তাহার পর—এখন? এখন যুধক আর তাহার বন্ধু নহে, সে তাহার প্রতিদ্বন্দী। যুবকের জন্য নিজের সমাজে ভীলপুত্রের এখন আর তেমন আদর প্রতিপত্তি নাই, প্রভুত্ব নাই। ভীলযুবারা যুবককে যত চায় তাহাকে তত চায় না, যুবককে নেতা করিয়া এখন তাহারা যত সন্তুষ্ট ভীল পুত্রকে নেতা করিয়া তত নহে। এমন কি তাহাদের যে খেলায় ভীলরাজ মন্দালিক না থাকেন, সেই খেলাতেই যুবককে তাহার প্রধান করে, এরূপে ভীলযুবাদের নিকট যুবকের একটি নামই রাজা হইয়া গিয়াছে। এক কথায় ভীলপুত্রের সামাজিক অধিকার যুবক একরকম পূর্ণ মাত্রায় গ্রাস করিয়া বসিয়াছে।
কত সামান্য কারণ হইতে সংসারে অসামান্য ঘটনা উপস্থিত হয়, এক বিন্দু অগ্নিস্ফুলিঙ্গেও বহুদিনের যত্ন নির্ম্মিত নগর ধ্বংশ হইয়া যায়, একটি ছোট কথাতেও কতদিনকার বন্ধুতা ভাঙ্গিয়া যায়, সুতরাং ঐরূপ বিশেষ কারণে যদি ভীমপুত্র যুবকের প্রতি বিতৃষ্ণ হইয়া থাকে— তাহাতে আশ্চর্য্যের কিছুই নাই, বরঞ্চ এরূপ স্থলে তাহাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক—কেন না আমাদের চোখের উপর সর্ব্বদা যাহা ঘটে তাহাই স্বাভাবিক! আমাদের সুসভ্য সমাজে এরূপ ঘটনার অভাব নাই—সেই জন্যই ইহা স্বাভাবিক! কিন্তু হইলে কি হয়—উক্ত “গুরুতর” কারণেও ভীলপুত্রের বন্ধুত্ব ভাঙ্গিয়া যায় নাই।—(বুঝি বা সে এমনি অস্বাভাবিক!) শেষাশেষি যাই হৌক—প্রথমে ভীলপুত্রই যুবককে একরকম বাড়াইয়া ভুলিয়াছে, আগে আগে সেই সর্ব্বাগ্রে যুবকের হাতে বাণ তুলিয়া দিয়াছে, শীকারে যাইবার সময় তাহাকেই আগুয়ান করিয়া সাঁঁড় করাইয়াছে, এক দিন যখন তাহাদের দুই দলে কৃত্রিম যুদ্ধখেলা হইতেছিল—ভীলপুত্রই যুবকের হাতে রাজ যষ্ঠি আনিয়া দিয়াছিল; কিন্তু তাহার পর যে দিন ভীলপুত্রের অপেক্ষা করিয়াই যুধক সেই সকল অধিকার নিজের বলিয়া গ্রহণ করিল, যে দিন ভীলযুবারা একবার ভীলপুত্রকে জিজ্ঞাসা পর্য্যন্ত না করিয়া যুবককে রাজা করিল, সেই দিন ভীলপুত্র একটু ক্ষুন্ন হইয়া পড়িয়াছিল বটে কিন্তু শীঘ্রই সে ভাব তাহার মন হইতে চলিয়া গেল, শৌর্য্যে বীর্য্যে বুদ্ধিকৌশলে সকল বিষয়েই যুবক এক শ্রেষ্ঠ যে ক্রমে যুবকের প্রভুত্ব আপনা হইতে তাহারো সহিয়া গেল—দুর্ব্বলের প্রতি সবলের, অক্ষমের প্রতি ক্ষমতাশালীর এমনি প্রভাব! কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব অসীম যেখানে ন্যায় প্রেম ইহার চালক; অন্যস্থলে ইহার প্রভাব প্রভূত হইলেও সে প্রভাবের সীমা আছে! ভীলপুত্রের এত সহিল—একটি সহিল না; যখন তাহার মনে হইল কেবল সামাজিক অধিকার নহে—তাহার পিতার স্নেহও যুবক আত্মসাৎ করিতেছে, তখন আর তাহার সহ্য হইল না। সে সব সহিতে পারে, পিতার স্নেহের উপেক্ষা সহিতে পারে না, আর সব অধিকার হইতে সে বঞ্চিত হইতে প্রস্তুত, কিন্তু তাহার এই স্বাভাবিক অধিকার আর কাহাকেও সে দিতে পারে না। ভীল অসভ্য, তাহার স্বাভাবিক, অবিকৃত হৃদয়ে প্রেমেরই একাধিপত্য, তাই সে ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করিতে পারে প্রেমকে পারে না। সে যে এমন করিয়া ডাবিয়া চিন্তিয়া, তাহার অধিকার অনধিকার বুঝিয়া সুঝিয়া এরূপ নিষ্পত্তিতে আসে তাহা নহে, সে আর কিছুই বুঝে না— পিতার স্নেহের অভাব দেখিলে তাহার যে কষ্ট হয় সে কেবল তাহাই বুঝে; সে আর কিছু ভাবে না যুবকের প্রতি পিতার স্নেহ দেখিলে তাহার যে কষ্ট হয়—তাহাই শুধু সে ভাবে; ভাবিতে ভাবিতে অবশেষে এক রকম করিয়া সে কষ্টটা তখনকার মত তাহার মনে মিলাইয়া পড়ে, কিন্তু এইরূপে যুবকের উপর তাহার যে একটা রাগের ভাব আসিয়া পড়ে তাহা উত্তরোত্তর ক্রমশই তাহার মনের মধ্যে জমা হইতে থাকে।
এইরূপ মনের অবস্থায় মৃগয়া দিনের সমস্ত ঘটনাই তাহার কষ্টের কারণ হইয়া উঠিল—বিশেষতঃ যখন পিতা বলিলেন—“তুই কেন ওডার মত হইলিনে” তখন আর ভীল পুত্রের দুঃখ রাখিতে স্থান হইল না, —মনুষ্যের গর্ব্বে আঘাত লাগিলে বড় আঘাত লাগে, এতদিন কত ঘটনায় যাহা না হইয়াছে আজ ঐ সামান্য কথাটিতে তাহা সাধিত হইল। এইরূপই হইয়া থাকে; ধূঁয়াইতে অনেক সময় যায়—কিন্তু জ্বলিয়া উঠিতে মুহূর্তও লাগে না!
যদি পিতার ভালবাসায় আগে হইতে তাহার সন্দেহ না জন্মিত তাহা হইলে ঐ কথাগুলিরই সে অন্য অর্থ দেখিতে পাইত, ঐ কথাতে সে পিতার ভালবাসার ভাবই দেখিতে পাইত, কিন্তু এখন এইগুলিতে তাহার মর্ম্ম বিদ্ধ হইল, গর্ব্বে আঘাত লাগিল, ক্রমাগত ঐ কথাগুলি মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিয়া তাহার দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে “তাহাকে আর পিতার মনে লাগে না।” জনতার মেলা হইতে সে একাকী দূরে আসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁদিল, তাহার পর স্থির করিল যুবক তাহার শত্রু।