মিবাররাজ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
পরদিন ভীলেদের ভোজোৎসব। আজিকার শীকার মাংস রন্ধন করিয়া আহার উপলক্ষে কাল তাহাদের নৃত্যগীত আমোদ প্রমোদ। শীকারীরা শীকার লইয়া গ্রামে আসিলে বিকাল হইতে গ্রামের সমস্ত ভীলেরা মহা ব্যস্ত, রাত্রেও তাহাদের নিদ্রা নাই। বৃদ্ধ ও যুবকদিগের নৃত্যগীত ভোজের স্বতন্ত্র দুইটি স্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, দুইটি নির্দ্দিষ্ট চক্রের মধ্যে শুষ্ক কাষ্ঠরাশির দুইটি আগুণ ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতেছে, তাহার চারিপাশে লোক জমা হইয়া মেয়ে পুরুষে মিলিয়া উনুন খুড়িতেছে, শীকার কাটিতেছে, বাটনা বাটিতেছে, মাদল পিটিতেছে, গল্প করিতেছে, হাসিতেছে, চীৎকার করিতেছে, আর হাসিতে হাসিতে গল্প করিতে করিতে মাঝে মাঝে অগ্নি কুণ্ডে শুষ্ক কাঠ ঠেলিয়া দিতেছে ও নূতন কাঠ কাটিয়া আনিয়া জমা করিবার জন্য তম্বি করিতেছে। যাহারা কাঠ আনিতে উঠিতেছে তাহারা দু এক পা গিয়া দু একটা মাদল টানিয়া লইয়া পিটিতে পিটিতে গান লাগাইয়া দিতেছে অবশেষে মেয়েদের চেঁচানির জ্বালায় মাদল গুলা ফেলিয়া চোঁচা দৌড় মারিতেছে।
এই সময় এই গোলমাল হইতে কিছু দূরে ভীলপুত্র একাকী বসিয়াছিল। কিছু পরে কয়েকটি ভীলযুবা নিকটে আসিয়া বলিল—“এক্কা কি করছুস রে—আয়না ওই দিকে” কিন্তু ভীলপুত্রের উঠিবার গতিক না দেখিয়া শেষে আপনারাই সেই খানে অডিডা গাড়িল, ক্রমে সেখানে ছোট্ট খাট্ট একটি দল জমিয়া, উৎসবেরই গল্প আরম্ভ করিয়া দিল; ভীলপুত্র চুপ করিয়া শুনিতে শুনিতে থাকিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল—
“কাল রাজা হউবিরে কোন ডা?”
ভীলদের সকল কর্ম্মেই একজন অধিনায়ক আবশ্যক;—ইহা অসভ্য সমাজের একটা বিশেষ লক্ষণ, কাল ভীলরাজ মন্দালিক বৃদ্ধদিগের মধ্যেই থাকিবেন, সুতরাং কাল যুবাদের অধিনায়ক হয় কে—এই কথা? কিন্তু একথায় অন্যেরা যেন আশ্চর্য্য হইল, একজন বলিল—“ক্যানরে যেইডা রোজ হউছে।” ভীল পুত্র কাল ভুরুর গোচ্ছা কুঁকড়িয়া বলিল—
“সেইডারে রোজ মুইরা রাজা করিবু ক্যানরে? তানা কি মুদের রাজপুত্র! মুরা কি রাজা হইতে নারি নাকি?”
একজন ভীল বলিল—“সে রাজা বেটা বড্ডই লায়েক ভাই”—
ভীল পুত্র রাগিয়া বলিল “মোর লায়েক নই ক্যামনে,”
ভীল বলিল “দেখুছিস ত কাল ক্যামন হরিণডা অনিল”
ভীলপুত্র। “সে হরিণ আনিল মুই বরা আনিল না?”
একজন ভীল। “তাতু ব্যাটে, ত্যাবে হরিণডা”—ভীলপুত্র লালচক্ষু করিয়া বলিল—
“হরিণডা হরিণডা! মুইত আর একদিন হরিণডা নিয়ে এনু, তাতে ত এত কথা কেউ কইল না—বাবাত মোর পিঠটাও ধাবড়ালে না—আর আজ দিনভোর হরিণডা হরিণডা! বল না ক্যান্, মুই গোটা গোটা অমন হরিণ আনু দিউছি।”
আর একজন ভীল বলিল “চট্টিশ ক্যান্ ভাইডা— তানা রাজা না হউবু ত কোনডা হউবু?”
ভীলপুত্র। “যত দিন হউছিল কে? মুই না রাজার ছেলে—মুই হউব। সডা হইলে মুই থাকিবুই না”
ভীলপুত্রের যা মনে হইয়াছে স্পষ্টাপষ্টি বলিয়া গেল—সে অসভ্য ঘোর প্যাঁচ করিয়া ঢকিয়া ঢুকিয়া বলা তাহার কর্ম্ম নহে। একজন ভীল বলিল—“তানা” রোজ রাজা হউছে আজ সেডা ছাড়বে ক্যানরে?”
ভীলপুত্র। “ছাড়ুবে ক্যান! মুরা কি মানুষ নকি? মরা তাড়াউতে নারিব!
এ কথায় ভীলেদের প্রাণে ব্যথা বাজিল—তাহারা যুবককে বড়ই ভাল বাসে, অথচ, ভীলপুত্রের এতদূর অনিচ্ছার মধ্যে তাহাকে রাজা করিবার কোন উপায়ই দেখিল না, মহা মুস্কিলে পড়িল। একজন একটু পরে বলল—
“বেস্ মুরা তানারে রাজা করিব না; কাল চক্করে (চক্র খেলায়) যেইডা জিতুবে—সেই ডা রাজা”—
ভীলপুত্র ইহাতে আর কোন কথা কহিতে পারিল না, এ প্রস্তাবে অসম্মত হইলে ভীলেরা তাহাকে ঘৃণা করিবে। তাহাই ঠিক হইল। যুবক প্রাতঃকালে আসিয়াই এই বন্দোবস্তের কথা শুনিল—তাহারও ইহাতে কোন আপত্তি হইল না। কোন উত্তেজনার কাজে, সাহসের কাজে যুবক পিছপাউ নহে, বরঞ্চ তাহাতেই তাহার আনন্দ, সেইরূপ কাজই যুবক খুঁজিয়া বেড়ায়।