মিবাররাজ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
একটি সমক্ষেত্রে শাখা-প্রশাখাচ্ছিন্ন কাছাকাছি দুইটি সমান মোটা গাছ; সেই গাছ দুইটি চক্রদ্বারা ভেদ করিতে হইবে—যাহার চক্র বৃক্ষকায়ের অধিকদূর ভেদ করিবে তাহারি জয়। গাছ দুইটি আন্দাজ আধ ক্রোশ দূরে রাখিয়া মাদলধারী ভীলযুবকগণের অগ্রভাগে দুইজন প্রতিদ্বন্দী পাশাপাশি ঠিক হইয়া দাঁড়াইল—মাদল বাজিয়া উঠিল, চীৎকার ধ্বনি উঠিল, আবার নিমেষের মধ্যে সে গোলমাল থামিয়া গেল, চারিদিক একটা ঔৎসুক্যময় নিস্তব্ধতায় পরিণত করিয়া দুই জনের হস্ত নিক্ষিপ্ত চক্র বিদ্যুৎবেগে দুই গাছে আসিয়া লাগিল। দেখিতে দেখিতে ভীলপুত্রের গাছটি মড় মড় করিয়া নুইয়া পড়িল, যুবকের গাছ যেমন দাঁড়াইয়াছিল তেমনিই দাঁড়াইয়া রহিল। বাজনা বাজিয়া উঠিল, ভীল পুত্রের পক্ষীয়গণ আহ্লাদে লম্ফ দিয়া চীৎকার করিয়া উঠিয়া জয়ীকে ঘেরিয়া নৃত্য করিতে লাগিল,—নাচিতে নাচিতে পাহাড়ের একটা উঁচু ঢিবির উপর যেখানে পাতার সিংহাসন রচিত হইয়াছিল সেইখানে তাহাকে লইয়া চলিল! তাহাদের জয় জয়কারের মধ্যে ভীলপুত্র সেইখানে আসিয়া বসিলেন, এই সময় পশ্চাতের আর একটা কলরব দ্রুতবেগে সিংহাসনের দিকে আসিতে লাগিল—সিংহাসনের চারিপার্শ্বস্থ জয়ধ্বনি ডুবাইয়া দিয়া ক্রমে এই কথা গুলি ধ্বনিত হইয়া উঠিল—“যুবক জয়ী হইয়াছে, যুবকের চক্র গাছ ভেদ করিয়াছে” পাতার সিংহাসন কঁপিয়া উঠিল, জয়ধ্বনি থামিয়া গেল, জয়কারীগণ অবাকস্তব্ধ হইয়া চীৎকারকারীদের মুখের পানে ফিরিয়া চাহিল্—আবার শুনিল “যুবক জয়ী হইয়াছে, তাহার চক্র গাছ ভেদ করিয়াছে।” হঠাৎ চারিদিকে একটা ঠেলাঠেলি পড়িয়া গেল, ভীলপুত্রকে সিংহাসনে ফেলিয়া রাখিয়া অন্যেরা ছুটিয়া সেই গাছের দিকে দৌড়িতে আরম্ভ করিল, নিকটে আসিয়া দেখিল সত্যই যুবক জয়ী হইয়াছে। ভীলপুত্রের চক্রে গাছের অর্দ্ধভাগ ছেদিত হইয়াই গাছ নত হইয়া পড়িয়াছে, আর যুবকের গাছ আড়া আড়ি একেবারে দ্বিভাগ হইয়া মূলস্তম্ভের উপর ঠিক দাঁড়াইয়া আছে। আর কিছু নহে, যুবকের গাছটি ঠিক সোজা ভাবে উঁচু হইয়া উঠিয়াছিল—তাই কাটিতে কাটিতে তাহা একেবারে পড়িয়া যায় নাই। স্রোত ফিরিল, সকলে জয়জয়কার শব্দে যুবককে ভীলপুত্রের সিংহাসনে আনিয়া বসাইয়া, কেহ গলায় পাতার মালা পরাইতে লাগিল, কেহ মাথায় ঘাসের মুকুট বাঁধিয়া দিল, একজন একটা বংশ দণ্ড আনিয়া হাতে দিল, সকলি হইল,—কেবল বাকী রহিল একটি। অভিষেকের সময় ভীলদের রাজার কপালে লাল ফোঁটা দিতে হয়, তাহার আয়োজন ত কিছুই নাই, উপায় কি? একজন উৎসাহোন্মত্ত ভীলযুবা নিজের আঙ্গুল কাটিয়া সেই রক্ত লইয়া তাহার কপালে ফোঁটা পরাইয়া দিল—অমনি সকলে আমাদের রাজা রাজা করিয়া চারি পাশে নৃত্য আরম্ভ করিল, দলে দলে কাতারে কাতারে লোক আসিয়া দাঁড়াইতে লাগিল, সত্যকার রাজাকেও এত লোকে দেখিতে আসে না। সেই জনতা ঠেলিয়া বহু কষ্টে একজন লোক সিংহাসনের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া হঠাৎ সকলে স্তব্ধ হইয়া পড়িল—তিনি তাঁহার ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলেন “কি হইয়াছে কি? সকলে উত্তর করিল “আমাদের রাজা হইয়াছে।”
“রাজা হইয়াছে? সে আবার কি?”
যুবারা তখন খুলিয়া সব বলিল—খানিকক্ষণ মন্দালিকের মুখে কোন কথা সরিল না, তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন—কিছু পরে আত্মস্থ হইয়া বলিলেন—
“বৎসগণ শোন, আজ খেলাচ্ছলে যাহাকে রাজার অধিকার দিলে—সে অধিকার আবার ফিরাইয়া লইলে তোমাদের কথা মিথ্যা হইয়া যায়, তোমরা আমার সন্তান, তোমাদের সত্য ভঙ্গ হইলে তাহার দায়ী আমি, সুতরাং আজ তোমরা যাহাকে রাজা বলিয়া ডাকিলে সে চিরকালই তোমাদের রাজা হউক”—
বলিয়া বৃদ্ধ ভীলরাজ তাহার লৌহপাত-মণ্ডিত বংশদণ্ড যুবকের হাতে দিয়া বলিলেন—
“আজ হইতে তুমিই এই বন প্রদেশের রাজা হইলে, আমরা তোমার প্রজা,” যাহা বলিলেন তাহার সত্যতা পালনস্বরূপ স্বয়ং বৃদ্ধ তাহাকে অভিবাদন করিলেন—পরে একে একে ভীলগণ সকলেই অভিবাদন করিতে লাগিল—যুবকের কিছুই নূতন মনে হইল না,মনে মনে সে এত দিন সকলেরই প্রভু ছিল, আজ প্রকাশ্যে হইল মাত্র, যুবক রাজারই মত গট হইয়া বসিয়া রহিল। অভিবাদন এক রকম শেষ হইয়া আসিল —কিন্তু ভীলপুত্র অভিবাদন করিল না, দেখিয়া ভীলরাজ বলিলেন—
“বৎস প্রণাম কর ইনি তোমাদের রাজা”
এ অজ্ঞা পিতার আজ্ঞা, রাজার আজ্ঞা, রাজবিদ্রোহ কাহাকে বলে অসভ্যেরা জানে না,—এ আজ্ঞা অবহেলা করিতে ভীলপুত্রের সাধ্য নাই, ভীলপুত্র আস্তে আস্তে অনিচ্ছুক হৃদয়ে মস্তক অবনত করিল।