মিবাররাজ/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 ভীলগ্রাম হইতে কিছু দূরে, ইদর অরণ্যের অপেক্ষা কত নিম্নাংশে সুহারমতী নদীতীরে একলিঙ্গদেবের মন্দির, এই মন্দিরের মৃত পুরোহিতের পত্নী কমলাবতী তাঁহার পুত্র কন্যা দুইটিকে লইয়া এইখানে বাস করেন। পুত্রটিই আমাদের যুবক। যুবকের নাম কি তাহা এখনো বলা হয় নাই, তাহার নাম গ্রহাদিত্য; কিন্তু তাহার মাতা কোন তীর্থ হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় একটী পর্ব্বত-গুহায় তাহার জন্ম হইয়াছিল ইহা হইতে লোকে তাহাকে গুহা বলিয়াই ডাকে। ব্রাহ্মণ-সন্তান হইয়াও গুহার স্বভাব ছেলেবেলা হইতেই নেহাত ক্ষত্রিয়; ছেলে বেলা হইতে সে গ্রামের ভীল ও রাজপুত-সন্তানদিগের সহিত মিশিয়া খেলিয়া বেড়ায়, পাহাড়ের দুরারাহ্য স্থানে ছুটিয়া উঠে, পর্ব্বতের সঙ্কীর্ণ ধার দিয়া, তরবারের মত লক্ লক্ করিতে করিতে শীকারের পশ্চাতে ছুটে; পুত্রের কীর্ত্তি দেখিলে কমলাবতী ভয়ে চেঁচামেচি করিয়া সারা হন, কিন্তু কিছুতেই তাহাকে আঁটিয়া উঠিতে পারেন না, কিছুতেই সে অন্যান্য ব্রাহ্মণসন্তানদিগের মত প্রতিদিন পাততাড়া হাতে বহিয়া, সারাদিন পড়া আওড়াইয়া, আর ভীলদিগের দুঃসাহসিক খেলার দিকে মাঝে মাঝে বিস্ময়পূর্ণ নেত্রে চাহিয়া থাকিয়াই যথেষ্ট সন্তোষ লাভ করে না, সে নিজে তাহাদের মধ্যে এক জন হইতে চায়।

 অনেক বলিয়া কহিয়া কমলাদেবী দিনকতক তাহাকে পাঠশালায় দিয়াছিলেন; কিন্তু সমস্ত প্রভাতটা সঙ্গী বালকদিগকে ছাড়িয়া, ধনুর্ব্বাণ ছাড়িয়া, মুক্ত পাহাড় প্রদেশ ছাড়িয়া একটী সঙ্কীর্ণ স্থানে আবদ্ধ থাকিতে তাহার এতই কষ্টকর লাগিত যে তাহার মাতা বিশেষত দিদির অনুরোধের জন্য নহিলে গুরু মহাশয়েয় সহস্র শাস্তিতেও তাহাকে সেখানে রাখিতে পারি না। তবে এতটা কষ্ট করিয়া যে সে দিদিদের কথা রাখিত, যতটা পারে পাঠশালার নিয়ম ভঙ্গ করিয়া তাহার শোধ তুলিয়া লইত। দুই একটা দৃষ্টান্ত দিই।

 একদিন গুরু মহাশয় ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করিতেছেন কএ আকার দিলে কি হয়? সকলে বলিল ‘কা’। যুবক মাটী হইতে একটা চিল কুড়াইয়া সম্মুখের গাছের একটা কাকের প্রতি লক্ষ্য করিয়া মারিল, কাকটা কাকা করিয়া ভূমিতে পড়িল—যুবক তাহার প্রতি আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিল। গুরু মহাশয় রাগিয়া তাহাকে এক পায়ে দাঁড়াইতে আজ্ঞা করিলেন—কিন্তু ঐরূপ বে-আইনি কাজ করিয়া তখন তাহার এতটা আমোদ হইয়াছিল যে কিছুতেই সে দিন গুরুমহাশয় তাহাকে পাঠশালায় রাখিতে পারিলেন না, অনেক ছাত্রের হাত এড়াইয়া সে দিন সে পলাইয়া গেল।

 এ ঘটনাটি গুহার হাতে-ঘড়ি অবস্থার ঘটনা, সুতরাং গুরুমহাশয় ভাবিলেন, ক্রমে পড়াশুনায় (সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিতেও) তৈয়ার হইয়া আসিলে তাহার এ সব দোষ শুধরাইয়া যাইবে। গুরুমহাশয় নিতান্তই ভুল বুঝিয়াছিলেন—দোষে গুণে সে সমান রূপে তৈয়ার হইতে লাগিল। ব্যাকরণ পড়িতে পড়িতে একদিন সে উক্ত ঘটনা অপেক্ষাও গুরুতর অপরাধ করিয়া বসিল—একটী সূত্র মুখস্থ বলিবার সময় বলিবে—

রলয়োর্ডলয়োস্তদ্বৎ জযয়োর্ববয়োরপি”

 তাহা না বলিয়া বলিল—

“রলয়োর্ডলয়োস্তদ্বং ব্রাহ্মণত্রয়োরপি”

 গুরুমহাশয় প্রায়ই তাহাকে গালাগালি দিয়া বলিতেন, “হতভাগা, ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে ক্ষত্রিয় হলি”—তাই সে সুবিধামত নজীর দেখাইয়া দিল। গুরু মহাশয় মহাক্রুদ্ধ হইয়া পাঠশালার পাশের ঘরে তাহার হাতকড়ি লাগাইয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। খানিকক্ষণ পরে আসিয়া দেখেন—গুহা সেখানে নাই; পশ্চিম দিকের দেয়ালে যে অল্প একটু গর্ত্ত ছিল তাহা মস্ত হইয়াছে, দেয়ালের কতকগুলি বাখারি মেজেতে পড়িয়া আছে—তাহার মধ্যে ধনুকদশা-প্রাপ্ত একখানির গায়ে বাণ স্বরূপ একটা কলম ঝুলিতেছে। ঘরের টাঙ্গান কড়ির-দোলনায় একটিও কড়ি নাই, কড়িগুলা ঘরময় গড়াগড়ি যাইতেছে। বাখারির ধনুকে কলমের বাণ অর্পিত হইয়া যে তাহা এই কড়িগুলার প্রতি এতক্ষণ প্রযুজ্য হইয়াছিল তাহা বুঝিতে গুরুমহাশয়ের বাকী রহিল না—কড়ির উপর দিয়াই যে বাণের লক্ষ্যটা গিয়াছে, ইহাতে তিনি মনে মনে সৌভাগ্য জ্ঞান করিলেন। যাই হোক শাস্তি দিয়া গুহার যে কিছু হইবে না। সেই দিন গুরুমহাশয়ের হৃদয়ঙ্গম হইল। পরদিন গুহা আসিবামাত্র বলিলেন—

 “বাবা উত্তম বলিয়াছ। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ে কিছু মাত্র ভেদ নাই—তুমি স্বচ্ছন্দে গিয়া ক্ষত্রিয় হও, পড়াশুনা তোমার যথেষ্ট হইয়াছে।”

 যুবকের এইরূপ স্বভাবের জন্য এখন পর্য্যন্ত সে উপবীত হয় নাই। কমলাবতী ক্রমাগতই বলেন “আরো কিছুদিন যাক্, ছেলে বুদ্ধিটা ঘুচিয়া বুদ্ধিশুদ্ধি একটু পাকুক তখন উহার পৈতা দেওয়া যাইবে।” কথাটা এই, উপবীত হইবার আগে যা কর তবু সাজে, কিন্তু তাহার পর যুবকের এরূপ ব্যবহার অমার্জ্জনীয় হইবে। এমনিতেই ত আত্মীয় স্বজনের কথার জ্বালায় কমলাবতী অস্থির, তাঁহার পুত্রের মন্দ বুদ্ধির জন্য তাহার যত না মাথা ব্যথা, তাঁহার জাতি কুটুম্ব দিগের ত তদোধিক। অধিক কথা কি, গ্রামের ব্রাহ্মণদিগের রজা সজা বেঁড়ে খুদে ব্যাং প্রভৃতি দুগ্ধপোষ্য যে শিশুগুলি আছে তাহারাও যুবককে দেখিলে আপনার লোকের মমতায় অধীর হইয়া ছিছি করিয়া উঠে, ও নানা রূপ ভঙ্গীতে সুপরামর্শের চোখা চোখা বাক্যবাণ গুলি তাহার উপর বর্ষণ করিতে ছাড়ে না;— সেই মমতার জ্বালায় শশব্যস্ত হইয়া গুহা অপনার লোক দেখিলে এক ক্রোশ দূর হইতে ছুটিয়া পলায়। আপনার লোকদিগের সহিত ত তাহার এইরূপ প্রাণের মিল। বলিতে গেলে, মা ও বোন ছাড়া তাহার আপনার লোকই নাই। অনেকের সঙ্গে সে খেলিয়া বেড়ায় বটে, কিন্তু দিদিই তাহার একমাত্র প্রাণের দোসর, দিদির মত সে কাহাকেও তাহার সুখের সুখী দুঃখের দুঃখী দেখে না, ভীলবালকদিগের সহিত খেলিলে দিদি তাহাকে কখনো বকেন না, শীকারে, খেলায় জয়ী হইয়া আসিলে তাহার অপেক্ষা যেন তাহার দিদির অধিক আনন্দ হয়, মা যদি রাগ করিয়া কখনো ধনুক ফেলিয়া দিতে বলেন, দিদি মাকে অনুনয় করিয়া তাঁহার কথা ফিরাইয়া লয়; দিদি তাহার বড় ভাল, দিদির মত কাহাকেও সে ভাল বাসে না;—দিদি কোন কথা বলিলে কষ্ট করিয়াও সে তাহা পালন করে; (তবে তাহার বিশেষ ভালর জন্য নহিলে কষ্টে রাখিতে হইবে এমন অনুরোধও দিদি করেন না।) তাহার যতটুকু লেখাপড়া হইয়াছে তাহা দিদির জন্যই হইয়াছে। দিদিকে সে এতই ভাল বাসে যে ছেলেবেলা যখন সে বড় দুষ্টুমি করিতেছে যদি কমলাবতী বলিলেন—তবে সত্যবতী তোর দিদি হইবে না—কিম্বা—তাহাকে শ্বশুর বাড়ী পাঠাইয়া দিব” অমনি গুহার খেলা ধূলা দুষ্টুমির শেষ। তাহাকে জব্দ করিবার এমন উপায় আর ছিল না। তবে কমলাবতী ছাড়া এরূপ কথা অন্যে বলিলে আর রক্ষা নাই। একবার অত শত না বুঝিয়া একজন ছেলে তাহাকে এইরূপে ক্ষেপাইতে গিয়া এমন শিক্ষা লাভ করিয়াছিল যে সেই হইতে কেহ কখনো এরূপ কথা কহিতে আর সাহস করে নাই।

 এখন যে সে এত বড় হইয়াছে—এখনো এরূপ ঠাট্টা সহ্য করিতে পারে না, এত সবল হইয়াও এ সম্বন্ধে সে নেহাত দুর্ব্বল, নেহাত শিশু।

 যখন তাহার দিদি প্রথম শ্বশুর বাড়ী যায় তাহার কি কষ্টই হইয়াছিল, দিদি বাড়ী আসিলে তেমনি আনন্দ।

 এবার দিদি বাড়ী আসিয়া অবধি শীকারের ঝঞ্ঝাটে তাহার আনন্দ যে সে পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করিতে পারে নাই, দিদির সহিত প্রাণ খুলিয়া গল্প করিতে পায় নাই ইহাতে তাহার বড়ই কষ্ট হইতেছে, শীকারের মধ্যে, উৎসবের মধ্যে —তাহার অভিষেকের মধ্যেও সে দিদিকে ভুলে নাই, তাহার কাছে ছুটিয়া আসিবার জন্য ব্যস্ত হইতেছে, যখনি তাহার অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ হইল, সে যেন বাঁচিয়া গেল, তখনি ভীলদিগের আদর অভ্যর্থনা হইতে কষ্টে রেহাই লইয়া অধীর চিত্তে সে গৃহাভিমুখী হইল।