মিবাররাজ/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
এত শীঘ্র যে ভীলপুত্র আবার গুহার মুখামুখি হইয়া দাঁড়াইবে খানিকক্ষণ আগে তাহা সে জানিত না। খানিকক্ষণ আগে তাহার স্থিতি গতি সমস্তই একটা অন্ধকার অনিশ্চিতের মধ্যে নিহিত ছিল। পিতার আজ্ঞায় নবঅভিষিক্ত, গুহাকে প্রণাম করিয়া সে যখন অলক্ষ্যে উৎ- সবের জনতা হইতে সরিয়া পড়িল, গভীর যন্ত্রণার একটা গুরুবলে চালিত হইয়া সে যখন দিগ্বিদিক লক্ষ্যহীন হইয়া চলিতে লাগিল, তখন সে জানিত না কোথায় গিয়া তাহার সে গতির অবসান। কেহ জানিতে পারে না; অদৃষ্টের তাড়নার কোথায় গিয়া শেষ কেহ জানিতে পারে না, যখন তারকা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া চলে—উল্কাপিণ্ড কক্ষচ্যুত হইয়া পড়ে, তখন কোথায় গিয়া তাহাদের শেষ তাহারা জানিতে পারে না—ভস্ম হইতে হইতে তবে তাহাদের সে চেতনা জন্মে।
ভীমপুত্রের যখন চেতনা জন্মিল তখন সে মৃত্যুর তীরে; সম্মুখেই পর্ব্বতের শেষ, আর একপদ অগ্রসর হইলে অনন্তের অস্তিত্বে সে তখন বিলীন হইয়া পড়িবে, ভীলপুত্র থমকিয়া দাঁড়াইল—কিন্তু কেন দাঁড়াইল?
সম্মুখের ঐ যে গহবর-চরাচর গ্রাস করিতে মুখ ব্যাদান করিয়া আছে, উহা কি তাহাকে আশ্রয় দিবার জন্য সস্নেহে আহ্বান করিতেছে না, তবে ও স্নেহের ডাক উপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া কেন সে? জীবনে আর তাহার কি আবশ্যক? তাহার পিতার স্নেহ যখন ফুরাইয়াছে—তথন জীবনে আর তাহার কি সুখ? জীবনে এখন যাহা পাইবার আশা নাই, বরঞ্চ মৃত্যুতে এক দিন সে তাহা পাইতে পারে, তাহার মৃতদেহ কোলে লইয়া পিতার এক দিন কাঁদিবার সম্ভাবনা আছে, মৃত্যুতে পিতার স্নেহ এক দিন, ফিরিতে পারে—জীবনে নহে। তবে কি জীবন অপেক্ষা মৃত্যুই তাহার প্রার্থনীয় নয়?
তাহার দুই চক্ষু ভাসিয়া জল পড়িতে লাগিল, সে পাশের গাছের একটা ডাল নুয়াইয়া ধরিয়া ঘূর্ণামান মস্তক তাহার উপর রাখিল; কতক্ষণ এইরূপে কাটিয়া গেল সে তাহা জানে না,—হঠাৎ কার স্পর্শে চমকিয়া—ফিরিয়া দাঁড়াইল, দেথিল মালিক তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া। তাহার মনে হইল সে স্বপ্ন দেখিতেছে। মালিক স্নেহের স্বরে যখন বলিলেন “বাছাডা তোর কি হউছুরে?” তখন ভীলপুত্রের মনের আবেগ আর রহিল না, সে কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল—বাবাডারে মুই তোর কি করুছি, কোন লাগিন মোরে তুই তেয়াগ করিলি?”
সে করুণ স্বর—সে কাতর ক্রন্দন মন্দালিকের হৃদয় বিদ্ধ করিল, তিনি বিচলিত হইয়া পড়িলেন—তিনিই যে পুত্রের কষ্টের কারণ তাহা বুঝিতে পারিলেন, অথচ তাহা হইয়াও যেন উপায় ছিল না, তাঁহার মনে হইল তিনি যেন একটা যন্ত্রমাত্র। তিনি কম্পিত কণ্ঠে অগেকার ভাষায় বলিলেন (আমরা সাদা ভাষাতেই এখন হইতে বলিয়া যাই) “বৎস পিতা হইয়া পুত্রকে কি কেহ ত্যাগ করিতে পারে”
পুত্র বলিল “তবে আমার এ দশা কেন?”
পিতা তাহাকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইলেন, ছোট বেলায় যেমন আদর করিতেন সেইরূপ আদর করিয়া বলিলেন “ও আমার বাছল রে, তালগাছডারে, তোকে আমি ত্যাগ করিব! আপনার সন্তানকে আমি ত্যাগ করিব?” পিতার স্কন্ধে ব্যথিত মস্তক রাখিয়া ভীলপুত্র কাঁদিতে লাগিল, আগেও কাঁদিয়াছিল—এখনো কাঁদিল; এ কান্নায় আর সে কান্নায় কত তফাৎ! এইরূপ পিতার কাঁধে মাখা রাখিয়া, সুখের কান্না কাঁদিতে কাঁদিতে তাহার মরিতে ইচ্ছা হইল,—আর আগেও এক বার মরিতে চাহিয়াছিল, এই দুই রূপ মৃত্যুতে কত তফাৎ!
ভীলরাজ তাহার অশ্রু মুছাইতে মুছাইতে বলিলেন,
“তোর কি সিধু গোয়ালিনীকে মনে পড়ে, মা হইয়া সে সন্তানকে নদীর জলে বিসর্জ্জন দিয়াছিল মনে আছে কি? সন্তানের প্রতি তাহার কি মেহের অভাব ছিল বৎস! তাহাকে ভাসাইয়া সেই শোকে সেও কি প্রাণত্যাগ করে নাই? তবে সে এমন কাজ করিল কেন? সে জানিয়াছিল তাহা দেবতার কাজ, তাহা না করা তাহার ক্ষমতায় নাই, তাহা না করিলে তাহার সন্তানের মঙ্গল নাই। পুত্র, আমিও তোমাদের মঙ্গলের জন্যই, তোদের সত্য রক্ষার জন্যই—দেবতার কার্য্য জ্ঞানে তোমার স্থলে অন্যকে রাজ্য দিয়াছি। কিন্তু আমার হৃদয় আমার স্নেহ সে আর কাহারো নহে, তাহা তোমার জন্যই রহিয়াছে”
“সত্যই কি তবে পিতার স্নেহ তাহারি আছে, ভীলপুত্র কি এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখিতেছিল—মিথ্যা একটা কুহকের মধ্যে ডুবিয়াছিল!”
পিতার সে স্নেহের কথায়, সেই স্নেহের আলিঙ্গনে, দীর্ঘকাল ব্যাপী একটা দুঃস্বপ্ন যেন তাহার হঠাৎ ভাঙ্গিয়া গেল, অনেক দিন পরে একটা মহাঘুম হইতে জাগিয়া উঠিয়া প্রগাঢ় শান্তিতে তাহার হৃদয় ডুবিয়া গেল, সে শিশু কালের নির্ভর ভাবে শিশু কালের বিশ্বাস ভরে পিতাকে জড়াইয়া ধরিয়া নিতান্ত শিশুটির মত বলিল “বাবা আমি রাজ্য চাহি না,—তোর এই বুক আমার থাকিলে আমি কিছুই চাই না আর —”
ভীলরাজ বলিলেন “ইহা ত চিরকাল তোরি আছে বৎস”
ভীমপুত্র পিতার, স্কন্ধ হইতে মুখ তুলিয়া তাঁহার আলিঙ্গন হইতে মুক্ত হইয়া এমনি দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিল—যেন সে তাহার পিতার নিকট কত অপরাধই করিয়াছে—একটু পরে বলিল—
“এতদিন আমি তা বুঝি নাই—আমি মনে করিতাম গুহা আমার শত্রু”
ভীলরাজ একটু থামিয়া বলিলেন “আপনি আপনার শত্রু না হইলে জগতে কেহ কাহারো শত্রু নাই। বৎস এখন ত বুঝিয়াছ গুহা তোমার শত্রু নয়?”
পিতার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, পিতার বুকে আশ্রয় পাইয়া, পিতার স্নেহে পূর্ণ হইয়া, তাহার আর তখন কাহাকেও শত্রু জ্ঞান ছিল না তাই সে বলিতে পারিয়াছিল “আমি মনে করিতাম গুহা আমার শত্রু” তাই সে আবার বলিল—“আমার কেহ আর শক্ত নাই বাবা”
মন্দালিক বলিলেন “বৎস তবে এই মুহূর্ত্তে তাহাকে মিত্র বলিয়া আলিঙ্গন করিয়া এস, সময় চলিয়া গেলে এ ভাব নাও থাকিতে পারে। এখন এ শুভ সময়ে যাহাকে মিত্র বলিবে, পরে আর তাহাকে শত্রু মনে হইবে না”
অনেক কষ্টের পর, অনেক দিনের পর ভীলপুত্রের হৃদয় প্রেমের সুখে পূর্ণ, উথলিত, বিশ্ব সংসারকে প্লাবিত করিতে যেন ব্যগ্র, গুহা সেই বিশ্ব সংসারের একজন, গুহাকে কেন সে তাহার প্রেমের ভাগ না দিবে, সে অকুণ্ঠিত চিত্তে আবার বলিল “সে আমার শত্রু নয় বাবা—আমি তাহাকে আলিঙ্গন করিব”
মন্দালিক বলিলেন “তবে এখনি যাও বৎস, এ মুহুর্ত্ত অবহেলা করিও না”
যাইবার আগে ভীলপুত্র পিতাকে আর একবার আলিঙ্গন করিল।
দুই এক পদ গিয়া সে আবার থামিয়া দাঁড়াইল—ফিরিয়া জিজ্ঞাসা কৱিল—“বাবা ডা একটা কথা মনে হইল, গুহা ত রাজা হইবার নয়”
ভীলরাজ বিস্মিত হইলেন—বলিলেন “এ কথা কেন পুত্র! তোমার কি এখনো রাজ্যলোভ আছে? আমি রাজ্য ছাড়িতে পারিলাম তোর এখনো রাজ্যে লোভ”!
সে ক্ষুন্ন হইয়া বলিল “তুই রাজ্য ছাড়িলি—আমি রাজ্য চাহিব! আমি কেবল শুধাই এই, গুহা ব্রাহ্মণ পুত্র, তবে সে রাজা হইবে কিরূপে? তুই ত বলিয়াছিস— রাজ পুরুষ না হইলে মোদের বংশে কেহ রাজা হইতে পারে না”—
ভীলরাজ একটু নিস্তব্ধ হইয়া থাকিয়া বলিলেন “তবে শোন। গুহা ব্রাহ্মণপুত্র নহে, রাজপুত্র। উহাকে রাজ। করিলে আমাদের নিয়ম ভাঙ্গে না।”
ভীলপুত্র বিস্মিত হইয়া পিতার প্রতিধ্বনির মত বলিল। “গুহা ব্রাহ্মণপুত্র নহে, রাজপুত্র”!
ভীলরাজ বলিলেন “হাঁ”
তবু যেন তার সন্দেহ ঘুচিল না—সে আবার বলিল “গুহা ব্রাহ্মণ পুত্র নহে? গুহা তবে কমলাবতীর সন্তান নহে?”
ভীলরাজ বলিলেন “না কমলাবতী উহার কেহই নহে, প্রতিপালিকা মাত্র”। ভীলপুত্র আর কোন কথা কহিল না, একবার চারিদিকে বিস্ময়নেত্রে চাহিয়া দেখিল,—চারিদিকে আর সব ঠিক আগেকার মত আছে কি না, বুঝি তাহার সন্দেহ জন্মিল; তাহার পর আস্তে আস্তে গন্তব্য পথে পদক্ষেপ করিল। মন্দালিক বলিলেন “গুহা ভীল গ্রামে নাই, মন্দিরের পথ ধর”
ভীলপুত্র মন্দিরের পথে নামিতে নামিতে, মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া সেই উচ্চ ভূমির দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল —অনেক দূর পর্য্যন্ত তাহার পিতার স্থির মূর্ত্তি ছবির মত তাহার চোখে পড়িতে লাগিল।