মিবাররাজ/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ।

 ভীলগ্রাম দূরে পড়িয়া গেল, উৎসবের কোলাহল স্তব্ধতায় মিলাইয়া পড়িল, ভীলপুত্র নিস্তব্ধ বিজন পথে আসিয়া পড়িয়া যখন আবার উপর দিকে চাহিল আর পিতাকে দেখিতে পাইল না, যে উচ্চ ভূমিতে পিতা দাঁড়াইয়াছিলেন—দেখিল তাহা অদৃশ্য হইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ বড় যেন তাহার একাকী বলিয়া মনে হইল, বড় যেন একটা শূন্যতা তাহার মনের মধ্যে আসিয়া পড়িল, যে উৎসাহরাশি, যে স্নেহ রাশি সঙ্গে লইয়া সে চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল চারিদিকের বিজনতার মধ্যে সে সব যেন সে হারাইয়া হারাইয়া চলিতে লাগিল। অবসর পাইয়া নানা রূপ ভাবনা তাহাকে আক্রমণ করিল, পিতার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, তাঁহার আলিঙ্গনে বদ্ধ হইয়া তাঁহার কথা গুলির যেরূপ স্নেহময় মূর্ত্তি দেখিয়াছিল, এই দুশ্চিন্তায় পেষিত হইয়া তাহারাও বিকৃত হইয়া পড়িতে লাগিল,—ক্রমশ ভীল পুত্রের মনে হইতে লাগিল, “গুহার সঙ্গে তাহার মিত্রতার জন্য পিতা যে এত উৎসুক তাহা কি গুহার মঙ্গল জন্যই নহে, এ উপায়ে গুহার পথের কণ্টক দূর করাই কি তাঁহার অভিপ্রায় নহে?”—পিতার প্রতি কথা তলাইয়া তাহাতে এখন সে গুহার প্রতিই তাঁহার মেহের ভাব দেখিতে লাগিল।

 যে হৃদয়ে একবার সন্দেহ প্রবেশ করিয়াছে, অবিশ্বাসের আঘাতে যে হৃদয় একবার ক্ষত হইয়া পড়িয়াছে, সে হৃদয় প্রতি মুহূর্ত্তে স্নেহের শীতল স্পর্শ অনুভব করিতে না পারিলে, অবিরত স্নেহের আশ্বাস বাণীরূপ ঔষধের প্রলেপ না পাইলে—একেবারে আরোগ্য লাভ করিতে চাহে না, সে ক্ষত পুনঃ পুনঃ ফিরিয়া দেখা দেয়।

 পিতার স্নেহের বাঁধন হইতে দূরে আসিয়া পুত্রের ভাঙ্গন ধরা বিশ্বাস আস্তে আস্তে খসিয়া পড়িতে লাগিল, কিছুতেই সে তাহা ধরিয়া রাখিতে পারিল না, তাহার মনের মধ্যে একটা নৈরাশ্যের আগুণ হুহু করিয়া উঠিল। এই নৈরাশ্য লইয়া এই কষ্টের মন লইয়া কেমন করিয়া সে এখন গুহাকে আলিঙ্গন করে! যে প্রেমের ভাব হৃদয়ে ধরিয়া সে গুহাকে বন্ধু বলিতে আসিতেছিল —সে ভাব ত তাহার এখন নাই, তবে এখন সে কি করিবে? এই কথা বলিতে আবার কি পিতার নিকট সে ফিরিয়া যাইবে? ভীলপুত্র পীড়িত ক্লিষ্ট হইয়া পড়িল, তাহার চিন্তা ভার লইয়া সে যে একেবারে মন্দিরের নিকটে উপস্থিত হইয়াছে তাহা সে জানিতে পারে নাই, হঠাৎ গুহার কুপিত স্বর তাহার কানে প্রবেশ করিল—সে দাঁড়াইল,— শুনিল “লোকে তোমাদিগকে পর বলিবে?—যদি আমি মানুষ হই, ত এত দিন এই যে বাণ পশু বক্ষ বিদ্ধ করিয়াছে। ইহা সেই দিন সেই হতভাগার শোণিত পান করিবে—”

 ভীলপুত্র আগুণ হইয়া উঠিল, এ কথা মন্দালিককে লক্ষ্য করিয়া যে বলা হইয়াছে এ বিষয়ে তাহার সন্দেহ মাত্র রহিল না। মন্দালিক এ কথা যখন তাহাকে বলিয়াছেন, নিঃসন্দেহ আর এক জনকেও বলিয়াছেন গুহা তাহা শুনিয়া এইরূপ বলিতেছে। তিনি ছাড়া এ কথা কেহ জানে না, কেহ বলিতেও সাহস করিবে না।

 ভীলপুত্র যে জন্য আসিয়াছিল একেবারে ভুলিয়া গেল, এখন তাহার শত্রু তাহার পিতারও শত্রু, স্পষ্ট করিয়া তাহাকে শত্রু বলিয়া ডাকিতে আর তাহার সঙ্কোচ রহিল না। গুহা যখন তাহার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল—তাহার ক্রুদ্ধ মুখ-ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিল গতিক বড় ভাল নহে, রাজ্য পাইয়া সে যে তালগাছের শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহা বুঝিল—বলিল—“কেন ডাকিলি, কথাটা কি?”

 ভীলপুত্র উত্তর করিল “কথাডা—তুইটা কাল সপ্প কেউটা, গোখরা”!

 যুবক ঠাট্টার ছলে কথাটা উড়াইতে গিয়া বলল “এই কথার জন্য এতদূর কষ্ট করিয়া আসিবার ত আবশ্যক ছিল না”

 ভীলপুত্র বলিল “তুইডার মুণ্ডপাতের আবশ্যক ছিল?

 যুবক বলিল “তালগাছটা, অত উঠিসনে, একটু খাট হ। তো হতেই আমি রাজা, এখন রাগ করিলে চলিবে কেন রে?”

 ভীলপুত্র বলিল “আরে রাক্ষস ডা—যানাড়া তোমারে রাজা করিল মোর সেই বাবাডারে তুই মারিতে চাস! যেইডার খাও তুমি—সেইডারে ছোবল”।

 এ কি কথা! মান্দলিককে যুবক মারিতে চাহে! যে তাহাকে রাজ্য দিয়াছে, পিতার স্নেহ দিয়াছে তাহাকে যুবক মারিবে! এ কি অপবাদ! যুবক বুঝিল এইরূপ অপবাদ তুলিয়া কৌশলে মন্দালিককে তাহার শত্রু করানই ভীলপুত্রের উদ্দেশ্য। সরোষে ঘৃণার স্বরে গুহা বলিল—

 “পাষণ্ড মিথ্যাবাদী”

 ভীলের সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল,—এমন গালাগালি তাহাদের আর নাই, সে লাল জবাফুলের মত চক্ষু বাহির করিয়া বলিল—

 “মুই ডা মিথ্যাবাদী! তুই বাবারে মারুতে চাহিলি মুই ডা মিথ্যাবাদী। কমলাবতী তুইডার কেউ না—তুই তানাডারে মিথ্যা মা কয়ে আসিলি—মুইডা মিথ্যাবাদী!”

 যুবক বলিল “চুপকর বর্ব্বর, কমলাবতী আমার মা” ভীল পুত্র বলিল—“চুপ করিতে হয় তুই ডা চুপ কর, মুই ডা একশ বার বলিবু কুমলাদেখী তোর মা না, সত্যবতী তোর দিদি না—তুই ডা তানাদের কেউ না”

 তাহার কথা একটু বাধিল না, স্পষ্ট স্পষ্ট কথায় সত্যের মূর্ত্তি যেন তাহার কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হইল, যুবক মুহূর্ত্তের জন্য নির্ব্বাক নিস্পন্দ হইয়া পড়িল, সেই কঠিন কথাগুলা তাহার মাথার মধ্যে ঘুরপাক দিয়া বেড়াইতে লাগিল, —সেই সঙ্গে দিদির শেষ কথাটিও মনে আসিয়া —পড়িল দিদি কি বলিতে বলিতে থামিল? “কি—সত্যি”—কি সত্যি? —ভীলপুত্র যাহা বলিতেছে তাহাই কি? যুবক কি যেন হইয়া পড়িল।

 ভীলপুত্র বলিল “এই কথার লাগিন—তুইডা বাবারে মারিতে চাহিলি—মুইডা আসিছি—ধনুডা ধর—

 যুবক আত্মস্থ হইয়া বলিল —“তুই মন্দালিকের পুত্র না হইলে অনেক আগে ধনুক ধরিতাম’— ভীলপুত্র তীব্র বিদ্রুপের হাসি হাসিয়া বলিল “বাবাডারে মারিতে পার—ছেলেডারে মারিতে নার? বড়ই ন্যাকা পাইছ! ধনু উটারে কালসপ্পডা!”

 যুবক তাহার প্রতি অবজ্ঞার কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন “মরিতে এতই ইচ্ছা হইয়া থাকে শেষ প্রহরে জ্যোৎস্নার সময় ভীলগ্রামের দক্ষিণ মাঠের পুকুর তীরে বড় গাছের নীচে আমাকে পাইবি। এখন অন্ধকার— অন্ধকারে ন্যায়যুদ্ধ হয় না—

 ভীলপুত্র বলিল “কথাডা বেশ। মুইড সামনে মাঝারি গাছটার তলায় থাকিব”—

 ভীলপুত্রের কথা শুনিবার জন্য না দাঁড়াইয়া যুবক মন্দিরের দিকে দ্রুতপদে অগ্রসর হইল—দিদির শেষ কথাটা শুনিবার জন্য সে অত্যন্ত উৎসুক হইয়া পড়িয়াছিল—তাহার উপর যেন তাহার জীবন মৃত্যু নির্ভর করিতেছে।