মিবাররাজ/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ।
যখন বিষন্ন উৎসুক ভ্রাতার মুখের দিকে সজল দৃষ্টিতে চাহিয়া সত্যবতী কম্পিতকণ্ঠে বলিল—“ভাই সত্যই আমরা তোমার আপনার লোক নই” তখন মৃত্যুদণ্ডের মত যুবকের কর্ণে তাহা ধ্বনিত হইল, মুহূর্ত্তের জন্য তাহার জীবনের স্রোত যেন বন্ধ হইয়া গেল, ইন্দ্রিয় জ্ঞান লুপ্ত হইয়া পড়িল, কে যেন তাহাকে হঠাৎ পাষাণে অভিশপ্ত করিয়া রাখিয়া গেল। সত্যবতী বড় ভীত হইল, আকুল ভাবে গুহাকে কোলে টানিয়া কাঁদিয়া বলিল—“গুহা”—
ধীরে ধীরে গুহার মাথা দিদির কোলে লুটাইয়া পড়িল, —দিদির কোলে মুখ লুকাইয়া শিশুর মত গুহা কাঁদিতে লাগিল, সত্যবতীও কাঁদিতে লাগিলেন, ভাই বোনের অশ্রুজলে নিস্তব্ধ নিশাকাল সে দিন সিক্ত হইয়া উঠিল। সেই দিন সেই হৃদয় বেদনার মধ্যে, অশ্রুজলের মধ্যে গুহা তাহার জীবন কাহিনী শুনিতে পাইল। যাহা শুনিল তাহার সংক্ষেপ মর্ম্ম এই।
কনক সেন নব-কোটের (আধুনিক লাহোর। রামপুত্র নব কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলিয়া নব-কোট) সূর্য্যবংশোদ্ভব এক রাজপুরুষ। তিনি কোন কারণে (অনুমান ১৪৪ খৃষ্টাব্দে লাহোর হইতে সৌরাষ্ট্রে আগমন করিয়া এখানকার প্রমর বংশীয় এক রাজার রাজ্য গ্রহণ পূর্ব্বক সেই রাজ্যে বীরনগর রাজধানী স্থাপন করেন। ইহার প্রপৌত্র পুত্র বিজয় সেনের রাজ্যকালে কনক সেনের এই স্থাপিত রাজ্য আরো বিস্তৃতি লাভ করে। বিজয় সেন সমগ্র বিদর্ভ অধিকার করিয়া বিজয়পুর (বিজাপুর) বল্লভীপুর প্রভৃতি কয়েকটি নুতন রাজধানী স্থাপিত করেন। শেষে বীরনগরের পরিবর্ত্তে বল্লভীপুরই সুর্য্যবংশী রাজাদিগের রাজধানী হইয়া উঠে।
কমলাবতীর পিত্রালয় বীরনগর। তাঁহার পিতৃবংশ সুর্য্যবংশী রাজাদিগের কুলপুরোহিত ছিলেন।
সৌরাষ্ট্রের শেষ রাজা শিলাদিত্যের অন্তঃস্বত্ত্বা মহিষী প্রমর-বংশীয় রাজকন্যা পুষ্পবতী চতুর্দ্দশ বর্ষ পূর্ব্বে তাঁহার ভাবী পুত্রের মঙ্গলকামনায় অস্বাভবানীর পূজা দিতে পিত্রালয় চন্দ্রবতী গমন কালে, রাজপুরোহিত সপরিবারে— একমাত্র ভ্রাতৃকন্যা কমলাবতী, তাহার স্বামী ও একটি শিশুকন্যা—এই লইয়া মহিষীর সঙ্গে গমন করেন।
চন্দ্রবতী গিয়া রাণীর মনস্কামনা সিদ্ধ হইল, দেবী তাঁহার ভাবী পুত্রকে শুভ বর প্রদান করিলে, মহিষী হৃষ্ট চিত্তে অল্প দিনের মধ্যেই আবার শ্বশুরালয়মুখী হইলেন।
বল্লভীপুর হইতে চন্দ্রবতীর পথে পাহাড় শ্রেণী অতিক্রম করিতে হয়, একদিন বিকালে পাহাড়ের একস্থানে শিবিকা রাত্রের জন্য থামিলে মহিষী ও কমলাবতী সুখের দুঃখের নানা কথা কহিতে কহিতে পাহাড়ে একসঙ্গে বেড়াইতে লাগিলেন, সঙ্গে সঙ্গে লোক আসিতেছিল হুকুম পাইয়া তাহারা শিবিরে ফিরিয়া গেল, তাঁহারা দুই জনে একাকী শিবির ছাড়াইয়া খানিকটা দূরে আসিয়া পড়িলেন,—নিকটেই গাছ পালার মধ্যে একটা ভগ্ন মন্দির, দেখিয়া তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন, মহিষী মন্দির দেখিলেই পুত্রের মঙ্গল কামনায় দেবতা উদ্দেশে সেখানে প্রণত হইতেন।
এই জরাজীর্ণ, অশ্বথশিকড় প্রবিষ্ট ভগ্ন মন্দিরের গুহা মাত্র অবশিষ্ট ছিল; এই গুহা প্রবেশ কালে তাঁহারা গুহার অপর পার্শ্বে ভগ্ন প্রাচীরের পর পারে কয়েক জন লোকের মস্তক দেখিতে পাইলেন, তাহাদের লক্ষ্য না করিয়া তাঁহারা মন্দিরে প্রবেশ করিয়া মহাদেবকে প্রণাম করিলেন, প্রণাম করিয়া মহিষী যখন বাহিরে আসিবেন হঠাৎ তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, সর্ব্বঙ্গ কঁপিয়া উঠিল,— অপর পার্শ্বের লোকদিগের কি কথা তাঁহার কাণে প্রবেশ করিল, তিনি সেই খানে মন্দিরের অশ্বখমুলে মাথা ধরিয়া বসিয়া পড়িলেন, কমলাবতীকে আস্তে আস্তে বলিলেন “উহারা কি বলিতেছে শোন দেখি” কমলাবতীও তাহাদের কথা কিছু কিছু শুনিয়াছিলেন, তিনি কম্পিতচরণে মন্দির ঘুরিয়া তাহাদের নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“বংস তোমরা কোথা হইতে আসিতেছ? মহারাজ শিলাদিত্যের কথা কি বলিতেছিলে?
তাহারা যখন বুঝিল রমণী বীরনগরের লোক তখন তাঁহার কাছে কিছুই লুকাইল না, কিন্তু যাহা বলিল তাহাতে তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল। শুনিলেন তাতাররা দেশ আক্রমণ করিয়া শিলাদিত্যকে বধ করিয়াছে, সৌরাষ্ট্র এখন তাহাদের, মহিষীগণ অগ্নি প্রবেশ করিয়াছেন, দেশের লোক পলায়নে প্রাণরক্ষা করিতেছে।”
অবসন্ন কমলাবতী প্রাণপণে গাছে ঠেশ দিয়া দাঁড়াইলেন, শোকাপন্না মহিষীকে রক্ষা করিতে হইবে—এই চিন্তামাত্র তাঁহাকে আসন্ন মুর্চ্ছার হাত হইতে রক্ষা করিল— এই বলে বলীয়ান হইয়া তাঁহার ঘূর্ণ্যমান মস্তক প্রাণপণে উন্নত রাখিয়া আকুল স্বরে বলিলেন “মহারাজ পরাজিত হইয়াছেন! তাহার সপ্তাশ্ব”?
উত্তর হইল “মহারাজের মন্ত্র নিষ্ফল হইয়াছে। তাঁহার আজ্ঞায় সপ্তাশ্ব উঠিল না; শত্রুরা সূর্যকুণ্ডে গোপনে গোরক্ত ঢালিয়াছিল।”
কথিত আছে, সূর্য্য-বরে বল্লভীপুরের দুর্গ মধ্যে এই কুণ্ডের উৎপত্তি হয়,—বর এই, বিপন্ন রাজা মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া ডাকিলেই সূর্য্যদেব সপ্তাশ্ব রথে এই কুণ্ড হইতে উথিত হইয়া শত্রুকূল ধ্বংশ করিবেন, কিন্তু যে দিন একবিন্দু রক্ত এই কুণ্ডে পতিত হইবে সেই দিন মন্ত্র ব্যর্থ হইবে।
কমলাবতী সেখান হইতে যখন রাণীর নিকট কিরিয়া আসিলেন তখন রাণী সংজ্ঞাহীন, তিনি যে সমস্ত কথাই শুনিয়াছেন কমলাবতী বুঝিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে সেই গুহাতেই রাণীর সন্তান জন্মিল, নব শিশুকে কমলাদেবীর হস্তে সমর্পণ করিয়া তিনি প্রাণত্যাগ করিলেন, পর্ব্বতেই তাঁহার অগ্নিকার্য্য সমাধা হইল। পুরোহিত সপরিবারে চন্দ্রবতী-সন্নিহিত নিভৃত ইদর-অরণ্য প্রদেশে বসতি স্থাপন করিলেন।
সত্যবতীর কথা শেষ হইলে বড় বড় দুই ফোঁটা জল গুহার কপোল বাহিয়া মাটীতে পড়িল,—
গুহা বলিল “দিদি এ কথা তবে এতদিন লুকাইয়া রাখিয়াছিলি কেন?”
সত্যবতী বলিল “মৃত্যুকালে তোমার মা আমার মাকে দুই একটি অনুরোধ করিয়া যান, প্রধান এই, যেন কোন ক্ষত্রিয়ানীর সহিত তোমার বিবাহ হয়, আর তোমার চতুর্দশ বর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত তোমাকে যেন ব্রাহ্মণরূপে প্রতিপালন করা হয়। তোমার সামর্থ্য জন্মিবার আগে ক্ষত্রিয় বলিয়া জানিলে শত্রু কর্ত্তৃক পাছে তোমার কোন অনিষ্ট হয়—বোধ করি এই আশঙ্কায় মহিষী এই অনুরোধ করিয়া থাকিবেন। আমাকে পর্য্যন্ত মা এতদিন ইহা বলেন নাই, এবার এখানে আসিয়া মাত্র আমি এ কথা জনিয়াছি।”
দিদি এবার আসিয়া পর্য্যন্ত মাঝে মাঝে কেন যে এমন বিষন্ন হইয়া পড়িত—হাসিতে হাসিতে সহসা কেন তাহার হাসি শুকাইয়া যাইত, খেলা করিতে করিতে কেন অবসন্ন হইয়া ঘরে চলিয়া যাইত, আদর করিতে করিতে মাঝখানে কেন সে থামিয়া পড়িত—গুহা এখন তাহার কারণ বুঝিল। খানিকক্ষণ পরে বলিল—
“যদি এ কথা আর কেহ জানে না তবে ভীলপুত্র জানিল কি করিয়া?”
সত্যবতী বলিল “তোমাদের বংশের একটি কুলাচার এই, প্রথম অস্ত্র শিক্ষাকালে একজন রাজপুরুষ স্বহস্তে কুমারের কটিদেশে অসি বন্ধন করিয়া দেন, তাহা ধারণ করিয়া তখন তাহার অস্ত্র শিক্ষায় অধিকার জন্মে। তোমার অষ্টম বর্ষ স্বয়ঃক্রমে এই নিয়ম রক্ষা করিতে মহিষী মাকে বলিয়া যান। তাঁহার এই কথা পালন করিবার জন্য তোমার জন্মের কথা ভীলরাজকে মায়ের জানাইতে হয়, —কেননা ভীলরাজদিগের পবিত্র অভিষেক অস্ত্র রাজপুরুষের অঙ্গ ছাড়া সাধারণ অঙ্গ স্পর্শ করে না। তোমার, এয়োদশ বৎসর না গত হইলে এ কথা কাহাকে তিনি বলিবেন না প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন,—এখন সময় পূর্ণ হইয়াছে—তাই এ কথা তাঁহার পুত্রকে বলিয়া থাকিবেন”—
গুহা চুপ করিয়া রহিল —বুঝিল ভীলপুত্র দোষী নহে সে নিজেই দোষী।