মিবাররাজ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

 আঁধার সন্ধ্যা, আকাশে চন্দ্র নাই, গাছ পালায় ঢাকাঢাকা ক্ষুদ্র ভীলগ্রাম কাল একটা ছায়া মণ্ডলীর মধ্যে লুকাইয়া পড়িয়াছে, অদূরে ঈষদুচ্চ শিখর প্রদেশে বসিয়া ভীমপুত্র সেই ছায়ার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছে, তাহার আগ্রহপূর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিধার অন্ধকারের অবরণ যেন ভেদ করিয়া ভীলগ্রামের প্রত্যেক কুটীরগুলি প্রত্যেক গাছটি পর্য্যন্ত ভীলপুত্রের সম্মুখে উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে।

 গ্রামের মধ্যস্থলে—বড় রাস্তার সম্মুখে, তরুশ্রেণীর মধ্যে তাহাদের পাতায় ছাওয়া কুটীরখানি; এতক্ষণ কুটীরে আলো জ্বলিয়াছে, এতক্ষণ তাহার সঙ্গীরা সারাদিনের আমোদ আহ্লাদের পর শ্রান্তসুরে গান গাহিতে গাহিতে বাড়ী ফিরিতেছে, পথিমধ্যে তাহাদের বাড়ীর কাছে আসিয়া পড়িয়া একবার করিয়া তাহার নাম ধরিয়া ডাকিতেছে, উত্তর না পাইয়া হয়ত বা তাহার মায়ের কাছে গিয়া তাহার খোঁজ লইয়া যাইতেছে। মা এতক্ষণ গৃহের কাজকর্ম্ম সারিয়া তাহার বোনটির চুল বাঁধিতে বসিয়াছেন, অন্য ছেলেরা ভূতের গল্প শুনিবার জন্য তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিতেছে, মাদলা মায়ের আঁচলটা ধরিয়া টানিতেছে, ভুলু বোনের বিনুনিটা ধরিয়াই নাড়িয়া দিতেছে, ছোটীয়া খেলা করিতে করিতে ‘বলনা’ করিয়া আচমকা মায়ের পিঠের উপর আসিয়া পড়িতেছে,—বোন খাপা হইয়া উঠিয়া মাঝে মাঝে তাহাদের মারিতে হাত উঠাইয়াছে। বাবা এই গোলমাল হইতে দূরে অস্ত্রশালার রোয়াকে বসিয়া এতক্ষণ অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করিয়া তুলি বার উদ্যোগ করিতেছেন, ভীলপুত্র আজ গৃহে নাই, তিনি একাকী, সে থাকিলে সে তাঁহার সহায়তা করিত! গৃহের এ সময়ের খুঁটিনাটি ব্যাপার—খুটিনাটি ছবি তাহার মনে পড়িতে লাগিল—একটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস তাহার মর্ম্মস্থল হইতে উথলিত হইল, সে দুই হাঁটুর উপর বাহুর মধ্যে মাথা রাখিয়া চোখ বুজিল। অনেকক্ষণ পরে যখন আবার চোখ খুলিয়া মুখ তুলিল তখন আর সন্ধ্যা নাই, তখন নূতন তারকা রাশিতে আকাশ ছাইয়া পড়িয়াছে, তখন দ্বিপ্রহরের অন্ধকারের বুকে একটা গম্ভীর আলোক জ্বল জ্বল করিয়া উঠিয়াছে, প্রকৃতি স্তব্ধ গাম্ভীর ঘুমন্ত, ভীলগ্রামের অস্পষ্ট কোলাহলও তখন আর এই নিভৃত প্রদেশকে তরঙ্গায়িত করিতেছে না। এই স্তব্ধ ঘুমন্ত নিশীথে দু একটা পেচক ও বাদুড় কেবল তাহাদের চীৎকার কোলাহল ও অশান্তি জাগরণ লইয়া ভীলপুত্রের মাথার উপর দিয়া চলিয়া গেল—আর ভীলপুত্র তাহার অশ্রুজল ও মর্ম্মবেদনা লইয়া এখনো জাগিয়া বসিয়া। নির্ব্বাণের পূর্ব্বে দীপ যেমন জ্বলিয়া উঠে তাহার এ জাগরণ বুঝি সেইরূপ অনন্ত ঘুমের পূর্ব্ব-জাগরণ!

 ভীলপুত্র সাশ্রুনয়নে আবার ভীলগ্রামের দিকে চাহিল—একটা অদম্য বাসনায় সে আকুল হইয়া পড়িল—এখন বাড়ীর সকলে নিদ্রিত,—এখন একবার তাহাদের সে কি দেখিয়া আসিতে পারে না? তাহারা ত তাহা জানিতেও পারিবেন না। ভীলপুত্র শিখরদেশ হইতে নামিয়া তাহার পাদদেশে বিচরণ করিতে লাগিল, হঠাৎ চমক ভাঙ্গিয়া দেখিল গৃহের প্রাঙ্গনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, যেন কি একটা দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে—থমকিয়া দাঁড়াইয়া চারিদিক ভয়ে ভয়ে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল, কিন্তু সম্মুখেই জল, তখন আর পিপাসা থামাইবার সাধ্য নাই, অতি সন্তর্পণে গৃহের নিকট আসিয়া ঝাঁপে হাত দিল, আস্তে টানিবা মাত্র ঝাঁপ খুলিয়া আসিল, বুঝিল তাহার জন্য এখনো ঝাঁপ বন্ধ হয় নাই। তখন পা টিপিয়া গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া নিস্তেজ দীপের আলোকে চারিদিক চাহিয়া দেখিল—মা ছোট ছেলেদের লইয়া গভীর নিদ্রায় মগ্ন, কিন্তু পিতা সেখানে নাই। নিরাশ হৃদয়ে, শয্যা পার্শ্বে আসিয়া— উথলিত, আবেগ বহুকষ্টে চাপিয়া নিস্তব্ধে মাকে প্রণাম করিয়া তাহার সর্ব্ব কনিষ্ঠ বড় স্নেহের ঘুমন্ত ভাইটির মুখ চুম্বন করিল, অমনি দুই বিন্দু অশ্রু তাহার গাল বাহিয়া শিশুর গালে পড়িল,—ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া হঠাৎ শিশু সশব্দে হাসিয়া উঠিল, জানি না সে অশ্রুম্পর্শে শিশু হৃদয়ে কি স্বপ্ন জাগিয়া উঠিল। অন্য সময় হইলে ভীলপুত্র কত না আল্লাদে তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিত, আজ হাসি শুনিয়া সে ভীত হইল,ঘরে দাঁড়াইতে আর তাহার সাহস হইল না—ধীরে ধীরে দ্বারাভিমূখে সে পদ নিক্ষেপ করিল, এই সময় তাহার মা একবার অস্ফুটস্বরে ‘তালগাছ’ বলিয়া ডাকিয়া উঠিলেন—ভীলপুত্র চমকিয়া তাড়াতাড়ি ঘরের বাহির হইয়া পড়িল—বুঝি এইবার সে ধরা পড়ে। কিন্তু তখনি বুঝিল তাহার মা জাগিয়া ডাকেন নাই, তাহা তাঁহার ঘুমন্ত ডাক। বাহিরে আসিয়া আর সে নয়নজল রাখিতে পারিল না—তাহার বুকফাটা নিস্তব্ধ অশ্রুজলের মধ্যে সেই কুটীর, সেই কুটীরের মধ্যে যে সব স্নেহ মমতা ফেলিয়া আসিয়াছে সেই সব ভাসিতে লাগিল, আর সে ঘরের মধ্যে যাহাকে খুঁজিয়া পায় নাই যাহাকে দেখিবার জন্য বড় ব্যাকুল হইয়া আসিয়াছিল তাহাকে একবার দেখিবার জন্য অধীর হইয়া পড়িল।

 পিতা কোথায়? তাঁহার ঘুমন্ত মুখখানি একবার শেষ বার দেখিতে পাইবে না? ভীলপুত্রের নয়নে অন্ধকার-হৃদয়ে মর্ম্ম যাতনা, সে অস্ত্রশালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আস্তে আস্তে সেই দিকে গমন করিল, অনেক সময় মন্দালিক সেই ঘরেই শয়ন করিতেন। গৃহের প্রাঙ্গন পার হইয়া রোয়াক দিয়া অস্ত্রশালায় যাইতে হয়, ভীলপুত্র প্রাঙ্গন ছাড়াইয়া রোয়াকে আসিয়া দেখিল অস্ত্র শালার ঝাঁপও ঈষৎ খোল, গৃহ মধ্যে একটী দীপও মিটমিট করিতেছে, গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতে যেন তাহার আর সাহস হইল না, খোলা ঝাঁপের মধ্য দিয়া একটু খানি মুখ বাড়াইয়া সে ঘরে উঁকি মারিল,—তাহার মুখের ছায়া গৃহমধ্যে পড়িল-মন্দালিক তখনো জাগিয়াছিলেন, আহলাদের স্বরে বলিয়া উঠিলেন—“তালগাছটা বুঝি এত্তটা দের কেন হইলু রে”।

 তালগাছ চমকিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল—মন্দালিক তাহার সম্মুখে আসিয়া পড়িলেন, আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন—“তালগাছটা” কি হইল রে—

 এই উত্তর এড়াইবার জন্যই তালগাছ সমস্ত সন্ধ্যা এখানে আসে নাই। তাহার মনে ছিল পর দিন তাদের একজনের মৃতদেহই পিতাকে ইহার উত্তর দিবে; তাহার আগে একথা পিতাকে বলিতে তাহার সাহস নাই—এ কথা শুনিলে এ যুদ্ধে পিতা বাধা দিবেন এই তাহার ভয়, —ভীমপুত্র নিরুত্তর স্তব্ধ হইয়া রহিল।