মিবাররাজ/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

 পুত্রকে নিরুত্তর দেখিয়া মন্দালিক ভাল বুঝিলেন না, ব্যস্ত হইয়া বলিলেন—“চুপ কি লাগিন্ রে—কি হইলু বলরে বেটা”—

 আর কতক্ষণ ভীলপুত্র পিতার জিজ্ঞাসায় নিরুত্তর থাকিবে? তাহার সকল সঙ্কল্প বৃথা হইল, দুই হাত সবলে বুকে আঁটিয়া নতদৃষ্টি উন্নত করিয়া সবল মুক্তকণ্ঠে তখন সে বলিল—“বাবা গুহাটা কালসপ্প, মুইডা তার মিত হইতে নারিল—শত্রু হয়ে আসছি। মোর শত্রু হইলে সব পারিত মুই—সেডা যে তোর শত্রু”

 “তার শত্রু হয়ে আসছি”—অর্থাৎ তাহাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিয়াছি। মন্দালিক হঠাৎ যেন আকাশ হইতে পড়িলেন—“তুইড তার শত্রু হ’য়ে আসিছিস্?”—

 আবার দৃঢ়স্বরে উত্তর হইল—“হুঁই”—

 মন্দালিক কাতর দৃষ্টিতে চাহিয়া একটু পরে বলিলেন—“মুইডার সে শত্রু কোনডা বলিল তোরে—

 মন্দালিকের সে কথা বিশ্বাস হয় নাই। সে কথা এতই অসম্ভব। পুত্র বলিল—“তুই খাঁটি কথা বলিলি—সে লাগিন সেইডা তোরে মারিতে চাহিল—কালসপ্পডা জানিল না মোরে আগে না মারিলে তা হইবুর নয়”—

 সে যাহা শুনিয়াছিল খুলিয়া বলিল। সমস্ত কথা মন্দ।— লিকের একটা ধূঁয়া—একটা অন্ধকার একটা যেন ভ্রান্তি বলিয়া বোধ হইল—গুহা তাঁহাকে মারিতে চাহিবে—একথা কেমন করিয়া তাঁহার বিশ্বাস হইবে, —অথচ পুত্রের প্রত্যেক কথা বৃশ্চিক হুলের ন্যায় তাঁহার হৃদয়ে বিদ্ধ হইল, শীতল হিমময় রাত্রে তাহার কপাল ঘর্ম্মসিক্ত হইয়া উঠিল—তিনি কম্পিত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলিলেন—

 “মোরে মারিতে চাহিল গুহাডা! বেশ মুইকে তার শোধ নিতে দে —তুইডা কিছু করুস্ না —মোর কথাড। রাখ্”—

 একবার দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিয়া তাহাতে নিরস্ত হওযাই ত কাপুরুষতা, তাহার উপর সে থাকিতে কিনা পিতার অপমানের শোধ পিতা লইতে যাইবেন।

 ভীলপুত্রের প্রদীপ্ত চক্ষু অন্ধকারের মধ্যেও জ্বলিয়া উঠিল—সে উত্তেজিত কণ্ঠে ঈষৎ তীব্রস্বরে বলিল—“বাবাডা মুই যে ধনু ধরিবার কথাডা দিয়ে আসিছি তা ভুললু নাকি? আর মুই থাকিতে তুইডা শোধ লইবি?”

 এই যুদ্ধ হইতে পুত্রকে যে সহজে নিরস্ত করিতে পারিবেন না তাহা মন্দালিক জানিতেন—তিনি অনুনয়ের স্বরে আবার বলিলেন “বেটারে শোন তুইডা—তোর কথা ফিরাইতে হইবু না, সেইডাই কথা ফিরাইবে—তুইডা ক্ষমা কর শুধু। সেডা মোরে মারিতে চাহে নাই, কথার কথাডা কি বলিল—সে লাগিন সে ক্ষমা চাহিবে—তুইডা ক্ষমা কর”—

 এখনো সেই স্নেহ। যে তাহাকে বধ করিতে চাহে—তাহার প্রতি এখনো এত স্নেহ এত ভালবাসা! আর ভীলপুত্র তাঁহার জন্য যে প্রাণ দিতে যাইতেছে—তাহার জন্য কি একটা মমতার কথাও নাই? একটা যন্ত্রণার বিদ্যুৎ তালগাছের হৃদয় যেন ভস্ম করিয়া দিয়া গেল,—একটুখানি আগে মরিবার জন্য তাহার যে কষ্ট হইয়াছিল তা আর বিন্দু মাত্র রহিল না, মরিবার আগেই সে মরিয়া গেল, তাহার প্রেতযোনী—তাহার প্রবৃত্তি মাত্র তাহার দেহ যেন অধিকার করিয়া রহিল।

 হায়! মানুষ বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে কতবার মরিয়া যায়—কেহ কি জানিতে পারে?

 তালগাছ তীব্রকণ্ঠে কম্পমান শরীরে বলিল—“মুইডা চলি, তুইডা মোরে ক্ষমা কর —কথাটা যা দিয়ে আসিছি— মুই ফিরাইতে নারিবু। মুইডা যা শুনিয়া আইল—ঠিক শুনিয়া আইল”।

আগেকার তালগাছ হইলে এমন করিয়া পিতার অমতে কথা কহিতে পারিত না—এমন করিয়া আর কখনো কথা কহে নাই। বলিয়াই সে তীরবেগে বাহির হইয়া গেল— মন্দালিক তাঁহার চিন্তাভার লইয়া সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 “সত্যই কি গুহা তাহাকে মারিতে চাহিয়াছে? যুবক—যাহাকে তিনি রাজ্য দিয়াছেন, স্নেহ দিয়াছেন—যাহার জন্য নিজের পুত্রের প্রতি তিনি সত্যই অন্যায় করিয়াছেন —সে তাঁহাকে মারিতে চাহিয়াছে? তাহার ভালবাসার, স্নেহের এই প্রতিশোধ?”

 মর্মান্তিক কষ্টে তাঁহার বুক ফাটিয়া উঠিল। মন্দালিক গুহাকে যে পুত্রাপেক্ষাও ভাল বাসেন তাহা এখন সুস্পষ্ট রূপে বুঝিলেন, আগে তাঁহার নিজের মনের ভাব নিজের কাছেই লুকান ছিল তাই সে দিন না বুঝিয়া তালগাছকে আর এক রকম বলিয়াছিলেন। তিনি কাতর হইয়া এখন মনে মনে বলিলেন—

 “গুহাটারে তুই আমাকে মারিবি, মার্ তবে, আমি নিজেই গিয়া তোকে বুক পাতিয়া দিতেছি, এ জন্য অন্যের সহিত যুদ্ধ করিয়া নিজের হানি করিবি কেন”—

 এখনো তাঁহার সন্দেহে বিশ্বাস জড়িত, এখনো তাঁহার কষ্টে আশাপূর্ণ, এখনো তাঁহার মনে হইতে লাগিল—গুহা যদিই বা না বুঝিয়া কিছু বলিয়া থাকে মন্দালিককে দেখিলে অনুতপ্ত হৃদয়ে নিশ্চয়ই সে ক্ষমা চাহিবে,—তিনি বলিলে তাঁহার পুত্রের নিকটেও ক্ষমা চাহিয়া যুদ্ধ হইতে নিরস্ত হইবে।”

 এই বিশ্বাস তাঁহার গভীর স্নেহের ফল—এই বিশ্বাস তাঁহার ক্রোধের অতীত, প্রতিশোধ স্পৃহার অতীত স্বার্থহীন পবিত্র ভালবাসার ফল, তাই তিনি যখন ভাবিলেন গুহা তাঁহাকে মারিতে চাহিয়াছে—তাঁহার দুঃখ হইল, অভিমান উথলিয়া উঠিল— রাগ হইল না, তিনি অভিমানের উচ্ছাসে—স্নেহের বিশ্বাসে নীত হইয়া দ্রুতবেগে যুবকের বাড়ীর দিকে গমন করিলেন।