মিবাররাজ/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।
চাঁদ উঠিয়াছে, জ্যোৎস্না হইয়াছে, তবু চারিদিক মলিন, চারিদিক আচ্ছন্ন, গাছ পালার মধ্যে, গাছ পালার ছায়ার মধ্যে, পাহাড়ের শারদীয় শেষ প্রহরের কুয়াসার মধ্যে জ্যোৎস্না যেন কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, ভীলপুত্রের ম্রিয়মান বাষ্পাকুল দৃষ্টির দিকে চাহিয়াই যেন প্রকৃতির হাসিমুখ সহসা এমন মলিন হইয়া পড়িয়াছে, প্রভাতের তরুণ অরুণ জাগিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে ভীলপুত্রের এ নয়ন বারি যখন শুকাইয়া যাইবে তখন ধরণীর মুখও আবার প্রফুল্ল হইয়া উঠিবে। নিরাশায় সতেজ, যন্ত্রণা ভারে উত্তেজিত, বিহ্বল ভীলপুত্র এই কুয়াসার মধ্য দিয়া দ্রুতপদে নির্দ্দিষ্ট গাছ তলায় আসিয়া থামিল। ইহার কিছু আগে হইতেই গুহা রাস্তার পরপারে পুকুরের ধারের বড় গাছের নীচে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, থামিবামাত্র তাঁহার অস্পষ্ট প্রতিকৃতি ভীলপুত্রের নজরে পড়িল, অমনি হঠাৎ একটা জ্বলন্ত আগুণ তাহার সর্ব্বাঙ্গে হুহু করিয়া ব্যাপ্ত হইল, ধনুক খুলিয়া হাতে উঠাইয়া ধরি- বার সময় হাত টলমল করিয়া উঠিল। তালগাছকে দেথিয়া গুহা কথা কহিল, কিন্তু রণোদ্যত শত্রুর ক্রুদ্ধ কর্কশ স্বরের পরিবর্ত্তে গুহার স্বাভাবিক তেজস্বী স্বর তালগাছের কর্ণে প্রবিষ্ট হইল। গুহা বলিল—
“তালগাছ একটু অপেক্ষা কর—ধনুক ধরিবার আগে আমি যে কথা বলিতে আসিয়াছি শোন।”
এখনো আগেকার মত অনুজ্ঞা! কিন্তু এখন আর আগেকার সে ভীলপুত্র নহে। ভীলপুত্র আরো ভাল করিয়া ধনুর্ব্বাণ কসিয়া ধরিল,—তাহার পর তাহার ভাষায় কম্পমানকণ্ঠে বলিল—
“ধনুক উঠারে কাপুরুষ এখন কণার সময় নহে, তুই প্রাণভয়ে এত কাতর, আমি নির্ভয়ে তোর কাছে প্রাণ লইয়া আসিয়াছি।”
ভীলপুত্রের হস্ত তাহার প্রতি উন্মুখ হইল, গুহার ধনুক ধরিবার মাত্র অপেক্ষা। তখন গুহাও ধনুক উঠাইয়া বলিলেন তবে তাহাই হউক, এ হত্যার দোষ কিন্তু আমার নাই।”
বলিয়া তীর নিক্ষেপ করিলেন, কখনো যাহা হয় নাই আজ তাঁহার অটল হাত কাঁপিয়া গেল। সমকালে ভীলপুত্রের বাণও সবেগে নিক্ষিপ্ত হইল, হঠাৎ একটা আর্ত্তনাদ রাত্রের বিজনতা বিদীর্ণ করিয়া আকাশে উথলিয়া উঠিল, ভীলপুত্র হঠাৎ বজ্রাহত হইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।