মিবাররাজ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।
নিভ নিভ মলিন-জ্যোৎস্নাদীপ্ত কুয়াসার অন্ধকারের মধ্যে একটা আর্ত্তনাদ উঠিয়া হারাইয়া গেল, গুহা সেই হারান স্বর অনুসরণ করিয়া ধাবিত হইলেন। রাস্তার যেস্থল হইতে ধ্বনি উখিত হইয়াছিল—সেই স্থলে আসিয়া কাহাকেও দেখিলেন না, পথের এদিক ওদিক অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। পার্ব্বত্যপথ, কোথায় উঁচু, কোথায় নীচু, কোথায় বিস্তৃত প্রান্তর, কোথায় ঘন তরু শ্রেণীর মধ্যে পাহাড়ের পাষাণ দেয়ালের মধ্যে আঁকাবাঁকা সঙ্কীর্ণ স্থান, যাহা দেখিতে নিকটে মনে হয়, ছুটিয়াও সেখানে অগ্রসর হওয়া যায় না, চীৎকার করিয়াও কাহারো সাড়া মিলে না, কেবল নিজের প্রতিধ্বনি দ্বিগুণ বেগে কাণে আসিয়া লাগে। এই অবস্থায় যুবক দ্রুতপদে আকুলহৃদয়ে পাহাড়ের এদিক ওদিক অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, অবশেষে ফিরিয়া ঘুরিয়া পূর্ব্বোক্ত স্থলের নিকটে আসিয়া ছোট ছোট গাছড়ার জঙ্গলের মধ্যে একটি যেন অস্পষ্ট মনুষ্য কায়া দেখিতে পাইলেন, তাহা জঙ্গলের অন্ধকারে এত মিশাইয়া পড়িয়াছে, যে ইহার নিকট দিয়া পূর্ব্বে যাতায়াত করিয়াছেন, তবু ইহা নজরে পড়ে নাই। গুহা নিকটে আসিয়া দেখিবামাত্র সত্যই একটি রক্তমাখা মনুষ্যদেহ দৃষ্টিপথে পড়িল। সেই অস্ফুট চন্দ্রালোকেও গুহা মন্দালিকের অজ্ঞান মূর্ত্তি চিনিতে পারিলেন, আহত স্থান হইতে রক্ত উথলিয়া উঠিয়া তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ আপ্লুত করিয়াছিল। তীব্র যাতনায় আহত হইয়া গুহা করুণ-কণ্ঠে চীংকার করিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িলেন, কাতরভাবে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিলেন—সাড়া পাইলেন না। তবু তখনো জীবন আছে বলিয়া মনে হইল—শীঘ্র যদি রক্তের উচ্ছাস বন্ধ করা যায় ত এখনো হয়ত বাঁচিতে পারেন। গুহা সব্যগ্রে নিজের পরিধেয় বস্ত্রের অর্দ্ধভাগ ছিঁড়িয়া যত দূর পারিলেন রক্ত মুছাইয়া, চর্ব্বিত দুর্ব্বাঘাস দিয়া ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিলেন, তাহার পর রাস্তার পারে যে পুষ্করিণী তলে দাঁড়াইয়া তিনি তীর ছুড়িয়াছিলেন, তীর বেগে সেইখানে ছুটিয়া চলিলেন। উঠিবার সময় ভীলরাজের নিকটে একটি তীর পতিত দেখিতে পাইলেন—দেখিলেন তাহা ভীলপুত্রের তীর, গুহা শিহরিয়া সেখান হইতে ছুটিয়া চলিয়া গেলেন। গুহার তীরে যে মালিক আহত হয়েন নাই, এই চিন্তায় তাঁহার পীড়িত ক্লিষ্ট হৃদয়েও শান্তির উদয় হইল—উথলিত হৃদয়ে অন্তরের সহিত বারবার করিয়া মনে মনে গুহা মহাদেবকে প্রণাম করিলেন।