মিবাররাজ/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ।

 মান্দলিক গুহাদের বাড়ী গিয়া সেখানে তাহার দেখা পাইলেন না, তিনি সেখানে পেঁছিবার আগেই গুহা গৃহের বাহির হইয়া গিয়াছে। সুতরাং তৎক্ষণাৎ তিনিও সেখান হইতে ফিরিলেন। ফিরিবার সময় দুর্ভাগ্যবশতঃ অন্য পথে না গিয়া উল্লিখিত বিজন পথ দিয়াই তিনি গমন করিতেছিলেন, হঠাৎ প্রতিদ্বন্দীদিগের মধ্যস্থলে আসিয়া বাণহত হইয়া, পার্শ্বের জঙ্গলে পড়িয়া গেলেন। পাঠকগণ এখন বুঝিয়াছেন, তালগাছ তাঁহার চীৎকার ধ্বনি শুনিয়াই মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল। যখন তাহার সে মূর্চ্ছা ভাঙ্গিল, তথন সব কথা তাহার মনে নাই। এই নির্জ্জন স্থানে একাকী আপনাকে পড়িয়া দেখিয়া যেন অবাক হইয়া গেল, ক্রমে অল্পে অল্পে গুহার সহিত দ্বন্দযুদ্ধের কথা মনে পড়িল, ভাবিল বাণহত হইয়া এইখানে পড়িয়া আছে—উঠিয়া কোথায় আঘাত লাগিয়াছে—অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল, কিন্তু যখন দেখিল তাহার সর্ব্বশরীর অক্ষত তখন আরো বিস্মিত হইয়া মনঃসংযম পূর্ব্বক আবার ভাবিতে আরম্ভ করিল। হঠাৎ সেই করুণ চীৎকার ধ্বনি তাহার কর্ণে যেন ধ্বনিত হইল, সমস্ত কথা মনে পড়িয়া গেল, আর সে দাঁড়াইল না, উন্মত্তের মত দ্রুতপদে চারি দিক অন্বেষণ করিতে করিতে সেই জঙ্গলে উপমীত হইয়া যখন রক্তাক্তদেহ, নীরব, দৃষ্টিহীন, অজ্ঞান পিতাকে ভূপতিত দেখিতে পাইল, তখন সমস্ত বিশ্বসংসার তাহার চতুর্দ্দিকে প্রচণ্ডবেগে যেন ঘুরিয়া উঠিল। সেই ঘূর্ণাপাকের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া একটা জীবন্ত পাষাণ মূর্ত্তি— সবলে মর্ম্মে মর্ম্মে আলোড়িত বিদারিত হইতে লাগিল, তাহার জ্ঞান আছে অথচ সে অজ্ঞান, তাহার জীবন আছে, অথচ সে মৃত, তাহার অনুভবের ক্ষমতা আছে—অথচ সে বলহীন পাষাণের ন্যায় যন্ত্রণাকাতর হইয়া কাঁদিয়া বিদীর্ণ কণ্ঠে “বাবাডারে” বলিয়া ডাকিয়া অজ্ঞান মন্দালিকের গলা জড়াইয়া ধরিল—সে কাতরতায় আকাশ পাতাল নেন বিচলিত হইয়া পড়িল—কিন্তু মন্দালিক কেমন অবিচলিত, যেমন নিস্তব্ধ, তেমনি রহিলেন, পুত্র আজ কাঁদিয়া কাঁদিয়া ডাকিয়া ডাকিয়া পিতার ঘুম ভাঙ্গাইতে পারিল না! তিনি আজ অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত। সহসা মন্দালিকের নিকটস্থ ভূমিন্যস্ততীর শোকোন্মত্ত পুত্রের চক্ষে পড়িল,—সে তীর তাহারি তীর—আপনার হাতে আপনার পিতাকে সে তবে বধ করিয়াছে! আর সে পারিল না, তাহার দীর্ণ বিদীর্ণ হৃদয়ভূমি সবেগউথিত আগ্নেয় বিপ্লবে চূর্ণ বিচূর্ণ খণ্ড বিখণ্ড হইয়া দূর দূরান্তরে যেন ছুটিয়া পড়িতে লাগিল—অনন্ত যাতনাভরে সে উঠিয়া দাঁড়াইল, অনন্ত যাতনায় উন্মাদ হইয়া দ্রুতবেগে ছুটিয়া পাহাড়-শিখর হইতে নিম্নে ঝাঁপাইয়া পড়িল। সহসা নিম্নোত্থিত মৃদু কোলাহলে এক— বার চারিদিক যেন ঈষৎ কাঁপিয়া উঠিল, সহসা গাছে গাছে পাখীগুলি একবার জাগিয়া উঠিয়া যেন শোকগীতি গাহিয়া উঠিল, তাহার পর আবার চারিদিক পূর্ব্বের নিস্তব্ধতার মগ্ন হইয়া গেল।

 ভীল পুত্র যখন পিতার নিকটে আসিয়াছিল, গুহা তখন সেখানে ছিলেন না, তিনি উষ্ণীষ ভিজাইয়া ফিরিয়া আসিয়া আর তালগাছকে দেখিতে পাইলেন না, অল্পক্ষণের মধ্যেই সকল অবসান হইয়া গিয়াছে।

* * * *

 মন্দালিককে বাঁচাইবার জন্য গুহা যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন, প্রাণপণে শুশ্রুষা করিতে লাগিলেন, ক্ষীণ চাঁদ নিভিয়া গেলে, শ্যামল মধ্যস্থ লোহিত শতদলের ন্যায় কুয়াসার মধ্য দিয়া অরুণ-রেখা-রঞ্জিত পূর্ব্বগগণ যখন ফুটিয়া উঠিল, তখনো গুহা তাহার শুশ্রুষা করিতে ক্ষান্ত হইলেন না, তখনো আর্দ্র উষ্ণীয-জল নিঙড়িয়া মন্দালিকের মুখে দিতে লাগিলেন। কিন্তু যখন সূর্যালোক মন্দালিকের মৃত মুখের উপর পড়িল, তখন গুহার চমক ভাঙ্গিল, ধীরে ধীরে গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া আর্দ্র উষ্ণীষ ভূমিতে ফেলিয়া দিয়া হতাশ দৃষ্টিতে তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন—এক দিন আগে মালিক তাঁহাকে কত স্নেহের কথা বলিয়াছেন—আজ তিনি নীরব, —এক দিন আগে তিনি কি ছিলেন, আজ তাঁহার কি দশা! একটা তীব্র অনুতাপের ভাবে তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইল, তিনিই কি অনেকাংশে এই মৃত্যুর কারণ নহেন? তিনিই কি তালগাছকে দ্বন্দ যুদ্ধে উওেজিত করেন নাই? যদি উত্তেজিত করিলেন তবে থামাইতে পারিলেন না কেন? থামাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন সত্য—কিন্তু সে কি সেরূপ চেষ্টা! তেমন চেষ্টা করিলে কি তাহাকে দ্বন্দ যুদ্ধ হইতে থামাইতে পারিতেন না? না পারিতেন— নাই পারিতেন—তেমন চেষ্টা করিলেন না কেন? তালগাছের কথায় ধনুক উঠাইবার পরিবর্ত্তে কেন তাহা তাহার সম্মুখে ভূমে ফেলিয়া দিলেন না—শূন্য হস্ত হইয়া কেন তাহাকে বলিলেন না—“নিরস্ত্র আত্ম চেষ্টায় অক্ষম ব্যক্তিকে মারিতে তা মার— আমি ধনুক উঠাইব না”, তাহা হইলে কি আর তালগাছ তীর নিক্ষেপ করিতে পারিত? তাহা হইলে কি আর পুত্র হইয়া সে পিতার হন্তারক হইতে পারিত?

 গুহা “আকুল হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, “হায় হায়! কি করিলাম, তাহাকে উত্তেজিত করিলাম আর থামাইতে পারিলাম না? থামাইতে ইচ্ছা করিলাম—অথচ চেষ্টা করিলাম না, ধনুক উঠাইয়া ধরিলাম—কেন তাহার পরিবর্ত্তে তাহার পদতলে ভূমে তাহা ফেলিয়া দিলাম না? গুহা শিহরিয়া পিতৃ-হন্তারক তীরের দিকে আর একবার চাহিয়া দেখিলেন—চমকিয়া উঠিলেন, —অন্ধকারে যাহা দেখিতে পান নাই, প্রভাতালোকে তাহা সুস্পষ্ট দেখিলেন— দেখিলেন তীর রক্তহীন,—কম্পিত হস্তে তাহা হাতে উঠাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন, সম্প্রতি দেহ বিদ্ধ করিবার লক্ষণ তাহাতে কিছুই দেখিলেন না। সংশয়ে গুহার মন পূর্ণ হইল, সংশয় ক্রমে দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর হইতে লাগিল, গুহা উঠিয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিলেন,—অদূরে আর একটি সূর্য্যালোক ঝলসিত তীর দেখিতে পাইলেন, নিকটে গিয়া দেখিগেন তাহা রক্তাক্ত,—নিজের তীর গুহা চিনিতে পারিলেন। কার হাতে, মন্দালিক মরিয়াছেন, আর সংশয় রহিল না। হায় হায়! কি করিলেন, নিজের হাতে নিজের পিতৃসম বন্ধুকে তিনি হত্যা করিলেন! গুহার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।