মুক্তি-পথে/প্রথম অঙ্ক/তৃতীয় দৃশ্য

তৃতীয় দৃশ্য
[ সরোজের বৈঠকখানা ]
কাল—অপরাহ্ণ।
[ সরোজ, বিপিন, দিলীপ ]

 সরোজ—এ অপমান কিছুতেই সহ্য করা যায় না। একটা গুড়ের দালাল দর্শনকে অপমান করল, ভাষাকে অপমান করল, কবিতাকে অপমান করল। এর একট প্রতিকার করতেই হবে। যত দালাল, পাটোয়ার, বেনে—এরাই হোলো সত্য! কিছুতেই নয়। একমাত্র ব্রহ্মই সভ্য, জগৎ মিথ্যা।

 বিপিন—আর এক মুহূর্ত্ত বিলম্ব করা উচিত নয়। এসে আমরা এই বাটপাড়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।

 দিলীপ—ঐ আমি দিব্য চক্ষুতে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ঐ—ঐ ভারতের জাতীয় সভ্যতার মন্দির ভাঙতে আরম্ভ করেছে। এক্ষুণি হয় ত মড়মড় করে ভেঙে পড়বে। আর না, চণ্ডীদাস, এস, এস, তোমার ঐ নয়ন ভুলান মূর্ত্তি নিয়ে—এক প্রবল ভাবের বন্যায় বাঙ্গালীর তথা সমগ্র ভারতবাসীর আবিলতা ভাসিয়ে নিয়ে যাও।

 সরোজ—তা’ হলে উদ্দেশ্য যখন আমাদের সকলেরই এক, তপন এস, আমরা এক নতুন সমাজের সৃষ্টি করি। আমাদের সমিতির নাম হোক “বঙ্গীয় কৃষ্টি সাধন সমিতি।” উদ্দেশ্য, এই জড়বাদীদেব বিরুদ্ধে লড়াই। এই সমগ্র জড় জগৎটাকে ধ্বংস করতে হবে।

[ কল্যাণকুমারের প্রবেশ ]

 কল্যাণ—তা কখনই পারবেন না। এই লোহা-লক্কড়ের যুগে জড়জগৎকে একেবারে বাদ দেওয়া চলে না। এ যুগ হচ্ছে শক্তি-পরীক্ষার যুগ। যে বীর, যে শক্তিশালী, সেই টিকে থাকবে এ যুগে। যদি শক্ত হয়ে, যোগ্যতম হয়ে বেঁচে থাকতে চান তবে—

সরোজ—তোমার আবার মতলবখানা কি?

কল্যাণ—আমার মতলব অতি মহৎ। আপনি কি জানেন না এমন একদিন আসবে, যেদিন মানুষকে জরা, বাৰ্দ্ধক্য, মৃত্যু এসে গ্রাস করবে? সেদিন অতি নিশ্চিত, অতি ধ্রুব। এদের হাত থেকে উদ্ধার পেতে হলে—

সরোজ—সোজা উপায় হচ্ছে সংসারের অনিত্যতা সম্বন্ধে চিস্তা করা। বুদ্ধদেব, শঙ্করাচার্য্য, শ্রীচৈতন্য এদেরই আদর্শকে অনুসরণ করা।

কল্যাণ—দেখুন, সরোজ বাবু, অনেক ভেবে চিন্তেই বাপ, মা আমার নাম রেখেছিলেন কল্যাণকুমার! তাই আমি ঘরে ঘরে ফিরি কল্যাণের বার্ত্তা নিয়ে; দুঃস্থ বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে উদাত্ত কণ্ঠে বলে বেড়াই, বাঙ্গালীর এই দুঃখ-দৈন্যের একমাত্র প্রতিকার জীবন-বীমায়।

দিলীপ—ভ্যালা বিপদ দেখছি! এক গুড়ের দালালের জ্বালায় অস্থির, আবার এসে জুটল জীবন-বীমার দালাল। ষড়যন্ত্র, ভীষণ ষড়যন্ত্র! বেঁচে থাকে বিদ্যাপতি, বেঁচে থাকো চণ্ডীদাস!

[ প্রকাশ বাবুর প্রবেশ ]

প্রকাশ—এই যে সকলেই হাজির দেখছি। কবি ভায়ার খবর কি? বিদ্যাপতির চর্চা হচ্ছে—না চণ্ডী ঠাকুরের?

দিলীপ—দ্যাখো প্রকাশ, ভগবান তোমার ঐ দেহখানাকে তৈরী করেছেন কতকগুলো শুকনো হাড় দিয়ে। ওতে মেদ নাই, মাংস নাই। মাত্র নীরস দেহখানা পড়ে আছে। চণ্ডীদাস বিদ্যাপতির নামে তুমি নাসিকা কুঞ্চন কর। ঐ দেখ নবীন ভারত বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসকে সোনার সিংহাসনে বসিয়েছে। ঐ দেখ—

“নব বৃন্দাবন, নবীন তরুগণ, নব নব বিকশিত ফুল।
নবীন বসন্ত, নবীন মলয়ানিল, মাতল নব অলিকুল॥”

নীরস, শুষ্ক তুমি, এই মধুর পদাবলীর ভাবাবেগ তোমার ভাল লাগবে কেন?

এস, আমাদের এই 'কৃষ্টি-সাধন সমিতি’র সভ্য হয়ে ভারতের লুপ্ত কৃষ্টি, লুপ্ত সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার কর।

প্রকাশ—রক্ষা কর বাবা! তোমাদের ঐ সৎকার-সমিতির সভ্য হয়ে এত তাড়াতাড়ি পটল তুলতে আমি মোটেই রাজি নই।

দিলীপ—আচ্ছা, না হয় দিন কতক পরেই হয়ো চল আজ সন্ধ্যায় চিত্রায় “চণ্ডীদাস’ দেখে আসি।

কল্যাণ—যে বাঙ্গালীকে একটি পয়সা রোজগার করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, থিয়েটার বায়স্কোপ দেখা কি তার পক্ষে মহা পাপের কাজ না? জীবন-বীমা! বাঙ্গালীর মুক্তির যদি কোন পথ থাকে, তবে সে জীবন-বীমা। আসুন, এই লোহা-লক্কড়ের যুগে, জীবনসংগ্রামের প্রবল প্রতিযোগিতার যুগে যদি বাঁচতে চান, তবে দর্শন ছাডুন, কবিতা নদীর জলে ভাসিয়ে দিন, Cinema ঘরগুলিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করুন।

প্রকাশ–(স্বগতঃ) দুনিয়াটা বেশ কিন্তু চলছে! (প্রকাশ্যে) ভায়া সরোজ, যদি বাঁচতে চাও তবে দালালটাকে সরিয়ে দাও। নইলে কিন্তু এখুনি নিজের কাজ হাসিল করে খাতা-পত্রে নাম সই করিয়ে নেবে। ভারি চালাক এই দালালের দল!

কল্যাণ—দেখুন সরোজ বাবু, আমাদের এই নতুন নিয়মটা। বেঁচে থেকেও লাভ, আর মৃত্যু-অস্তে ত কথাই নেই!

প্রকাশ—(স্বগতঃ) তাত হতেই হবে। এ যে বিদেশী কোম্পানী, দেশী কোম্পানীগুলো যে সব পুড়ে গিয়েছে।

দিলীপ—

“আওল ঋতুপতি—রাজ বসন্ত।
ধায়ল অলিকুল মাধবী পন্থ
† † † † † † † †
চন্দ্রাতপ উড়ে কুসুম পরাগ।
মলয়-পবন সহ ভেল অনুরাগ।”

অপূর্ব্ব, অপূর্ব্ব, চমৎকার! শুনলে সরোজ, ঋতুরাজ বসন্তের কি সুন্দর বর্ণনা!

কল্যাণ—কোম্পানীর এই নতুন নিয়মটা বেশ করে ধীর হয়ে চিন্তা করে দেখুন। ১০০০৲ টাকা দেবেন। আর পাবেন ২৫০০৲ টাকা। এখনও সময় আছে। বয়স গেলে আর হবে না।

দিলীপ—শোনো আর একখানা মহাজন পদাবলী,—রসে একেবারে টইটুম্বুর—

“(আজি) কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম

কাণের ভিতর দিয়া  মরমে পশিল গো

আকূল করিল মোর প্রাণ।”

রমেশ দত্ত মহাশয় এর ইংরাজী তর্জ্জমা পর্য্যন্ত করেছেন।

সরোজ—আমাকে বাঁচাও ভাই প্রকাশ! এদের নিয়ে আমি আবার 'কৃষ্টি-সাধন সমিতি’ গড়তে চলেছি।

দিলীপ—[সরোজের দিকে অগ্রসর হইয়া জনাস্তিকে] আমাকে ভুল বুঝে না ভায়া। তোমার মন যাতে ওই জড়-বাদী জীবন-বীমার দালালের কথায় না টলে সেই জন্যেই আমি কবিতা-রস সেচন করে একে শক্ত করে দিচ্ছি। মনে থাকে যেন আমাদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। লোহা-লক্কড়ের বিরুদ্ধে এ আমাদের কঠোর যুদ্ধ। আজ আমাদের জীবনমরণ সমস্যা।
 সরোজ–সাবাস কবি, সাবাস! তাই ত বলি, তুমি কি আমাদের বিরুদ্ধে যেতে পার? দালাল মহাপ্রভু, এখন আপনি আসুন। আমাদের একটু কাজ আছে।

 কল্যাণ—আচ্ছা আর একবার আসবো।
[ প্রস্থান]

 প্রকাশ–আচ্ছা আমিও আসি সন্ধ্যাও হয়ে এল।

[ প্রস্থানোদ্যত]

 সরোজ—তা' হলে চল। আমরাও এইখানে শেষ করি। আমাদের প্রস্তাব ঠিক ত?
 দিলীপ—নিশ্চয়! নিশ্চয়!! তবে আমাদের ‘কৃষ্টি-সাধন সমিতির প্রথম নম্বর জয় কিন্তু এই আজই হল।
 সরোজ—নিশ্চয়ই। বীমার দালাল আর ফিরছে না।

[ সকলের প্রস্থান]