মুক্তি-পথে/প্রথম অঙ্ক/প্রথম দৃশ্য

মুক্তি-পথে

প্রথম অঙ্ক

দ্বিতীয় দৃশ্য

প্রাতঃকাল

প্রকাশ বসুর বৈঠখখানা।

 [প্রকাশ বসু একমনে একখানি খবরের কাগজ পড়িতেছেন এমন সময় একরাশ কাগজপত্র লইয়া সরকার মশায়ের প্রবেশ।]

 প্রকাশ—মোট কতখানা দরখাস্ত এসেছে, সরকার মশায়?

 সরকার—আজ্ঞে, তা প্রায় শ' চারেক হবে।

 প্রকাশ—কি রকম বুঝছেন? কি কি ধরণের লোকের দরখাস্ত আছে?

 সরকার—এদের মধ্যে এম-এ, বি-এ, অনেকেই আছেন। তবে ম্যাটিক পাশই বেশী।

 প্রকাশ—এম-এ, বি-এ, আমার কোন দরকার নেই। এদের ভিতর থেকে বেছে ৪৫ জন ম্যাট্রিক ঠিক করুন। বয়স কুড়ি কিংবা একুশের বেশী যেন না হয়। আফিসের কাজে কিছু অভিজ্ঞতা থাকলে ভাল হয়। তবে ফাষ্ট ডিভিশনে পাশ হওয়া চাই-ই।

 সরকার—আজ্ঞে, একজন এম-এ, পাশ ভদ্দর লোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বোধ হয় এই কাজের জন্যই।

 প্রকাশ—তাই নাকি? আচ্ছা তাঁকে ডাকুন। যা বলবার আমি বল্‌ছি। মার্চেণ্ট অফিসে এম-এ, বি-এ, পাশ করা কেরাণীর কি দরকার?

[ সরকার মশায়ের প্রস্থান; ও একজন যুবককে লইয়া পুনঃ প্রবেশ। ]

 যুবক—নমস্কার!

 প্রকাশ—নমস্কার!

 প্রকাশ—আপনার নাম?

 যুবক—আজ্ঞে আমার নাম নীহাররঞ্জন ভট্টাচার্য্য। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি বড় দুঃস্থ। এম্‌-এ. পাশ করে বসে আছি। আমাকে যদি দয়া করে আপনার অফিসে একটা কাজ দেন—

 প্রকাশ—দেখুন, আমাদের সামান্য কারবার। এতে ম্যাট্রিক পাশ হলেই যথেষ্ট। তারপর আপনাদের মত অত বেশী লেখাপড়া জানা ভদ্রলোক যদি এই সামান্য চাকুরির দিকে ঝোঁকেন তবে যাঁরা সামান্য লেখাপড়া শিখেছেন তাঁদের উপায়টা কি হবে, বলুন? সে দিকটাও বিবেচনা করবেন তো?

 যুবক—আপনার কথায় প্রতিবাদ করতে আমি চাই না। তবুও বলি যোগ্যতার দিক দিয়ে হয় ত—

 প্রকাশ—দেখুন, আমাদের এই সওদাগরী অফিসের কাজ—এ হাতীও না, ঘোড়াও না,—বাঁধা-ধরা কাজ। দিন কতক করলেই যাঁরই একটু সাধারণ জ্ঞান আছে, তিনিই এ কাজ বেশ চালিয়ে নিতে পারবেন।

 যুবক—আপনার কথা আমি খুব মানি। তবুও যদি পারেন, একটু দেখবেন। এইটুকু আমার অনুরোধ। তবে আসি, নমস্কার।

[ যুবক ও সরকার মশায় প্রস্থান করিলেন। অপর দিক হইতে বিপিন বাবু, দিলীপ বাবু ও সরোজ বাবুর প্রবেশ ]

 প্রকাশ—আরে এই যে এসো এসো ভায়ারা! হ্যাঁ, তারপর তোমাদের সেই ব্যাপারটা গড়ালো কত দূর? বলি, দেশ উদ্ধারের আর দেরী কত?

 বিপিন—এ দেশের উদ্ধার অসম্ভব। দেশের শতকরা ৯৯টি লোকই চলছে বেচালে, সম্পূর্ণ বিপথে। ঘোর কলি ভাই, ঘোর কলি। এ দেশের উদ্ধার করতে হলে সর্ব্বাগ্রে কি প্রয়োজন জান? ভাষা, ভাষার সংস্কার। ভাষা মনের ভাব প্রকাশ করে। জাতি যে দিন সুন্দর করে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে সমর্থ হবে, সেই দিনই হবে তার উত্থান। তা যাক, তোমার কারবারের অবস্থা তো ভালোই মনে হচ্ছে, নতুন লোক রাখবে বলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছ দেখ্‌লাম।

 প্রকাশ—তোমাদের শুভেচ্ছায় এক রকম ভালই বলতে হবে বৈ কি। জান ত সামান্য পুঁজি নিয়ে একাই এ কারবারটা আরম্ভ করেছিলাম—

 বিপিন—এই তো তোমাদের দোষ। স্পষ্ট করে কোনো কথা বলবার সাহস বা ক্ষমতা তোমাদের নেই। এ হচ্ছে ভাষাকে জবাই করা। ‘একরকম’, ‘প্রায়’—এই সব হেঁয়ালী ভরা অসম্পূর্ণ বাক্য ব্যবহার করে বলেই ত বাঙালী আজ এত দুর্ব্বল মেরুদণ্ডহীন জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষার চাই দৃঢ়তা, চাই স্পষ্টতা—না হলে ভাষায় জোর আসবে কোন্‌ চুলো থেকে? জাতিও গোল্লায় যাবে নাতো কোথায় যাবে?

 প্রকাশ—তা’ হলে আমাকে কি বলতে হবে?

 বিপিন—যদি ইংরাজীতে বলতে চাও তবে তোমার কারবারটা 50 p.c. ভাল, না 75 p.c. ভাল, তাই হিসেব করে বলবে; আর বাংলায় বলতে হলে বলবে—ছয় আনা ভাল, দশ আনা ভাল, বারো আনা ভাল—না ষোল আনাই ভাল। তবেই ত ভাবটা স্পষ্ট হবে।

[ চাকর ট্রে সাজাইয়া চা লইয়া আসিল ]

 প্রকাশ—সাবাস্‌ ভাই সাবাস্! বলিহারী তোমার উর্ব্বর মস্তিষ্কের, তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে থাকতে পারছি না ভাই! তা যাক, চা টা যে জুড়িয়ে গেল। গলাটা ভিজিয়ে নাও। নইলে ভাষা গলা দিয়ে স্পষ্ট হয়ে বেরুবে কি করে?

 দিলীপ—(চা পান করিতে করিতে) চায়ের স্বাদটা ত বড় সুন্দর হয়েছে! যাই-ই বল প্রকাশ ভায়া, যে দিন দেশের লোক এই বৈষ্ণব কবিদের বুঝতে পারবে, সেই দিনই আমাদের সাহিত্য-সাধনা সম্পূর্ণ হবে। দেশেরও এক নূতন সভ্যতা গড়ে উঠবে। জাতির জাগরণ সেই দিনই আসবে। “শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান” নয়—

“বৈষ্ণব কবির গাঁথা প্রেম-উপহার
চলিয়াছে নিশিদিন কত ভারে ভার
বৈকুণ্ঠের পথে। মধ্যপথে নর-নারী
অক্ষয় সে সুধারাশি করি কাড়াকাড়ি
লইতেছে আপনার প্রিয় গৃহতরে
যথা সাধ্য ষে যাহার।”

 রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা-দীপ্ত কল্পনায় বিদ্যাপতি আর চণ্ডীদাসকে কি ভাবে উপলব্ধি করেছেন একবার দেখ।

 প্রকাশ—সত্যিই ত বাঙ্গালী আজ যতটুকু বড় হয়েছে, সে ত তোমাদের মত ঐ বাব্‌রিওয়ালা কবিদেরই কৃপায়!

“বাঙ্গালী আজি গানের রাজা
বাঙ্গালী নহে খর্ব্ব”

 সরোজ—ভুলে যাচ্ছ প্রকাশ, তুমি সেই প্রাচীনের আদর্শ সেই তপোবনের আদর্শ। ভারতের মুক্তি হয়েছিল একদিন; কিন্তু সে গানে নয়—দর্শন,—দর্শনই ভারতকে মুক্ত করেছিল। আবার মনে রাখবে,— ভারত আবার কোন দিন যদি স্বাধীন হয়, তবে সে দর্শনেরই জন্যে হবে। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।

 দিলীপ—মূল ছেড়ে আগা ধরে টানলে কিছুই হবে না, সরোজ ভায়া! মুক্তির আদিমন্ত্র নৃত্য আর গীত। এর বাস্তবকে তুলিয়ে এক সুদূর কল্পনা-রাজ্যে নিয়ে যেতে পারে। মানুষ তা বুঝতে পেরেছে। ঐ দেখ, তাই আজ নৃত্য-গীত-মুখরা সুন্দরী কলিকাতা নগরী শত শত রস-পিপাসুকে নিত্য নূতন রসের পরিবেশন করছে। আর মুক্তিকামী লক্ষ লক্ষ নর-নারী সেই রস আকণ্ঠ পান করে কৃতার্থ হচ্ছে।

“ধরণীর শ্যাম করপুট খানি
ভরি দিব আমি সেই গীত আনি,
বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী,
মধুর অর্থ ভরা।”


 প্রকাশ—থাম, থাম! ক্ষেত্রবিশেষে পাগলামি করা চলে, সব জায়গায় নয়। কবির ন্যাকামি আর দার্শনিকের ভণ্ডামির জ্বালায় দেশ অস্থির।

 সরোজ—যতদিন এই বাস্তব জগতে থাকবে, ততদিন এই অস্থিরতার হাত এড়াতে পারবে না। তারপর একদিন দেখবে, জগতের সমস্ত দূর হয়ে গেছে এই দর্শনের মহিমায়। ব্যস্!

 বিপিন—ভাষা-জ্ঞান যাদের নেই, তাদের আবার দর্শন, বিজ্ঞান আর কবিতা? স্বর্গীয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বাঙ্গালীর এই দীনতা বুঝতে পেরেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর নানা দেশের ভাষা শিক্ষাদানের এক বিরাট শিক্ষা-কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। তাই সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয়—ফরাসী, জার্ম্মানী, লাটিন, টামিল, টেলেগু, আসামী, হিন্দী, নেপালী, গুজরাটি, মারহাটি—

 প্রকাশ—বর্ব্বটি, পর্প্পটি—রক্ষা কর বাবা! থাম থাম, খুব হয়েছে, আর কপচিও না।

[ চাকরের প্রবেশ ]

 মধু—হুজুর, এক ভদ্দর লোক এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

 প্রকাশ—আচ্ছা, তাঁকে আসতে বল। এই করতেই ত’ আছি।

[ নগেন্দ্রের প্রবেশ ]

 নগেন্দ্র—নমস্কার। আমি “আর্য্যস্থান সুগার কোম্পানীর” শেয়ার বিক্রী করি। দেখুন, আপনারা সবাই দেখুন (কাগজ এক একখানি করিয়া বিলি করিলেন) আমাদের গরীব দেশ। একজনের পয়সায় কোনো শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবার উপায় নেই। তাই লিমিটেড কোম্পানীর প্রসার দরকার হয়ে পড়েছে। দেখুন এদের মূলধন ২ লক্ষ টাকা। সব বড় বড় ব্যবসাদাররা হচ্ছেন এর পৃষ্ঠপোষক।

 প্রকাশ—শুধু Limited Company করলে কিছুই হবে না। নিতে হবে এর পরিচালনের ভার। তা নিতে পেরেছেন কি?

 নগেন্দ্র—আমাদের কোম্পানীর পরিচালক হচ্ছেন কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী Messrs D. K. Agarwalla & Co.

 প্রকাশ—ঠিকই ত; বিদেশী না হলে কি বাংলা দেশের ব্যবসা চল্‌তে পারে?

 নগেন্দ্র—হাঁ, আপনি যা ধরেছেন ত ঠিক। কিন্তু বাংলা দেশে সে রকম টাকা খাটাবার মত লোক কই? টাকা কার ঘরে আছে?

 প্রকাশ—তাই ত বলছি টাকা নাই বলেই ত বাঙ্গালী তার সমস্ত ব্যবসা বিদেশীদের হাতে তুলে দিয়ে, নিজেরা কেরাণী হয়ে, না হয় শেয়ারের দালালিগিরি করে, কেমন?

দাস্য সুখে হাস্য মুখ
বিনীত যোড়কর
প্রভুর পদে সোহাগ-মদে
দোদুল কলেবর।

 কেমন কবি ভায়া, ঠিক ত?

 দিলীপ—ঠিক বলেছ, প্রকাশ! আমাদের আর এখানে থাকা উচিত হয় না।

 সরোজ—যেখানে শুধু টাকা-পয়সার চুল-চেরা হিসাব, সেখান থেকে সরে পড়াই শ্রেয়ঃ।

 বিপিন—বাস্তবিক ভাই, এ একেবারে ডাহা অপমান! যেন বেঁধে ধরে জুতো মারা আর এক মুহূর্ত্তও এখানে থাকা উচিত নয়।

 নগেন্দ্র—ছিঃ ছিঃ, আপনারা যাবেন কেন? আমিই যাচ্ছি। অনুগ্রহ করে আপনারা একটা করে কোম্পানীর শেয়ার কিনুন। সত্যিই বলছি, এটা মস্ত একটা লাভের ব্যবসা।

 প্রকাশ—লাভ করবে কে? আপনি না। Mr. D. K. Agarwala? যান্‌ যান্‌ সরে পড়ুন। আপনাকে সাহায্য করব, না হাতী করব।

 নগেন্দ্র— আচ্ছা, নমস্কার। এখন নিলেন না বটে, কিন্তু পরে নিশ্চয়ই পস্তাবেন। (প্রস্থান)

 বিপিন—লোকটার কি স্পর্দ্ধা! মুখের উপর শাসিয়ে গেল।

 সরোজ—এক মিথ্যা জড়বাদী দালাল দর্শনকে অপমান করে গেল।

 দিলীপ—ওর শাসন করবার কি অধিকার আছে? “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো।” ওর শাসন কে মানে? চল আমরা এখনই যাই। গুড়ের দালালের এতদূর সাহস! (প্রস্থান)

 সরোজ—এতদূর স্পর্দ্ধা! (প্রস্থান)

 বিপিন—ওকে ষোল আনা শাস্তি দিতে হবে। চল্লাম ভাই প্রকাশ, মনে কিছু করো না। (প্রস্থান)

 প্রকাশ—[স্বগতঃ] কিছুই মনে করছি না, বাবা। বেশ যাও কি কুক্ষণেই রাতটা পুইয়েছে! [প্রকাশ্যে] নিমু, আয় ত একটু গান গা, শুনি।

[ নির্ম্মলেন্দুর প্রবেশ এবং গান ]

গান

প্রভাত-আলোয় উজল বেশে
আস্‌লে তুমি কোন্‌ অতিথি,—
তোমার মদির পরশ পেয়ে
অন্তরে মোর জাগছে গীতি।

আকাশ, বাতাস আজ্‌কে কেন,
অধীর হয়ে উঠছে হেন? —
মনের কোণে আস্‌ছে ভেসে
অতীত দিনের মধুর স্মৃতি।
অরুণ-আলোয় তোমার হাসি
পড়ছে ঝরে রাশি রাশি,—
সেই হাসিতে দূর হয়ে যায়—
প্রাণের যত গোপন ভীতি।

 নির্ম্মল—একবারে চল কাকা, ভিতরে যাই। আমাকে একটু পড়িয়ে দেবে। ওবেলা আমাদের ব্রতচারীর নাচ-গান হবে। তুমি যাবে কাকা বাবু?

 প্রকাশ—চল, নিশ্চয়ই যাবো। চল, এখন বাড়ীর ভিতরে। যাই। বড্ড বেলা হয়ে গিয়েছে।