মুর্শিদাবাদ-কাহিনী/কাটরার মস্জেদ (জাহানকোষা তোপ)
বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ মুসলমান-রাজধানী মুর্শিদাবাদের গৌরবচিহ্ন সমস্ত ধরণীপৃষ্ঠ হইতে মুছিয়া গিয়াছে। সর্বগ্রাসী কালের অনন্ত গর্ভে তাহারা চিরদিনের জন্য আশ্রয় লইয়াছে। দুই শত বৎসর অতীত হইতে না-হইতে, ভাগীরথীর উভয় তীরবর্তী তিন-চারি ক্রোশব্যাপী নগরের অধিকাংশ এক্ষণে মরুভূমিতে পরিণত। তাহার বিরাট সৌধমালা অণু-পরমাণুতে মিশিয়া গিয়াছে। দিল্লী, আগরা, এমন কি প্রাচীনতম গৌড় পর্যন্ত ভগ্ন-অট্টালিকাস্তুপ বক্ষে করিয়া আপন আপন পূর্বগৌরবের পরিচয় দিতেছে। কিন্তু তাহাদের বহু পরে নির্মিত মুর্শিদাবাদ শ্রীহীন, চিহ্নহীন, গৌরবহীন হইয়া ধ্বংসের শেষ আঘাতের অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। মুর্শিদাবাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আপনার মঙ্গলঘট ভাগীরথীবক্ষে বিসর্জন দিয়া যেন আর আসিবেন না বলিয়া চলিয়া গিয়াছেন। তাঁহার রত্নরাজিমণ্ডিত মুকুট চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে; গজদন্তনির্মিত সিংহাসন[১] শতখণ্ডে বিভক্ত; পরিধানের বহুমূল্য রেশমীবস্ত্র শতগ্রন্থিযুক্ত; বাদলার মালা বালকের ক্রীড়নক হইয়াছে। সেই অনন্ত ঐশ্বর্যময় চিত্র কে যেন মলিনতার ছায়া দ্বারা ঢাকিয়া দিয়াছে। মুর্শিদাবাদের ন্যায় এত শীঘ্র আর কোন স্থানের অধঃপতন ঘটিয়াছে বলিয়া মনে হয় না। মুর্শিদাবাদের কত অট্টালিকার নাম শুনা যাইত,—চেহেলসেতুন, এম্তাজ্মহাল, মহালসরা, আর কত নাম করিব! এই সমস্ত এক্ষণে কালগর্ভে শায়িত। কোন-কোনটির স্থাননির্দেশ করা যায়,—কোন-কোনটির স্থানের চিহ্নমাত্রও অনুসন্ধান করিয়া পাওয়া যায় না। দুই-একটি সমাধিক্ষেত্র ব্যতীত ইহার পূর্বপরিচয়ের কোন কিছুই নাই। যাঁহারা মুর্শিদাবাদের নিজামতী আসনে উপবিষ্ট হইয়াছিলেন তাঁহারা প্রায় সকলেই নূতন নূতন অট্টালিকায় ও উদ্যানে মুর্শিদাবাদকে পরিশোভিত করিতে চেষ্টা করেন। তদ্ভিন্ন নবাবের কর্মচারী ও জগৎশেঠ প্রভৃতি প্রধান প্রধান ধনাঢ্যবর্গের সৌন্দর্যময়ী সৌধমালায় ভূষিত হইয়া মুর্শিদাবাদ ভারতসাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লী নগরীর সহিতও সময়ে সময়ে স্পর্ধা করিত। জানি না, ভাগ্যলক্ষী কেন মুর্শিদাবাদের প্রতি এরূপ বিরূপ হইলেন। রাজসম্মান সকলের ভাগে চিরস্থায়ী হয় না, তাই বলিয়া একেবারে যে তাহার শোচনীয় দুর্দশা ঘটিবে, ইহাও বড় আক্ষেপের বিষয়। দিল্লী-আগরার যাহা আছে, তাহাতে এক্ষণেও তাহাদিগকে বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী বলিয়া বুঝিতে পারা যায়; কিন্তু কাহারও সাধ্য নাই যে, মুর্শিদাবাদকে বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ মুসলমান রাজধানী বলিয়া উপলব্ধি করিতে পারে।
মুর্শিদকুলী জাফর খাঁ মুর্শিদাবাদে বাঙ্গলার রাজধানী স্থাপন করেন এবং তাঁহারই নামানুসারে ইহার নাম মুর্শিদাবাদ হয়। পূর্বে ইহাকে মুখসুসাবাদ বা মুখসুদাবাদ বলিত। মুখসুদাবাদ একটি সামান্য নগর মাত্র ছিল; মুর্শিদকুলী খাঁ ইহাতে রাজধানীর ও রাজকার্যের উপযোগী অট্টালিকাদি নির্মাণ করেন। ক্রমশঃ কেল্লা, দরবারগৃহ এবং অন্যান্য গৃহাদি নির্মিত হয়। সমস্তই এক্ষণে লোপ পাইয়াছে; কেবল তাঁহার নির্মিত এক বিরাট মসজেদ অদ্যাপি তাঁহার নাম প্রচার করিতেছে। মসজেদটি ধ্বংসমুখে পতিত; দুই চারি বৎসর মধ্যে তাহাও লয় প্রাপ্ত হইয়া মুর্শিদাবাদের সহিত মুর্শিদকুলীর নামের সম্বন্ধ ঘুচাইয়া দিবে। বিশেষতঃ গত ভূমিকম্পে[২] তাহা ভূমিসাৎ হইবার উপক্রম করিয়াছে। যদি কেহ মুর্শিদাবাদ-স্থাপয়িতার শেষ গৌরবচিহ্ন দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে ধ্বংসমুখে পতিত সেই বিরাট মসজেদ একবার নয়ন ভরিয়া দেখিয়া আসিবেন। দেখিবেন যে, বিধ্বস্তপ্রায় সেই ভগ্নস্তূপ আজিও মুর্শিদাবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শনীয় পদার্থ। কিন্তু কাল বোধহয়, অধিক দিন কুলী খাঁর কীর্তিস্তম্ভকে ধরণীবক্ষে অবস্থান করিতে দিবে না।
মুর্শিদাবাদের প্রায় অর্ধ ক্রোশ পূর্বে এই বৃহৎ মস্জেদ অবস্থিত। যে স্থানে মস্জেদ নির্মিত হয়, তাহাকে কাটরা কহে। কাটরা শব্দে গঞ্জ বা বাজার বুঝায়। কাটরা মস্জেদ নির্মাণ সম্বন্ধে প্রচলিত ইতিহাসে যেরূপ বর্ণনা দেখা যায়, আমরা প্রথমতঃ তাহারই উল্লেখ করিতেছি। মুর্শিদকুলী জাফর খাঁর বার্ধক্য উপস্থিত হওয়ায় এবং শীঘ্র শীঘ্র স্বাস্থ্যভঙ্গ হইতেছে জানিয়া, তিনি সমাধিমন্দির নির্মাণের আদেশ দেন। তথায় একটি মসজেদ ও কাটরা বা গঞ্জ স্থাপিত করিবার কথাও থাকে। উক্ত কাটরা হইতে এক্ষণে স্থানটির নাম কাটরা হইয়াছে। মোরাদ ফরাস নামে একজন সামান্য অথচ বিশ্বস্ত কর্মচারী সেই কার্যের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হয়। নগরের পূর্বদিকে খাস তালুকের অন্তর্গত একটি স্থান সেইজন্য নির্দিষ্ট হইলে, মোরাদ নিকটবতী হিন্দুমন্দির সকল ভূমিসাৎ করিয়া তাহার উপকরণ দ্বারা উক্ত কার্য আরম্ভ করে। জমিদার ও অন্যান্য হিন্দুগণ যথেচ্ছ পরিমিত অর্থ প্রদান করিয়া আপনাদিগের মন্দির রক্ষা করিতে পারিতেন, কিন্তু কোন প্রকার অনুনয় বা উৎকোচ কার্যকর হয় নাই। মুর্শিদাবাদ হইতে তিন চারিদিনের পথে কোথাও একটিমাত্র মন্দির অবস্থিতি করিতে পারে নাই! দূরবতী গ্রামসমূহের ধর্মার্থে উৎসর্গীকৃত হিন্দুমন্দির সকল ভাঙ্গিবার প্রস্তাব হইলে সেই সেই স্থানের অধিবাসিগণ অর্থ দিয়া সে সকল মন্দির রক্ষা করিতে সমর্থ হয়। হিন্দুদিগের ভৃত্যবৰ্গকে সমাধি নির্মাণকার্যে নিযুক্ত করা হইত। যাহাদিগের প্রভুরা অর্থ প্রদান করিতেন, তাহারা নিষ্কৃতি পাইত। সকলকে মোরাদ ফরাসের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইত। এইরূপে এক বৎসরের মধ্যে সমাধিমন্দির নিমিত হয়। কাটরা বা একটি গঞ্জ স্থাপন করিয়া তাহার আর সমাধিসংস্কারের জন্য নির্দেশ করা হইয়াছিল।
ভগ্ন মন্দিরের উপকরণ লইয়া কাটরা মসজেদ নির্মাণ সম্বন্ধে প্রচলিত ইতিহাসের মতে অনেকে সন্দিহান হইয়া থাকেন।[৩] একেবারে মিথ্যা না হইলেও ইহার অধিকাংশ অতিরঞ্জিত বলিয়াই বোধ হয়। এইরূপ কথিত আছে যে, মোরাদকে এক বৎসরের মধ্যে মসজেদ নির্মাণের আদেশ দিলে, মোরাদ জাফর খাঁর নিকট হইতে অনুমতি লয় যে, তাহার কার্যে নবাব যেন কোনরূপ বাধা প্রদান না করেন। এক বৎসরের মধ্যে এই বৃহৎ মস্জেদ নির্মাণ করা যে কতদূর দুঃসাধ্য তাহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে। সুতরাং মোরাদ এক বৎসরের মধ্যে নূতন করিয়া ইষ্টকাদি প্রস্তুত করিয়া মস্জেদ নির্মাণ করিতে গেলে, কখনও কৃতকার্য হইতে পারিত না। এইজন্য নিকটবর্তী মন্দিরাদি ভগ্ন করিয়া থাকিবে। কেবল মন্দির বলিয়া কেন, নিকটবতী অন্যান্য ইষ্টকনিমিত গৃহাদিরও উক্তরূপ দশা হইয়াছিল বলিয়া জানা যায়। মুর্শিদকুলী খাঁ হিন্দুবিদ্বেষী বলিয়া ইতিহাসে পরিচিত; কিন্তু আমরা সেরূপ মনে করি না; তবে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানদিগের প্রতি তাঁহার আনুরক্তি কিছু অধিক ছিল। তিনি যে ইচ্ছাপূর্বক মন্দিরভঙ্গের আদেশ দিয়াছিলেন, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। কারণ, তিনি নিজে সমাধিমন্দিরনির্মাণপ্রথার কোনরূপ আদেশ প্রদান করেন নাই এবং এক বৎসরের মধ্যে উক্ত প্রকাণ্ড মসজেদ ও সমাধির নির্মাণ অসম্ভব বলিয়া সম্ভবতঃ তিনি বাধ্য হইয়া মোরাদের অত্যাচারের প্রতি লক্ষ্য করেন নাই। কিন্তু মোরাদ ফরাসের অত্যাচার অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কারণ মুর্শিদকুলীর জামাতা, তাঁহার পরবর্তী নবাব সুজা উদ্দীন মোরাদ ফরাসের অত্যাচারের জন্য তাহার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়াছিলেন।[৪]
হিজরী ১১৩৭ অব্দে[৫] মস্জেদ নির্মাণ শেষ হয়। মক্কার সুপ্রসিদ্ধ মস্জেদের অনুকরণে ইহার নির্মাণ হইয়াছিল বলিয়া কথিত আছে। মস্জেদের সঙ্গে মিনার, চৌবাচ্চা ও ইন্দারা প্রভৃতিও প্রস্তুত হয়। মুর্শিদকুলী খাঁ মস্জেদ নির্মাণের পর এক বৎসরের কিছু অধিক কাল জীবিত ছিলেন। হিঃ ১১৩৯ অব্দে তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁহার আদেশে মস্জেদের প্রবেশদ্বারের সোপানাবলীর নিম্নে একটি প্রকোষ্ঠ নির্মিত হয়; এই প্রকোষ্ঠেই তাঁহাকে সমাহিত করা হয়। তিনি বিনয়সহকারে বলিয়াছিলেন যে, উপাসকদিগের পদধূলি যেন তাঁহার বক্ষস্থলের উপর পতিত হয়। সাধুদিগের পদধূলি পরলোকে তাঁহার কল্যাণসম্পাদন করিতে পারে বলিয়া, তিনি এইরূপ অনুরোধ করিয়াছিলেন। মুর্শিদকুলী খাঁ যেরূপ আনুষ্ঠানিক মুসলমান ছিলেন, তাহাতে তাঁহার পক্ষে এরূপ ইচ্ছাপ্রকাশ বড় বিচিত্র নহে।
কাটরার মস্জেদ এক্ষণে ভগ্নদশায় উপস্থিত; তথাপি ইহার বিরাট্ গৌরবের নিদর্শন এখনও অনেক পরিমাণে উপলব্ধি করা যাইতে পারে। আমরা ইহার বর্তমান অবস্থার একটি চিত্র প্রদান করিতেছি। মস্জেদের পশ্চাতে অর্থাৎ পশ্চিমদিকে সদররাস্তা, রাস্তা হইতে মস্জেদের দক্ষিণপার্শ্বে একটি পথ দিয়া মস্জেদের সম্মুখে উপস্থিত হইতে হয়। মস্জেদ পূর্বমুখে অবস্থিত। প্রবেশদ্বারে উঠিতে হইলে চৌদ্দটি বৃহৎ সোপান অতিক্রমের প্রয়োজন। এই সোপানাবলীর নিম্নে, একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে মুর্শিদাবাদের স্থাপয়িতা ইতিহাসখ্যাত মুর্শিদকুলী খাঁ অনন্ত-নিদ্রায় নিদ্রিত। যাঁহার শাসনে সমগ্র বঙ্গভূমি সন্ত্রস্ত হইয়াছিল, এক্ষণে তিনি সোপানবলীর নিম্নস্থ অন্ধতমসাবৃত গহ্বরে শয়ান রহিয়াছেন। উত্তরদিকে একটি মাত্র দ্বার,—সেই দ্বার প্রায় রুদ্ধ থাকে; সময়ে সময়ে ক্ষণকালের জন্য উন্মুক্ত হয় মাত্র। দ্বারের পরই একটি ক্ষুদ্র গৃহ, তাহার পশ্চাতে সমাধি-প্রকোষ্ঠ; সেই ক্ষুদ্রগৃহ ও সমাধি-প্রকোষ্ঠের মধ্যে আর একটি দ্বার,—এ দ্বারের কোন কপাট নাই। কষ্টিপ্রস্তরগঠিত চৌকাঠ দ্বারা দ্বারটি নির্মিত। প্রকোষ্ঠমধ্যে শ্বেতবস্ত্রমণ্ডিত সমাধি কারুকার্যসমন্বিত মাল্যশোভিত হইয়া আছে। লোকে আপনাদিগের মনস্কামনা সিদ্ধির জন্য সমাধির উপর এই সমস্ত মালা নিক্ষেপ করিয়া যায়। এই অন্ধকারময় প্রকোষ্ঠে রাত্রিকালে একটি মাত্র দীপ আপনার ক্ষীণ শিখা বিস্তার করিয়া থাকে। সমাধির তত্ত্বাবধানের জন্য একটি লোক নিযুক্ত আছে। সোপানাবলীর উপরে একটি প্রকাণ্ড তোরণ-দ্বার; তোরণ-দ্বারের উপর দ্বিতল নহবতখানা এবং তোরণ-দ্বারের পূর্বসীমা অর্থাৎ সোপানাবলীর অব্যবহিত পর হইতে আরম্ভ করিয়া মস্জেদের পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত একটি বিশাল চত্বর। চত্বরটি সমচতুরস্র, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ১১০ হস্তেরও অধিক হইবে। মস্জেদ, তোরণ, সমস্তই এই চত্বরে অবস্থিত। তোরণ পার হইয়া প্রায় ৮০ হাত পরে মস্জেদ; মস্জেদ ও তোরণের মধ্যস্থিত বিশাল প্রাঙ্গণ জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কেবল তোরণ হইতে মস্জেদে যাইবার কৃষ্ণপ্রস্তর-মণ্ডিত পথটি আজিও দৃষ্ট হইয়া থাকে। চত্বরের পশ্চিমদিকে পঞ্চগম্বুজবিশিষ্ট বিরাট্ মস্জেদ অদ্যাপি দণ্ডায়মান থাকিয়া কালের আঘাত সহ্য করিতেছে। মস্জেদের ভিতর বসিয়া যাওয়ায় খিলানকরা গম্বুজগুলি বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে।[৬] গম্বুজ পাঁচটি ব্যতীত চারিকোণে চারিটি ক্ষুদ্র মিনার ছিল; তাহার দুই একটি এখনও বর্তমান আছে। মস্জেদটি ইষ্টক-নির্মিত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাঙ্গলা ইষ্টক জমাইয়া কিরূপে এই বিশাল পঞ্চগম্বুজের খিলান নির্মিত করা হইয়াছিল, তাহা মনে করিতে গেলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।
মস্জেদটি দৈর্ঘ্যে ৮৬।৮৭ হাত হইবে এবং প্রস্থে ১৬ হাতেরও অধিক। গম্বুজগুলির ধাতুনির্মিত চূড়া আজিও তাহাদের পতনোন্মুখ মস্তকে শোভা পাইতেছে। মস্জেদের প্রবেশদ্বারে প্রকাও কৃষ্ণপ্রস্তর নির্মিত চৌকাঠ। দ্বারের উপর এক খণ্ড কষ্টি প্রস্তরে ফারসী ভাষায় এইরূপ লিখিত আছে—“আরবের মহম্মদ উভয় জগতের গৌরব; যে ব্যক্তি তাঁহার দ্বারের ধূলি নহে, তাঁহার মস্তকে ধূলিবৃষ্টি হউক।” ঢাকায় সায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবিবির সমাধি-মন্দিরেও ঐরূপ লিখিত আছে। মস্জেদের মধ্যস্থলে পশ্চিমদিকের ভিত্তিতে কলমী লেখা। ইহার উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বের জানালা দুইটি আজিও বাঙ্গলার পূর্ব শিল্পের পরিচয় দিতেছে। অনেকগুলি গম্বুজ ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় উপর হইতে ক্রমাগত ইষ্টক খণ্ড পতিত হইতেছে। এই মস্জেদ মধ্যে প্রবেশ করিতে মনে ভীতির সঞ্চার হয়। কেবল কপোত ও মধুমক্ষিকাগণ আপনাদিগের উপযুক্ত আবাসস্থান বিবেচনায় মস্জেদটিকে অধিকার করিয়া রাখিয়াছে এবং নীরব ও নির্জন স্থানে সময়ে সময়ে আপনাদিগের কণ্ঠস্বরে আপনারাই মুগ্ধ হইয়া থাকে। চত্বরের চারিপার্শ্বে মোসাফের ও কারীদিগের (কোরাণাধ্যায়ী) জন্য বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ ছিল। গৃহগুলি সমস্তই খিলানের, একটিতেও তীর বরগা নাই। এখনও তাহাদের ভগ্নাবশেষ নয়ন পথে পতিত হইয়া মুর্শিদকুলী খাঁর বিশাল কীর্তির পরিচয় দিতেছে। মস্জেদের পশ্চাদ্ভাগের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দুইটি অত্যুচ্চ অষ্টকোণ মিনার যেন গগনস্পর্শ করিবার জন্য দণ্ডায়মান রহিয়াছে। উত্তর-পশ্চিমের মিনারে যাইবার সুবিধা নাই; তাহার চারি দিক্ ভীষণ জঙ্গলে আবৃত। দক্ষিণ-পশ্চিমের মিনারে উঠিতে পারা যায়। সর্পগতিতে ৬৭টি সোপান অতিক্রম করিয়া মিনারের চূড়াতলে উঠিতে হয়। মধ্যে মধ্যে আলোক ও বায়ু প্রবেশের দ্বারও আছে। মিনারটি প্রায় ৪০ হস্ত উচ্চ হইবে; চূড়াতল হইতে ভূমি পর্যন্ত অংশ প্রায় ৩০ হস্ত।
এই চূড়াতলে দাঁড়াইয়া পশ্চিমদিকে দৃষ্টিপাত করিলে, মুর্শিদাবাদ নগরের এক সুন্দর দৃশ্য নয়নপথে পতিত হয়। পূর্বে আরও সুন্দর বোধ হইত, এক্ষণে বৃক্ষাদির সংখ্যা অধিক হওয়ায়, মুর্শিদাবাদের সুন্দর চিত্রকে অনেকটা আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে। তথাপি এক্ষণে যাহা আছে, তাহাও বড়ই মনোরম বলিয়া বোধ হয়। বিস্মৃতির ছায়াময় স্তর হইতে অনেক দিনের স্মৃতির অস্ফুট আলোকের ন্যায় সেই বহুদূরবিস্তৃত শ্যামল পত্ররাজির মধ্যে মুর্শিদাবাদের প্রধান প্রধান প্রাসাদগুলির দৃশ্য বড়ই সুন্দর বোধ হইয়া থাকে। অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই মনোরম চিত্র দেখিতে ইচ্ছা হয়। গত ভূমিকম্পে[৭] এই মিনারের শীর্ষদেশ ভগ্ন হইয়াছে। হয়ত মুর্শিদকুলী খাঁর শেষ বিরাট কীর্তি অচিরকাল মধ্যেই ধূলিরাশিতে পরিণত হইবে। যাঁহা হইতে মুর্শিদাবাদের নাম ও গৌরব, যিনি মুর্শিদাবাদকে বাঙ্গলার রাজধানী করিয়া সমগ্র জগতে স্বীয় গৌরব প্রচার করিয়াছিলেন, মুর্শিদাবাদ হইতে যদি তাঁহার শেষ চিহ্ন চিরদিনের জন্য গাথা লয়প্রাপ্ত হয় তাহা হইলে ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বলিতে হইবে। জানি না, কাটরার মস্জেদের সংস্কার আর হইবে কিনা! যদিও অনেক অর্থব্যয়ের সম্ভাবনা বটে, তথাপি, মুর্শিদাবাদের স্থাপয়িতার শেষ চিহ্ন সর্বতোভাবে রক্ষা করা একান্ত আবশ্যক। এখন কেবল, তাঁহার সমাধিটির মধ্যে মধ্যে সংস্কার হইয়া থাকে।
কাটরা মস্জেদ হইতে পশ্চিম দিকে কিছু দূরে আর একটা মস্জেদ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রহিয়াছে; তাহাকে ফৌতি মস্জেদ কহে। মুর্শিদের দৌহিত্র নবাব সরফরাজ খাঁ উক্ত মস্জেদ নির্মাণ করিতে করিতে আলিবর্দী খাঁর সহিত যুদ্ধার্থে গিরিয়া প্রান্তরে গমন করেন। কিন্তু তাঁহাকে আর জীবিত অবস্থায় প্রত্যাগমন করিতে হয় নাই। তদবধি মস্জেদটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় অবস্থান করিতেছে। ইহা কাটরার পঞ্চ-গম্বুজ মস্জেদের অনুকরণে নির্মিত হইতেছিল। ইহার পাঁচটি গম্বুজের মধ্যে দুইটি আজও বর্তমান আছে। সেই অসম্পূর্ণ মস্জেদও ভগ্নদশায় পতিত; বিশেষতঃ এক্ষণে জঙ্গলে আবৃত হইয়া ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুর আবাসস্থান হইয়া উঠিয়াছে।
কাটরার দক্ষিণ-পূর্বদিকে দুইটি অশ্বত্থতরুর, অথবা একটি অশ্বথতরুর দুইটি সংলগ্ন কাণ্ডের মধ্যস্থলে এক বিশাল কামান অবস্থিতি করিতেছে। এই কামানের নাম জাহানকোষা বা জগজ্জয়ী। এই স্থানে মুর্শিদকুলী খাঁর কামানাদি রক্ষিত হইত বলিয়া কথিত আছে। সেইজন্য এই স্থানটিকে আজিও সাধারণে তোপখানা কহিয়া থাকে। এই তোপখানার উত্তর দিয়া একটি ক্ষুদ্র নদী সর্পগতিতে আপনার ক্ষুদ্র কলেবরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ তুলিয়া আপন মনে বহিয়া যাইতেছে। জাহানকোষা অনেকদিন পর্যন্ত ধরণীবক্ষে স্বীয় বিশাল বপু বিস্তার করিয়া অবস্থিতি করিতেছিল; ইহার পার্শ্বে অশ্বত্থ বৃক্ষ জন্মিয়া জাহানকোষাকে ভূতল হইতে কতকটা উর্ধ্বে উত্তোলন করিয়াছে। কামানটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২ হাত হইবে। বেড় ৩ হাতের অধিক, মুখের বেড়টি ১ হাতের উপর। অগ্নিসংযোগ-ছিদ্রের ব্যাস ১॥ ইঞ্চি হইবে। কামানের গাত্রে ফারসী ভাষায় খোদিত ৯ খণ্ড পিত্তলফলক আছে। ৩ খণ্ড অশ্বত্থবৃক্ষের কাণ্ড মধ্যে প্রবিষ্ট, অবশিষ্ট কয়েকখানিও অস্পষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। পিত্তলফলকে বাঙ্গলার শাসনকর্তা ইসলাম খাঁর গুণবর্ণনা ও কামানের নির্মাণাব্দাদি খোদিত আছে। এইরূপ লিখিত আছে যে, এই জাহানকোষা সাজাহানের রাজত্বকালে ও ইসলাম খাঁর বাঙ্গলাশাসনের সময়, জাহাঙ্গীরনগরে দারোগা শের মহম্মদের অধীন হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনাৰ্দন[৮] কর্মকার কর্তৃক ১০৪৭ হিঃ ১১ই জমাদিয়স্ সানি মাসে নির্মিত হয়। ইহা ওজনে ২১২ মণ; ইহাতে ২৮ সের বারুদ লাগিয়া থাকে। জাহানকোষাকে এক্ষণে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতিই সিন্দুরাদি লেপন করিয়া পূজা করিয়া থাকে। ঢাকায় ইহা অপেক্ষা আরও একটি বিশাল তোপ ছিল; তাহা এক্ষণে নদীগর্ভে পতিত। বিষ্ণুপুর প্রভৃতি স্থানেও বৃহৎ তোপের কথা শুনা গিয়া থাকে।[৯] আমাদের দেশে পূর্বে যেরূপ শিল্পের উন্নতি হইয়াছিল, অনুসন্ধান করিলে, এখনও তাহার অনেক চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়। বাঙ্গলার শিল্পের দিন দিন যেরূপ অবনতি হইতেছে, তাহাতে লোকে ইহার পূর্বশিল্পের কথা প্রবাদ বাক্য বলিয়া মনে করিবে।
- ↑ গজদন্তের দ্রব্যাদি মুর্শিদাবাদ-শিল্পের নিদর্শন।
- ↑ ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের ভূমিকম্প।
- ↑ “তারিখ বাঙ্গালা” গ্রন্থে প্রথমে এই মন্দিরভঙ্গব্যাপারের কথা লিখিত হয়। গ্ল্যাডউইন সাহেবকৃত তাহার ইংরাজি অনুবাদ হইতে স্টুয়ার্ট প্রভৃতি মন্দিরভঙ্গের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। রিয়াজুস্-সালাতীনের অধিকাংশ “তারিখ বাঙ্গালা” হইতে গৃহীত হইলেও তাহাতে মন্দিরভঙ্গের কথা নাই। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের দেওয়ান সুপ্রসিদ্ধ ফজ্ল রব্বী খাঁ বাহাদুর মন্দিরভঙ্গের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতেন না। বেভারিজ সাহেব উক্ত বিবরণ অযৌক্তিক বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, প্রচলিত ইতিহাসে ৪ দিনের পথের সমস্ত হিন্দুমন্দির ভগ্ন হওয়ার কথা লিখিত আছে; অথচ মুর্শিদাবাদ হইতে ১॥o ক্রোশ দূরে কিরীটেশ্বরীর মন্দির সমভাবে অদ্যাপি বিরাজ করিতেছে। “The tale in its original form, is even more preposterous, for in Gladwin's translation of the Mahamadan narrative, and in Stewart, the prohibitory distance is given as four days” (Calcutta Review, October, 1892)। কিন্তু মুর্শিদাবাদের তৎকালিক সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দু তীর্থস্থান কীরিটেশ্বরীর সহিত বাঙ্গলার রাজস্ব-বিভাগের প্রধান কর্মচারী বঙ্গাধিকারী কাননগোগণের বিশিষ্টরূপ সম্বন্ধ থাকায় মোরাদের ন্যায় একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী তাহা ভাঙ্গিতে সাহস করে নাই, এরূপ অনুমানও করা যাইতে পারে। উক্ত মন্দিরভঙ্গের বিবরণ অতিরঞ্জিত হইলেও ‘তারিখ বাঙ্গালার’ লিখিত বিষয় যে একেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা, এ কথা সাহস করিয়া বলা যায় না।
- ↑ Riyaz-us-salatin p. 292.
- ↑ ইংরাজী ১৭২৩।২৪
- ↑ এখনও প্রায় সেই অবস্থায় আছে ক্রমশঃ ঐ বিদীর্ণ অংশগুলি বিস্তার লাভ করিতেছে।
- ↑ ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প
- ↑ এই জনাৰ্দনকে বেভারিজ প্রভৃতি জর্নাজন বলিয়া লিখিয়াছেন। পিত্তল-ফলকের লেখা এক্ষণে অস্পষ্ট হইয়াছে, ভাল করিয়া পড়িবার সুবিধা নাই; কিন্তু উহা জনাৰ্দন হওয়াই সম্ভব।
- ↑ Vide History of Bishnupur.