মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।


মৃণালিনীর সুখ কি?

 যেখানে হেমচন্দ্র তাঁহাকে সোপানপ্রস্তরাঘাতে ব্যথিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন—মৃণালিনী এখনও সেইখানে। পৃথিবীতে যাইবার আর স্থান ছিল না—সর্ব্বত্র সমান হইয়াছিল। নিশা প্রভাতা হইল, মৃণালিনী উঠিলেন না। বেলা হইল, মৃণালিনী উঠিলেন না। গিরিজায়া যত কিছু বলিলেন—মৃণালিনী কোন উত্তর দিলেন না, অধোবদনে বসিয়া রহিলেন। স্নানাহারের সময় উপস্থিত হইল—গিরিজায়া তাঁহাকে জলে নামাইয়া স্নান করাইলেন। স্নান করিয়া মৃণালিনী আর্দ্রবসনে সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন। গিরিজায়া স্বয়ং ক্ষুধাতুরা হইল—কিন্তু গিরিজায়া মৃণালিনীকে উঠাইতে পারিল না—সাহস করিয়া বার বার বলিতেও পারিল না। সুতরাং নিকটস্থ বন হইতে এবং ভিক্ষা দ্বারা কিঞ্চিৎ ফলমূল সংগ্রহ করিয়া ভোজন জন্য মৃণালিনীকে দিল। মৃণালিনী তাহা স্পর্শ করিলেন মাত্র। প্রসাদ গিরিজায়া ভোজন করিল—ক্ষুধার অনুরোধে মৃণালিনীকে ত্যাগ করিল না।

 এইরূপে পূর্ব্বাচলের সূর্য্য মধ্যাকাশে, মধ্যাকাশের সূর্য পশ্চিমে গেলেন। সন্ধ্যা হইল। গিরিজায়া দেখিলেন যে তখনও মৃণালিনী গৃহে প্রত্যাগমন করিবার লক্ষণ প্রকাশ করিতেছেন না। গিরিজায়া বিশেষ চঞ্চল হইলেন। পূর্ব্বরাত্র জাগরণ গিয়াছে—এ রাত্রেও জাগরণের আকার। গিরিজায়া কিছু বলিলেন না—বৃক্ষপল্লব সংগ্রহ করিয়া সোপানোপরি আপন
মৃণালিনীর সুখ কি?
১৬৭

শয্যা রচনা করিলেন। মৃণালিনী তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিয়া কহিলেন, “তুমি গৃহে গিয়া শয়ন কর।”

 গিরিজায়া মৃণালিনীর কথা শুনিয়া আনন্দিত হইল, বলিল, “একত্রে যাইব।”

 মৃণালিনী বলিলেন, “আমি পশ্চাৎ যাইতেছি।”

 গি। “আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করিব। ভিখারিণী দুই দণ্ড পর্ণশয্যায় শুইলে ক্ষতি কি? কিন্তু সাহস পাই ত বলি—রাজপুত্রের সহিত এ জন্মের মত সম্বন্ধ, ঘুচিল—তবে আর কার্ত্তিকের হিমে আমরা কষ্ট পাই কেন?”

 মৃ। “গিরিজায়ে,—হেমচন্দ্রের সহিত এ জন্মে আমার সম্বন্ধ ঘুচিবে না। আমি কালিও হেমচন্দ্রের দাসী ছিলাম— আজিও তাঁহার দাসী।”

 গিরিজায়ার বড় রাগ হইল—সে উঠিয়া বসিল। বলিল, “কি ঠাকুরাণি! তুমি এখনও বল আমি সেই পাষণ্ডের দাসী! তুমি যদি তাঁহার দাসী—তবে আমি চলিলাম—আমার এখানে আর প্রয়োজন নাই।”

 মৃ। “গিরিজায়ে—যদি হেমচন্দ্র তোমাকে পীড়ন করিয়া থাকেন, তুমি স্থানান্তরে নিন্দা করিও। হেমচন্দ্র আমার প্রতি কোন অহিতাচরণ করেন নাই—আমি কেন তাঁহার নিন্দা সহিব? তিনি রাজপুত্র—আমার স্বামী; তাঁহাকে পাষণ্ড বলিও না।”

 গিরিজায়া আরও রাগ করিল। বহুযত্নরচিত পর্ণশয্যা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। কহিল “পাষণ্ড বলিব না—একবার বলিব” (বলিয়াই কতকগুলি শয্যাবিন্যাসের পল্লব সদর্পে জলে ফেলিয়া দিল) “একবার বলিব—শতবার বলিব” (আবার পল্লব প্রক্ষেপ)—“দশবার বলিব” (পল্লব প্রক্ষেপ) “শতবার বলি বলিব”—“সহস্রবার বলিব।” সকল পল্লবগুলিন জলে গেল। গিরিজায়া বলিতে লাগিল। “পাষণ্ড বলিব না? কি দোষে তোমাকে তিনি এত তিরস্কার করিলেন?”

 মৃ। “সে আমারই দোষ—আমি গুছাইয়া সকল কথা তাঁহাকে বলিতে পারি নাই—কি বলিতে কি বলিলাম।”

 গি। “ঠাকুরাণি! আপনার কপাল টিপিয়া দেখ।”

 মৃণালিনী ললাট স্পর্শ করিলেন।

 গি। “কি দেখিলে?”

 মৃ। “বেদনা।”

 গি। “কেন হইল?”

 মৃ। “মনে নাই।”

 গি। “তুমি হেমচন্দ্রের অঙ্গে মাথা রাখিয়াছিলে—তিনি ফেলিয়া দিয়া গিয়াছেন। পাতরে পড়িয়া তোমার মাথায় লাগিয়াছে।”

 মৃণালিনী ক্ষণেক চিন্তা করিয়া দেখিলেন। কিছু মনে পড়িল না। বলিলেন, “মনে হয় না। বোধ হয়, আমি আপনি পড়িয়া গিয়া থাকিব।”

 গিরিজায়া বিস্মিত হইল। বলিল “ঠাকুরাণি! এ সংসারে আপনি সুখী।”

 মৃ। “কেন?”

 গি। “আপনি রাগ করেন না।”

 মৃ। “আমিই সুখী—কিন্তু তাহার জন্য নহে।”

 গি। “তবে কিসে?”

 মৃ। “হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ পাইয়াছি।”