মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
যবনবিপ্লব।
সেই নিশীতে নবদ্বীপনগর বিজয়োন্মত্ত যবনসেনার নিস্পীড়নে, বাত্যাসন্তাড়িত তরঙ্গোৎক্ষেপী সাগর সদৃশ চঞ্চল হইয়া উঠিল। রাজপথ, ভূরি ভূরি অশ্বারোহিগণে, ভূরি ভূরি পদাতি দলে, ভূরি ভূরি খড়্গী ধানুকী শূলী সমূহ সমারোহে, আচ্ছন্না হইয়া গেল। সেনাবলহীন রাজধানীর নাগরিকেরা ভীত হইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল; দ্বার রুদ্ধ করিয়া সভয়ে ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিল।
যবনেরা, রাজপথে যে দুই একজন হতভাগ্য আশ্রয়হীন ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হইল, তাহাদিগকে শূলবিদ্ধ করিয়া, রুদ্ধদ্বার ভবন সকল আক্রমণ করিতে লাগিল। কোথাও বা দ্বার ভগ্ন করিয়া, কোথাও বা প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া, কোথাও বা শঠতা পূর্ব্বক ভীত গৃহস্থকে জীবনাশা দিয়া গৃহপ্রবেশ করিতে লাগিল। গৃহ প্রবেশ করিয়া, গৃহস্থের সর্ব্বস্বাপহরণ, পশ্চাৎ স্ত্রীপুরুষ, বৃদ্ধ বনিতা বালক, সকলেরই শিরচ্ছেদ, ইহাই নিয়ম পূর্ব্বক করিতে লাগিল। কেবল যুবতীর পক্ষে দ্বিতীয় নিয়ম।
শোণিতে গৃহস্থের গৃহ সকল প্লাবিত হইতে লাগিল। শোণিতে রাজপথ পঙ্কিল হইল। শোণিতে যবনসেন রক্তচিত্রময় হইল। অপহৃত দ্রব্যজাতের ভারে অশ্বের পৃষ্ঠ এবং মনুষ্যের স্কন্ধ পীড়িত হইতে লাগিল। শূলগ্রে বিদ্ধ হইয়া ব্রাহ্মণের মুণ্ড সকল ভীষণভাব ব্যক্ত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণের যজ্ঞোপবীত অশ্বের গলদেশে দুলিতে লাগিল। সিংহাসনস্থ শালগ্রামশিলা সকল যবন পুরীষে আবরিত হইল।
ভয়ানক শব্দে নৈশাকাশ পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। অশ্বের পদধ্বনি, সৈনিকের কোলাহল, হস্তীর বৃংহিত, যবনের জয় শব্দ; তদুপরি পীড়িতের আর্ত্তনাদ। মাতার রোদন, শিশুর রোদন, বৃদ্ধের করুণাকাঙ্ক্ষা, যুবতীর কণ্ঠ বিদার।
যে বীরপুরুষকে মাধবাচার্য্য এত যত্নে যবনদমনার্থ নবদ্বীপে লইয়া আসিয়াছিলেন, এ সময়ে তিনি কোথা? এই ভয়ানকযবনপ্রলয়কালে, হেমচন্দ্র রণোন্মুখ নহেন। একাকী রণোন্মুখ হইয়া কি করিবেন?
হেমচন্দ্র তখন আপন গৃহে শয়ন মন্দিরে, শয্যাপরে শয়ন করিয়াছিলেন। নগরাক্রমণের কোলাহল তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল। তিনি দিগ্বিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের শব্দ?”
দিগ্বিজয় কহিল, “যবন সেনা নগর আক্রমণ করিয়াছে।” হেমচন্দ্র চমৎকৃত হইলেন। তিনি এ পর্য্যন্ত বখ্তিয়ার কর্ত্তৃক রাজপুরাধিকার এবং রাজার পলায়নের বৃত্তান্ত শুনেন নাই। দিগ্বিজয় তদ্বিশেষ হেমচন্দ্রকে শুনাইলেন।
হেমচন্দ্র কহিলেন, “বাঙ্গালিরা কি করিতেছে?”
দি। “যে পারিতেছে পলায়ন করিতেছে, যে না পারিতেছে সে প্রাণ হারাইতেছে।”
হে। “আর বঙ্গীয় সেনা?”
দি। “কাহার জন্য যুদ্ধ করিবে? রাজা ত পলাতক। সুতরাং তাহারা আপন আপন পথ দেখিতেছে।”
হে। “আমার অশ্বসজ্জা কর।” দিগ্বিজয় বিস্মিত হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবেন?”
হে। “নগরে।” দি। “একাকী?”
হেমচন্দ্র ভ্রূকুটী করিলেন। ভ্রূকুটী দেখিয়া দিগ্বিজয় ভীত হইয়া অশ্বসজ্জা করিতে গেল।
হেমচন্দ্র তখন মহামূল্য রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া, সুন্দর অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। এবং ভীষণ শূলহস্তে, নির্ঝরিণীপ্রেরিত জলবিম্ববৎ সেই অসীম যবনসেনাসমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন।
হেমচন্দ্র দেখিলেন, যবনেরা যুদ্ধ করিতেছে না, কেবল অপ হরণ করিতেছে। যুদ্ধজন্য কেহই তাহাদিগের সম্মুখীন হয় নাই, সুতরাং যুদ্ধে তাহাদিগেরও মন ছিল না। যাহাদিগের অপহরণ করিতেছিল তাহাদিগকেই অপহরণকালে বিনাযুদ্ধে মারিতে ছিল। সুতরাং যবনেরা দলবদ্ধ হইয়া হেমচন্দ্রকে নষ্ট করিবার কোন উদ্যোগ করিল না। যে কোন যবন তৎকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া তাঁহার সহিত একা যুদ্ধোদ্যম করিল সে তৎক্ষণাৎ মরিল।
হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। তিনি যুদ্ধাকাঙ্ক্ষায় আসিয়াছিলেন, কিন্তু যবনেরা পূর্ব্বেই বিজয় লাভ করিয়াছে, অর্থসংগ্রহ ত্যাগ করিয়া তাঁহার সহিত রীতিমত যুদ্ধ করিল না। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “একটি একটি করিয়া গাছের পাতা ছিঁডিয়া কে অরণ্যকে নিষ্পত্র করিতে পারে? একটি একটি যবন মারিয়া কি করিব? যবন যুদ্ধ করিতেছে না—যবন বধেই বা কি সুখ? বরং গৃহীদিগের রক্ষার সাহায্যে মন দেওয়া ভাল।” হেমচন্দ্র তাহাই করিতে লাগিলেন, কিন্তু বিশেষ কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। দুইজন যবন তাঁহার সহিত যুদ্ধ করে, অপর যবনে সেই অবসরে গৃহস্থদিগের সর্ব্বস্বান্ত করিয়া চলিয়া যায়। যাহাই হউক হেমচন্দ্র যথাসাধ্য পীড়িতের উপকার করিতে লাগিলেন। পথপার্শ্বে এক কুটীর মধ্য হইতে হেমচন্দ্র আর্ত্তনাদ শ্রবণ করিলেন। যবন কর্ত্তৃক আক্রান্ত ব্যক্তির আর্ত্তনাদ বিবেচনা করিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
দেখিলেন গৃহমধ্যে যবন নাই। কিন্তু গৃহমধ্যে যবনদৌরাত্ম্যের চিহু সকল বিদ্যমান রহিয়াছে। দ্রব্যাদি প্রায় কিছুই নাই যাহা আছে তাহার ভগ্নাবস্থা, আর এক ব্রাহ্মণ আহত অবস্থায় ভূমে পড়িয়া আর্ত্তনাদ করিতেছে। সে এ প্রকার গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে যে মৃত্যু আসন্ন। হেমচন্দ্রকে দেখিয়া সে যবন ভ্রমে কহিতে লাগিল,
“আইস—প্রহার কর—শীঘ্র মরিব—মার—আমার মাথা লইয়া সেই রাক্ষসীকে দিও—আঃ—প্রাণ যায়—জল! জল! কে জল দিবে।”
হেমচন্দ্র কহিলেন “তোমার গৃহে জল আছে?”
ব্রাহ্মণ কাতরোক্তিতে কহিতে লাগিল—“জানি না—মনে হয় না—জল! জল! পিশাচি!—সেই পিশাচীর জন্য প্রাণ গেল।”
হেমচন্দ্র কুটীর মধ্যে অন্বেষণ করিয়া দেখিলেন, এক কলসে জল আছে। পাত্রাভাবে পত্রপুটে তাহাকে জল দান করিলেন। ব্রাহ্মণ কহিল “না!—না! জল খাইব না! যবনের জল খাইব না।” হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যবন নহি, আমি আর্য্যবর্ণ—আমার স্পৃষ্ট জল পান করিতে পার। আমার কথায় বুঝিতে পারিতেছ না।”
ব্রাহ্মণ জলপান করিল। হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার আর কি উপকার করিব?”
ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কি করিবে? আর কি? আমি মরি। মরি! যে মরে তাহার কি করিবে?” হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার কেহ আছে? তাহাকে তোমার নিকট রাখিয়া যাইব?”
ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কে—কে আছে? কেবল—কেবল সেই রাক্ষসী। সেই রাক্ষসী—তাহাকে—বলিও—বলিও আমার অপ—অপরাধের প্রতিশোধ হইয়াছে।”
হেমচন্দ্র। “কে সে? কাহাকে বলিব?”
ব্রাহ্মণ কহিতে লাগিল—“কে সে? সে পিশাচী? পিশাচী চেন না? পিশাচী মৃণালিনী—মৃণালিনী! মৃণালিনী—পিশাচী।”
ব্রাহ্মণ অধিকতর আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল।—হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নাম শুনিয়া চমকিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃণালিনী তোমার কে হয়?”
ব্রাহ্মণ কহিলেন “মৃণালিনী কে হয়? কেহ না—আমার যম।”
হেমচন্দ্র। “মৃণালিনী তোমার কি করিয়াছে?”
ব্রাহ্মণ। “কি করিয়াছে?—কিছু না—আমি তার—দুর্দ্দশা করিয়াছি, তাহার প্রতিশোধ হইল—”
হেমচন্দ্র। “কি দুর্দ্দশা করিয়াছ?”
ব্রাহ্মণ। “আর কথা কহিতে পারি না, জল দাও।”
হেমচন্দ্র পুনর্ব্বার তাহাকে জলপান করাইলেন। ব্রাহ্মণ জলপান করিয়া স্থির হইলে হেমচন্দ্র তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার নাম কি?”
ব্রা। “ব্যোমকেশ।”
হেমচন্দ্রের চক্ষুঃ হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। দন্তে অপর দংশন করিলেন। করস্থ শূল দৃঢ়তর মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ধরিলেন। আবার তখনই শান্ত হইয়া কহিলেন,
“তোমার নিবাস কোথা?” ব্রা। “গৌড়—গৌড় জান না? মৃণালিনী আমার পিতার গৃহে থাকিত।”
হে। “তার পর?”
ব্রা। “তার পর—তার পর কি? তার পর আমার এই দশা—মৃণালিনী লক্ষ্মী—সাবিত্রী—আমার প্রতি ফিরিয়া চাহিল না। রাগ করিয়া আমার পিতার নিকট আমি তাহার মিথ্যাপবাদ দিলাম। পিতা তাহাকে বিনা দোষে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। রাক্ষসী—রাক্ষসী আমাদিগের গৃহ ত্যাগ করিয়া গেল।”
হে। “তবে তুমি তাহাকে গালি দিতেছ কেন?”
ব্রা। “কেন?—কেন গালি—গালি দিই? মৃণালিনী আমাকে ফিরিয়া দেখিত না—আমি—আমি তাহাকে দেখিয়া জীবন—জীবন ধারণ করিতাম। সে চলিয়া আসিল, সেই—সেই অবধি আমার সর্ব্বস্ব ত্যাগ, তাহার জন্য কোন্ দেশে—কোন দেশে না গিয়াছি—কোথায় পিশাচীর সন্ধান না করিয়াছি। গিরিজায়া—ভিখারীর মেয়ে—তার আযি বলিয়া দিল—নবদ্বীপে আসিয়াছে—নবদ্বীপে আসিলাম—সন্ধান নাই। যবন—যবন হস্তে মরিলাম, রাক্ষসীর জন্য মরিলাম দেখা হইলে বলিও—সতী লক্ষ্মীর অবমাননা করিয়াছিলাম—ফুল ফলিল।”
আর ব্যোমকেশের কথা সরিল না। সে পরিশ্রমে একেবারে নির্জ্জীব হইয়া পড়িল। নির্ব্বাণোন্মুখ দীপ নিবিল। বিকট মুখভঙ্গী করিয়া ব্যোমকেশ প্রাণত্যাগ করিল।
হেমচন্দ্র আর দাঁড়াইলেন না। আর যবন বধ করিলেন না। কোন মতে পথ করিয়া গৃহাভিমুখে চলিলেন।