মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।


যবনদূত—যমদূত বা।

 বেলা প্রহরেকের সময়ে নগরবাসীরা বিস্মিতলোচনে দেখিল, কোন অপরিচিত জাতীয় সপ্তদশ অশ্বারোহী পুরুষ রাজপথ অতিবাহিত করিয়া রাজভবনাভিমুখে যাইতেছে। তাহাদিগের আকারেঙ্গিত দেখিয়া নবদ্বীপবাসীরা ধন্যবাদ করিতে লাগিল। তাহাদিগের শরীর আয়ত, দীর্ঘ অথচ পুষ্ট; তাহাদিগের বর্ণ তপ্তকাঞ্চন সন্নিভ, তাহাদিগের মুখমণ্ডল বিস্তৃত, ঘনকৃষ্ণ শ্মশ্রুরাজি বিভূষিত; নয়ন প্রশস্ত, কৃষ্ণরেখাশোভিত। তাহাদিগের পরিচ্ছদ অনর্থক চাকচিক্যবিবর্জ্জিত; তাহাদিগের যোদ্ধৃবেশ; সর্ব্বাঙ্গে প্রহরণজাল মণ্ডিত; লোচনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আর যে সকল সিন্ধুপারজাত অশ্বপৃষ্ঠে তাহার আরোহণ করিয়া যাইতেছিল, তাহাই বা কি মনোহর! পর্ব্বত শিলাখণ্ডের ন্যায় বৃহদাকার, বিমার্জ্জিত-দেহ, বক্রগ্রীব, বল্‌গারোধাসহিষ্ণু, তেজোগর্ব্বে নৃত্যশীল! আরোহীরা কিবা তচ্চালন-কৌশলী—অবলীলা ক্রমে সেই রুদ্ধ বায়ুতুল্য তেজঃপ্রখর অশ্ব সকল দমিত করিতেছে। দেখিয়া বঙ্গবাসীরা বহুতর প্রশংসা করিল।

 সপ্তদশ অশ্বারোহী দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় অধরোষ্ঠ সংশ্লিষ্ট করিয়া নীরবে রাজপুরাভিমুখে চলিল। কৌতুহল বশতঃ কোন নগরবাসী কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, সমভিব্যাহারী একজন ভাষাজ্ঞ ব্যক্তি বলিয়া দিতে লাগিল “ইহারা যবন রাজার দূত।” এই বলিয়া ইহার প্রান্তরাল ও কোষ্ঠপালদিগের নিকট পরিচয় দিয়াছিল—এবং পশুপতির আজ্ঞা ক্রমে সেই পরিচয়ে নির্ব্বিঘ্নে নগরমধ্যে প্রবেশলাভ করিল।

 সপ্তদশ অশ্বারোহী রাজদ্বারে উপনীত হইল। বৃদ্ধ রাজার শৈথিল্যে আর পশুপতির কৌশলে রাজপুরী প্রায় রক্ষকহীন। রাজসভা ভঙ্গ হইয়াছিল—পুরীমধ্যে কেবল পৌরজন ছিল মাত্র —অল্পসংখ্যক দৌবারিক দ্বার রক্ষা করিতেছিল। এক জন দৌবারিক জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কি জন্য আসিয়াছ?”

 যবনেরা উত্তর করিল “আমরা যবন রাজপ্রতিনিধির দূত; বঙ্গরাজের সহিত সাক্ষাৎ করিব।”

 দৌবারিক কহিল “মহারাজাধিরাজ বঙ্গেশ্বর এক্ষণে অন্তঃপুরে গমন করিয়াছেন—এখন সাক্ষাৎ হইবে না।”

 যবনেরা নিষেধ না শুনিয়া মুক্ত দ্বারপথে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইল। সর্ব্বাগ্রে একজন খর্ব্বকায়, দীর্ঘবাহু, কুরূপ যবন। দুর্ভাগ্যবশতঃ দৌবারিক তাহার গতিরোধ জন্য শূলহস্তে তাহার  সম্মুখে দাঁড়াইল। কহিল “পশ্চাৎ অপসৃত হও—নচেৎ এক্ষণেই বর্ষাঘাতে মারিব।”

 “আপনিই তবে মর!” এই বলিয়া ক্ষুদ্রাকার যবন দৌবারিককে নিজ করস্থ বর্ষাগ্রে বিদ্ধ করিল। দৌবারিক প্রাণত্যাগ করিল। তখন আপন সঙ্গীদিগের মুখাবলোকন করিয়া ক্ষুদ্রকায় যবন কহিল, “এক্ষণে আপন আপন কার্য্য কর।” অমনি ষোড়শ বাক্যহীন অশ্বারোহীদিগের মধ্য হইতে ভীষণ জয়ধ্বনি সমুখিত হইল। তখন সেই ষোডশ যবনের কটিবন্ধ হইতে ষোড়শ অসিফলক নিষ্কোষিত হইল—এবং অশণি সম্পাত সদৃশ তাহার দৌবারিকদিগকে আক্রমণ করিল। দৌবারিকেরা রণসজ্জায় ছিল না—অকস্মাৎ নিরুদ্যোগে আক্রান্ত হইয়া আত্মরক্ষার কোন চেষ্টা করিতে পারিল না—মুহূর্ত্ত মধ্যে সকলেই নিপাত হইল।

 ক্ষুদ্রকায় যবন কহিল “যেখানে যাহাকে পাও বধ কর। পুরী অরক্ষিতা—বৃদ্ধ রাজাকে বধ কর।”

 তখন যবনেরা পুর মধ্যে তড়িতের ন্যায় প্রবেশ করিয়া বালবৃদ্ধবনিতা পৌরজন যেখানে যাহাকে দেখিল তাহাকে অসি দ্বারা ছিন্নমস্তক অথবা শূলাগ্রে বিদ্ধ করিল।

 পৌরজন তুমুল আর্ত্তনাদ করিয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল। সেই ঘোর আর্ত্তনাদ, অন্তঃপুরে যথায় বৃদ্ধ রাজা ভোজন করিতেছিলেন তথায় প্রবেশ করিল। তাঁহার মুখ শুকাইল। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ঘটিয়াছে—যবন আসিয়াছে?”

 পলায়নতৎপর পৌরজনেরা কহিল “যবন সকলকে বধ করিয়া আপনাকে বধ করিতে আসিতেছে।”

 কবলিত অন্নগ্রাস রাজার মুখ হইতে পড়িয়া গেল। তাঁহার শুস্ক শরীর জলস্রোতঃপ্রহত বেতসের ন্যায় কাঁপিতে লা গিল। নিকটে রাজমহিষী ছিলেন—রাজা ভোজন পাত্রের উপর পড়িয়া যান দেখিয়া মহিষী তাঁহার হস্ত ধরিলেন; কহিলেন,

 “চিন্তা নাই—আপনি গাত্রোত্থান করুন।” এই বলিয়া তাঁহার হস্ত ধরিয়া তুলিলেন। রাজা কলের পুত্তলীর ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিলেন।

 মহিষী কহিলেন, “চিন্তা কি? নৌকায় সকল দ্রব্য নীত হইয়াছে, চলুন আমরা খড়ক্কী দ্বার দিয়া পুরুষোত্তম যাত্রা করি।”

 এই বলিয়া মহিষী রাজার অধৌত হস্ত ধারণ করিয়া খড়ক্কী দ্বার পথে পুরুষোত্তম যাত্রা করিলেন। সেই রাজকুলকলঙ্ক অসমর্থ রাজার সঙ্গে বঙ্গরাজ্যের রাজলক্ষ্মীও যাত্রা করিলেন।

 ষোড়শ সহচর লইয়া কর্কটাকার বখ্‌তিয়ার খিলিজি গৌড়ে শ্বরের রাজপুরী অধিকার করিল।

 ষষ্টি বৎসর পরে যবন ইতিহাসবেত্তা মিন্‌হাজদ্দীন এইরূপ লিখিয়াছিলেন। ইহার কতদূর সত্য কতদূর মিথ্যা তাহা কে জানে? যখন মনুষ্যের লিখিত চিত্রে, সিংহ পরাজিত, মনুষ্য সিংহের অপমান কর্ত্তা স্বরূপ চিত্রিত হইয়াছিল, তখন সিংহের হস্তে চিত্রফলক দিলে কিরূপ চিত্র লিখিত হইত? মনুষ্য মুষিক তুল্য প্রতীয়মান হইত সন্দেহ নাই। মন্দভাগিনী বঙ্গভূমি, সহজেই দুর্ব্বলা, আবার তাহাতে শত্রু হস্তে চিত্রফলক!