মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।


বিহঙ্গিনী পিঞ্জরে।

 পশুপতি, মনোরমার বুদ্ধিপ্রদীপ জ্বালিবার অনেক যত্ন করিতে লাগিলেন কিন্তু ফলোৎপত্তি কঠিন হইল। পরিশেষে বলিলেন, “মনোরমে, রাত্রি অধিক হইয়াছে। আমি শয়নে যাই।”

 মনোরমা অম্লান বদনে কহিলেন, “যাও।”

 পশুপতি শয়নে গেলেন না। বসিয়া মালা গাঁথা দেখিতে লাগিলেন। আবার উপায়ান্তর স্বরূপ, ভয়সূচক চিন্তায় কার্য্য সিদ্ধি হইবেক ভাবিয়া, মনোরমাকে ভীতা করিবার জন্য পশুপতি কহিলেন, “মনোরমে, যদি ইতিমধ্যে যবন আইসে, তবে তুমি কোথায় যাইবে?”

 মনোরমা মালা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিলেন, “বাটীতে থাকিব।”

 পশুপতি কহিলেন, “বাটীতে তোমাকে কে রক্ষা করিবে?”

 মনোরমা পূর্ব্ববৎ অন্যমনে কহিলেন, “জানি না। নিরুপায়।”

 পশুপতি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমাকে কি বলিতে মন্দিরে আসিয়াছ?”

 ম। “দেবতা প্রণাম করিতে।”

 পশুপতি বিরক্ত হইলেন। কহিলেন, তোমাকে মিনতি করিতেছি, মনোরমে, এইবার যাহা বলিতেছি, তাহা মনোযোগ দিয়া শুন—তুমি আজিও বল, আমাকে বিবাহ করিবে কি না?”

 মনোরমার মালা সম্পন্ন হইয়াছিল—তিনি তাহা কৃষ্ণ মার্জ্জা রের গলায় পরাইতে ছিলেন—পশুপতির কথা কর্ণে গেল না। মার্জ্জার মালা পরিধানে বিশেষ অনিচ্ছা প্রকাশ করিতেছিল— যত বার মনোরমা মালা তাহার গলায় দিতে ছিলেন, তত বার সে মালার ভিতর হইতে মস্তক বাহির করিয়া লইতেছিল— মনোরমা কুন্দনিন্দিত দন্তে অধর দংশন করিয়া ঈষৎ হাসিতে ছিলেন আর আবার মালা তাহার গলায় দিতে ছিলেন। পশুপতি অধিকতর বিরক্ত হইয়া বিড়ালকে এক চপেটাঘাত করিলেন—বিড়াল উর্দ্ধলাঙ্গূল হইয়া দূরে পলায়ন করিল। মনোরমা সেইরূপ দংশিতাধরে হাসিতে হাসিতে করস্থ মালা—পশুপতিরই মস্তকে পরাইয়া দিলেন।

 মার্জ্জার প্রসাদ মস্তকে পাইয়া রাজপ্রসাদভোগী ধর্ম্মাধিকার হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন। অল্প ক্রোধ হইল—কিন্তু দংশিতাধরা হাস্যময়ীর তৎকালে অনুপম রূপমাধুরী দেখিয়া তাঁহার মস্তক ঘূরিয়া গেল। তিনি মনোরমাকে আলিঙ্গন করিবার জন্য বাহু প্রসারণ করিলেন—অমনি মনোরমা লম্ফ দিয়া দূরে দাঁড়াইল—পথিমধ্যে উন্নতফণা কালসর্প দেখিয়া পথিক যেমন দূরে দাঁড়ায় সেইরূপ দাঁড়াইল।

 পশুপতি অপ্রতিভ হইলেন; ক্ষণেক মনোরমার মুখ প্রতি চাহিতে পারিলেন না—পরে চাহিয়া দেখিলেন—মনোরমা প্রৌঢ়বয়সী মহিমাময়ী সুন্দরী।

 পশুপতি কহিলেন, “মনোরমে, দোষ ভাবিও না। তুমি আমার পত্নী—আমাকে বিবাহ কর।” মনোরমা পশুপতির মুখপ্রতি তীব্র কটাক্ষ করিয়া কহিলেন,

 “পশুপতি! কেশবের কন্যা কোথায়?”

 পশুপতি কহিলেন, “কেশবের কন্যা কোথায় জানি না—জানিতেও চাহি না। তুমি আমার একমাত্র পত্নী।”  ম। “আমি জানি কেশবের কন্যা কোথায়—বলিব?”

 পশুপতি অবাক্ হইয়া মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। মনোরমা বলিতে লাগিলেন,

 এক জন জ্যোতির্ব্বিদ গণনা করিয়া বলিয়াছিল যে কেশবের কন্যা অল্পবয়সে বিধবা হইয়া স্বামীর অনুমৃতা হইবেন। কেশব এই কথায়, অল্পকালে কন্যার বিয়োগ শঙ্কা করিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন। তিনি ধর্ম্মনাশ ভয়ে অগত্যা কন্যাকে পাত্রস্থা করিলেন, কিন্তু বিধিলিপি খণ্ডাইবার ভরসায় বিবাহের রাত্রেই কন্যা লইয়া প্রয়াগধামে পলায়ন করিলেন। তাঁহার অভিলাষ এই ছিল যে তাঁহার কন্যা স্বামীর মৃত্যু সম্বাদ কস্মিন্‌কালে না পাইতে পারেন। দৈবাধীন কিয়ৎকাল পরে প্রয়াগে কেশবের মৃত্যু হইল। তাঁহার কন্যা পূর্ব্বেই মাতৃহীনা হইয়াছিল—এক্ষণে মৃতুকালে কেশব হৈমবতীকে উপাধ্যায়ের হস্তে সমর্পণ করিয়া গেলেন। মৃত্যুকালে কেশব উপাধ্যায়কে এই কথা বলিয়া গেলেন, ‘গুরো!—এই অনাথা কন্যাকে আপন গৃহে রাখিয়া প্রতিপালন করিবেন। ইহার স্বামী পশুপতি—কিন্তু জ্যোতির্ব্বিদেরা বলিয়া গিয়াছেন যে ইনি অল্পবয়সে স্বামীর অনুমৃতা হইবেন। অতএব আপনি আমার নিকট প্রতিশ্রুত হউন, যে এই কন্যাকে কখন জ্ঞাত করাইবেন না যে পশুপতি ইহার স্বামী। অথবা পশুপতিকে কখন জানাইবেন না যে ইনি তাঁহার পত্নী।”

 উপাধ্যায় তদ্রূপ প্রতিশ্রুত হইলেন। সেই পর্য্যন্ত তিনি তাহাকে পরিবারস্থা করিয়া প্রতিপালন করিয়া তোমার সহিত বিবাহের কথা গোপন করিয়াছেন।”

 প। “এখন সে কন্যা কোথায়?”  ম। “আমিই কেশবের কন্যা—জনার্দ্দন শর্ম্মা তাঁহার উপাধ্যায়।”

 পশুপতি চিত্ত হারাইলেন; তাঁহার মস্তক ঘূরিতে লাগিল। তিনি বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া প্রতিমাসমীপে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। পরে গাত্রোত্থান করিয়া মনোরমাকে বক্ষে ধারণ করিতে গেলেন। মনোরমা পূর্ব্ববৎ সরিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন,

 “এখন নয়—আরও কথা আছে।”

 প। “মনোরমে—রাক্ষসি! এতদিন কেন আমাকে এ অন্ধকারে রাখিয়াছিলে?”

 ম। “কেন? তুমি কি আমার কথায় বিশ্বাস করিতে?”

 প। “মনোরমে, তোমার কথায় কবে আমি অবিশ্বাস করিয়াছি? আর যদিই আমার অপ্রত্যয় জন্মিত, তবে আমি জনার্দ্দন শর্ম্মাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিতাম।”

 ম। “জনার্দ্দন কি তাহা প্রকাশ করিতেন? তিনি শিষ্যের নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছেন।”

 প। “তবে তোমার কাছে প্রকাশ করিলেন কেন?”

 ম। তিনি আমার নিকট প্রকাশ করেন নাই। একদিন গোপনে ব্রাহ্মণীর নিকট প্রকাশ করিতেছিলেন। আমি দৈবাৎ গোপনে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম। আরও, আমি বিধবা বলিয়া পরিচিতা। তুমি আমার কথায় প্রত্যয় করিলে লোকে প্রত্যয় করিবে কেন? তুমি জনসমাজে নিন্দনীয় না হইয়া কি প্রকারে আমাকে গ্রহণ করিতে?”

 প। “আমি সকল লোককে একত্রিত করিয়া তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলিতাম।”

 ম। “ভাল, তাহাই হউক—জ্যোতির্ব্বিদের গণনা?”  প। “আমি গ্রহশান্তি করাইতাম। ভাল, যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে যদি আমি রত্ন পাইয়াছি, তবে আর তাহা কণ্ঠচ্যুত করিব না। তুমি আর আমার গৃহ ত্যাগ করিয়া যাইতে পারিবে না।”

 মনোরমা কহিলেন, “এ গৃহ ত্যাগ করিতে হইবে। পশুপতি, আমি যাহা আজি বলিতে আসিয়াছিলাম, তাহা বলি শুন। এ গৃহ ত্যাগ কর। তোমার রাজ্যলাভের দুরাশা ত্যাগ কর। প্রভুর প্রতি অহিতাচরণের কল্পনা ত্যাগ কর। এ দেশ ত্যাগ কর। চল, আমরা কাশীধামে যাত্রা করি। সেইখানে আমি তোমার চরণ সেবা করিয়া জীবন সার্থক করিব। যে দিন আমাদিগের আয়ুঃশেষ হইবে, একত্রে পরমধামে যাত্রা করিব। যদি ইহা স্বীকৃত হও—আমার ভক্তি অচলা থাকিবে। নহিলে—”

 প। “নহিলে কি?”

 মনোরমা তখন, উন্নতমুখে, সবাস্পলোচনে, দেবীপ্রতিমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, যুক্তকরে, গদ্গদ কণ্ঠে কহিলেন, “নহিলে, দেবী সমক্ষে শপথ করিতেছি তোমায় আমায় এই সাক্ষাৎ। এ জন্মে আর সাক্ষাৎ হইবে না।”

 পশুপতিও দেবীর সমক্ষে বদ্ধাঞ্জলি হইয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন,

 “মনোরমে—আমিও শপথ করিতেছি, আমার জীবন থাকিতে তুমি আমার গৃহ ত্যাগ করিয়া যাইতে পাইবে না। মনেরমে, আমি যে পথে পদার্পণ করিয়াছি—সে পথ হইতে ফিরিবার উপায় থাকিলে আমি ফিরিতাম—তোমাকে লইয়া সর্ব্বত্যাগী হইয়া কাশী যাত্রা করিতাম। কিন্তু অনেক দূর গিয়াছি; আর ফিরিবার উপায় নাই—যে গ্রন্থি বদ্ধ করিয়াছি তাহা আর খুলিতে পারি না—স্রোতে ভেলা ভাসাইয়া আর ফিরাইতে পারি না। যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে। তাই বলিয়া কি আমার পরম সুখে আমি বঞ্চিত হইব? তুমি আমার পত্নী—আমার কপালে যাই থাকুক, আমি তোমাকে গৃহিণী করিব। তুমি ক্ষণেক অপেক্ষা কর—আমি শীঘ্র আসিতেছি।” এই বলিয়া পশুপতি শীঘ্র মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। মনোরমার চিত্তে সংশয় জন্মিল। তিনি চিন্তিতান্তঃকরণে কিয়ৎক্ষণ মন্দির মধ্যে দাঁড়াইয়া রহিলেন। আর একবার পশুপতির নিকট বিদায় না লইয়া যাইতে পারিলেন না।

 অল্পকাল পরেই পশুপতি ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, “রাণাধিকে! আজি আর তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে পারিবে না। আমি সকল দ্বার রুদ্ধ করিয়া আসিয়াছি।”

 মনোরমা বিহঙ্গিনী পিঞ্জরে বন্ধ হইল।