মৃণালিনী (১৮৭৪)/তৃতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
প্রতিজ্ঞা—পর্ব্বতো বহ্নিমান্।
নিদ্রাগুণে হেমচন্দ্র কিঞ্চিৎ সবল হইয়াছিলেন। শােণিতস্রাবও কতক মন্দীভূত হইয়াছিল। শূলে ভর করিয়া হেমচন্দ্র স্বচ্ছন্দে গৃহে প্রত্যাগমন করিতে পারিলেন।
গৃহে আসিয়া দেখিলেন, মনােরমা দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া আছেন।
মৃণালিনী ও গিরিজায়া অন্তরালে থাকিয়া মনােরমাকে দেখিলেন।
মনােরমা চিত্রার্পিত পুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। দেখিয়া মৃণালিনী মনে মনে ভাবিলেন, “আমার প্রভু যদি রূপে বশীভূত হয়েন, তবে আমার সুখের নিশি প্রভাত হইয়াছে।” গিরিজায়া ভাবিল, “রাজপুত্ত্র যদি রূপে মুগ্ধ হয়েন, তবে আমার ঠাকুরাণীর কপাল ভাঙ্গিয়াছে।”
হেমচন্দ্র মনােরমার নিকট আসিয়া কহিলেন, “মনােরমে—এমন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছ কেন?”
মনােরমা কোন কথা কহিলেন না। হেমচন্দ্র পুনরপি ডাকিলেন, “মনােরমে!”
তথাপি উত্তর নাই; হেমচন্দ্র দেখিলেন আকাশমার্গে তাঁহার স্থিরদৃষ্টি স্থাপিত হইয়াছে।
হেমচন্দ্র পুনর্ব্বার বলিলেন, “মনোরমে, কি হইয়াছে?”
তখন মনােরমা ধীরে ধীরে আকাশ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া হেমচন্দ্রের মুখমণ্ডলে স্থাপিত করিলেন। এবং কিয়ৎকাল অনিমিক্লোচনে তৎপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। পরে হেমচন্দ্রের রুধিরাক্ত পরিচ্ছদে দৃষ্টিপাত হইল। তখন মনােরম বিস্মিত হইয়া কহিলেন।
“একি হেমচন্দ্র? রক্ত কেন? তােমার মুখ শুষ্ক; তুমি কি আহত হইয়াছ?”
হেমচন্দ্র অঙ্গুলির দ্বারা স্কন্ধের ক্ষত দেখাইয়া দিলেন।
মনােরমা, তখন হেমচন্দ্রের হস্তধারণ করিয়া গৃহমধ্যে পালঙ্কোপরি লইয়া গেলেন। এবং পলকমধ্যে বারিপূর্ণ ভৃঙ্গার আনীত করিয়া, একে একে হেমচন্দ্রের গাত্রবসন পরিত্যক্ত করাইয়া অঙ্গের রুধির সকল ধৌত করিলেন। এবং গােজাতিপ্রলোভন নবদূর্ব্বাদল ভূমি হইতে ছিন্ন করিয়া আপন কুন্দনিন্দিত দন্তে চর্ব্বিত করিলেন। পরে তাহা ক্ষতমুখে ন্যস্ত করিয়া উপবীতাকারে বস্ত্র দ্বারা বাঁধিলেন। তখন কহিলেন,
“হেমচন্দ্র! আর কি করিব? তুমি সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিআছ, নিদ্রা যাইবে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “নিদ্রাভাবে নিতান্ত কাতর হইতেছি।”
মৃণালিনী মনােরমার কার্য্য দেখিয়া চিন্তান্তঃকরণে গিরিজায়াকে কহিলেন, “এ কে গিরিজায়ে?”
গি। “নাম শুনিলাম মনেরমা।”
মৃ। “এ কি হেমচন্দ্রের মনােরমা?”
গি। “তুমি কি বিবেচনা করিতেছ?”
মৃ। “আমি ভাবিতেছি, মনের মাই ভাগ্যবতী। আমি হেমচন্দ্রের সেবা করিতে পাইলাম না, সে করিল। যে কার্য্যের জন্য আমার অন্তঃকরণ দগ্ধ হইতেছিল—মনােরমা সে কার্য্য সম্পন্ন করিল—দেবতারা উহাকে আয়ুষ্মতী করুন। গিরিজায়ে, আমি-গৃহে চলিলাম আমার আর থাকা উচিত নহে। তুমি এই পল্লীতে থাক, হেমচন্দ্র কেমন থাকেন সম্বাদ লইয়া যাইও। মনােরমা যেই হউক, হেমচন্দ্র আমারই।”
কে বলে সমুদ্রতলে রত্ন জন্মে? এ সংসারে রত্ন রমণীর হৃদয়।