মৃণালিনী (১৮৭৪)/তৃতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ
তৃতীয় খণ্ড।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
“উনি তােমার কে?”
যে কুটীরের নিকটস্থ বৃক্ষতলে বসিয়া হেমচন্দ্র বিশ্রাম করিতেছিলেন। সেই কুটীর মধ্যে এক পাটনী বাস করিত। কুটীর মধ্যে তিনটী ঘর। এক ঘরে পাটনীর পাকাদি সমাপন হইত। অপর ঘরে পাটনীর পত্নী শিশু সন্তান সকল লইয়া শয়ন করিয়াছিল। তৃতীয় ঘরে পাটনীর যুবতী কন্যা রত্নময়ী আর অপর দুইটী স্ত্রীলােক শয়ন করিয়াছিল। সেই দুইটী স্ত্রীলােক পাঠক মহাশয়ের নিকট পরিচিত; মৃণালিনী আর গিরিজায়া নবদ্বীপে অন্যত্র আশ্রয় না পাইয়া এই স্থানে আশ্রয় লইয়াছিলেন।
একে একে তিনটী স্ত্রীলােক প্রভাতে জাগরিতা হইল। প্রথমে রত্নময়ী জাগিল। গিরিজায়াকে সম্বােধন করিয়া কহিল।
“সই?”
গি। “কি সই?”
র। “তুমি কোথায় সই?”
গি। “বিছানা সই।”
র। “উঠ না সই!” গি। “না সই।”
র। “গায়ে জল দিব সই।”
গি। “জল সই? ভাল সই, তাও সই।”
র। “নহিলে ছাড়ি কই।”
গি। “ছাড়িবে কেন সই? তুমি আমার প্রাণের সই— তোমার মত আছে কই? তুমি পারঘাটার রসমই—তোমায় না কইলে আর কারে কই?”
র। “কথায় সই তুমি চির জই; আমি তোমার কাছে বোবা হই, আর মিলাইতে পারি কই?”
গি। “আমি মিলাইব? খই আর দই।”
র। “সকাল বেলাই খাই খাই?”
গি। “খেতে কই পাই।”
র। “আর মিল পাইনে ভাই।”
গি। “মিল আছে—তোমার মুখে ছাই।”
র। “পোড়ার মুখে ছাই, ঠিক মিলেছে ভাই, আর মিলে কাজ নাই, আমি কাজে যাই।”
গি। “কাজে? কি পার করিতে? দেখ তুফানে পড়ি ও না।”
র। “তুফান দেখিলে পাড়ি দিব কেন?”
গি। “কপালের কথা। কে বলিতে পারে? যদিই একদিন তুফানে পড়িলে?”
র। “হাল ছাড়িয়া দিব।”
গি। “ডুবে মরিবে যে?”
র। “গঙ্গায় মরিলে স্বর্গ পাব।”
গি। “তবে ডুবেই মর। আমি একটী গীত গাই—
সিন্ধুকূলে রই, নূতন তরি বই পারে তােরা, কে যাইবিগো।
নূতন ডিঙ্গায় নূতন মাঝি—কে যাইবিগো।
দান দিবে যেই, পার হবে সেই, দান দিয়ে, কে যাইবিগো।
অই দেখ বয়, মধুর মলয়, এই বেলা, কে যাইবিগো।
তুলে দিব পাল, না ছাড়িব হাল, সুখের পারে কে যাইবিগো।
যদি পথিক পাই, কূল তেজে যাই, অকূল মাঝে কে যাইবিগো।
পাইলে তুফান, আগে দিব প্রাণ, আমার সাতে, কে যাইবিগো।”
রত্নময়ী কহিল, “তুমি আমার অপেক্ষাও রসের পাটনী। বেলা না হইলে আরও দুই একটী গীত শুনিতাম। এখন গৃহের কাজ সারিয়া ঘাটের কাজে যাই।”
এই বলিয়া রত্নময়ী গৃহকর্মে গেল। মৃণালিনী এপর্য্যন্ত কোন কথা কহেন নাই। এখন গিরিজায়া তাঁহাকে সম্বােধন করিয়া কহিল,
“ঠাকুরাণি জাগিয়াছ?”
মৃণালিনী কহিলেন, “জাগিয়াই আছি। জাগিয়াই থাকি। তােমার গান শুনিতে ছিলাম—তােমার মত কাণ্ডারীকে কেহ যেন বিশ্বাস করে না।”
গি। “কেন?”
মৃ। “তুমি ঘাটে আনিয়া আমায় ডুবাইলে।”
গিরিজায়া তখন গম্ভীরভাবে কহিল, “কি করিব? আমার দোষ নাই। আমি শুনিয়াছি তিনি এই নগরমধ্যে আছেন; এপর্য্যন্ত সন্ধান পাই নাই। কিন্তু আমরা ত সবে দুই তিন দিন আসিয়াছি মাত্র। শীঘ্র সন্ধান করিব।”
মৃ। “গিরিজারে—যদি এ নগরে সন্ধান না পাই। তবে যে এই পাটনীর গৃহে মৃত্যু পর্য্যন্ত বাস করিতে হইবে। আমার যে যাইবার স্থান নাই।
মৃণালিনী উপাধানে মুখ লুকাইলেন। গিরিজায়ার গণ্ডে নীরবস্রুত অশ্রু বহিতে লাগিল।
এমত সময়ে—রত্নময়ী শশব্যস্তে গৃহমধ্যে আসিয়া কহিল, “সই! সই! দেখিয়া যাও। আমাদিগের বটতলায় কে ঘুমাইতেছে। আশ্চর্য্য পুরুষ!”
গিরিজায়া কুটীর দ্বারে দেখিতে আইল। মৃণালিনীও কুটীর দ্বার পর্য্যন্ত আসিয়া দেখিলেন। উভয়েই দৃষ্টিমাত্র চিনিলেন।
সাগর একেবারে উছলিয়া উঠিল। মৃণালিনী গিরিজায়াকে আলিঙ্গন করিলেন। গিরিজায়া গায়িল,
“কণ্টকে গঠিল বিধি মৃণাল অধমে।”
সেই ধ্বনি স্বপ্নবৎ হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল। মৃণালিনী গিরিজায়ার কণ্ঠকণ্ডুয়ন দেখিয়া কহিলেন,
“চুপ, রাক্ষসি, আমাদিগের দেখা দেওয়া হইবে না, ঐ উনি জাগরিত হইতেছেন। এই অন্তরাল হইতে দেখ উনি কি করেন। উনি যেখানে যান, অদৃশ্য ভাবে, দূরে থাকিয়া, উঁহার সঙ্গে যাও।—একি! উঁহার অঙ্গ রক্তময় দেখিতেছি কেন? চল, তবে আমিও সঙ্গে চলিলাম।”
হেমচন্দ্র গাত্রোত্থান করিয়া কিয়দ্দূর গেলে, মৃণালিনী আর গিরিজায়া তাঁহার অনুসরণার্থ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইলেন। তখন রত্নময়ী জিজ্ঞাসা করিল,
“ঠাকুরাণি, উনি তােমার কে?”
মৃণালিনী কহিলেন, “দেবতা জানেন।”