মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।


অতিথিসৎকার।

 হেমচন্দ্র গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া এক সুন্দর অশ্ব সজ্জিত করিয়া তদুপরি আরোহণ করিলেন। এবং অশ্বে কষাঘাত করিয়া মহাবনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। নগর পার হইলেন; তৎপরে প্রান্তর। প্রান্তরেরও কিয়দংশ পার হইলেন, এমত সময়ে অকস্মাৎ স্কন্ধদেশে গুরুতর বেদনা পাইলেন। দেখিলেন, স্কন্ধে একটা তীর বিদ্ধ হইয়াছে। পশ্চাতে অশ্বের পদধ্বনি শ্রুত হইল। ফিরিয়া দেখিলেন, তিনজন অশ্বারোহী আসিতেছে।

 হেমচন্দ্র ঘোটকের মুখ ফিরাইয়া তাহাদিগের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ফিরিবামাত্র দেখিলেন, প্রত্যেক অশ্বারোহী তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া এক এক শরসন্ধান করিল। হেমচন্দ্র বিচিত্র শিক্ষা কৌশলে করস্থ শূলান্দোলন দ্বারা তীরত্রয়ের এক কালীন নিবারণ করিলেন।

 অশ্বারোহিগণ পুনর্ব্বার একেবারে শরসংযোগ করিল। এবং তাহা নিবারিত হইতে না হইতেই পুনর্ব্বার শরত্রয় ত্যাগ করিল।

 এই রূপ অবিরত হস্তে হেমচন্দ্রের উপর বাণক্ষেপ করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র তখন বিচিত্র রত্নাদি মণ্ডিত চর্ম্ম হস্তে লইলেন, এবং তৎসঞ্চালন দ্বারা অবলীলাক্রমে সেই শরজাল বর্ষণ নিরাকরণ করিতে লাগিলেন; কদাচিৎ দুই এক শর অশ্ব শরীরে বিদ্ধ হইল মাত্র। স্বয়ং অক্ষত রহিলেন।

 বিস্মিত হইয়া অশ্বারোহিত্রয় নিরস্ত হইল। পরস্পরে কি পরামর্শ করিতে লাগিল। হেমচন্দ্র সেই অবকাশে তৎপ্রতি এক তীরত্যাগ করিলেন। যে শরবেধে কুতব-উদ্দীনের মত্তহস্তী ভূমিশায়ী হইয়াছিল, সেই জাতীয় বিশাল শরত্যাগ করিলেন। সে অব্যর্থ সন্ধান। শর, এক জন অশ্বারোহীর ললাট মধ্যে বিদ্ধ হইল। সে অমনি অশ্বপৃষ্ঠচ্যুত হইয়া ধরাতলশায়িত হইল।

 তৎক্ষণাৎ অপর দুই জনে অশ্বে কষাঘাত করিয়া, শূল যুগল প্রণত করিয়া হেমচন্দ্রের প্রতি ধাবমান হইল। এবং শূলক্ষেপ যোগ্য নৈকট্য প্রাপ্ত হইলে শূলক্ষেপ করিল। যদি তাহারা হেমচন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া শূলত্যাগ করিত, তবে হেমচন্দ্রের বিচিত্র শিক্ষায় তাহা নিবারিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তাহা না করিয়া আক্রমণ কারীরা হেমচন্দ্রের অশ্ব প্রতি লক্ষ্য করিয়া শূল ত্যাগ করিয়াছিল। তত দূর অধঃপর্য্যন্ত হস্ত সঞ্চালনে হেমচন্দ্রের বিলম্ব হইল। একের শূল নিবারিত হইল। অপরের সন্ধান নিবারিত হইল না। শূল অশ্বের গ্রীবাতলে বিদ্ধ হইল। সেই আঘাত প্রাপ্তি মাত্র সে রমণীয় ঘোটক মুমূর্ষু হইয়া ভূতলে পড়িল।

 সুশিক্ষিতের ন্যায় হেমচন্দ্র পতনশীল অশ্ব হইতে লম্ফদিয়া ভূতলে দাঁড়াইলেন। এবং পলক মধ্যে নিজকরস্থ করাল শূল উন্নত করিয়া কহিলেন, “আমার পিতৃদত্ত শূল শত্রুরক্ত পান না করিয়া কখন আমার হস্ত ত্যাগ করে নাই।” তাঁহার এই কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে তদগ্রে বিদ্ধ হইয়া দ্বিতীয় অশ্বারোহী ভূতলে পতিত হইল।

 ইহা দেখিয়া তৃতীয় অশ্বারোহী অশ্বের মুখ ফিরাইয়া বেগে পলায়ন করিল। সেই শান্তশীল।

 হেমচন্দ্র তখন অবকাশ পাইয়া নিজস্কন্ধবিদ্ধ তীর মোচন করিলেন। তীর কিছু অধিক মাংসভেদ করিয়াছিল—মোচন মাত্র অতিশয় শোণিত স্রুতি হইতে লাগিল। হেমচন্দ্র নিজপরিধান বস্ত্র দ্বারা তাহার নিবারণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহা নিষ্ফল হইল। ক্রমে হেমচন্দ্র রক্তক্ষতি হেতু দুর্ব্বল হইতে লাগিলেন। তখন বুঝিলেন, যে যবনশিবিরে গমনের অদ্য আর কোন সম্ভাবনা নাই। অশ্ব হত হইয়াছে—নিজবল হত হইতেছে। অতএব অপ্রসন্ন মনে, ধীরে ধীরে, নগরাভিমুখে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে লাগিলেন।

 হেমচন্দ্র প্রান্তর পার হইলেন। তখন শরীর নিতান্ত অবশ হইয়া আসিল—শোণিত-স্রোতে সর্ব্বাঙ্গ আর্দ্র হইল; গতিশক্তি রহিত হইয়া আসিতে লাগিল। কষ্টে নগরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। আর যাইতে পারেন না। এক কুটীরনিকটে বটবৃক্ষতলে উপবেশন করিলেন। তখন রজনী প্রভাত হইয়াছে। রাত্রি জাগরণ—সমস্ত রাত্রের পরিশ্রম—রক্তস্রাবে বলহানি— হেমচন্দ্রের চক্ষে পৃথিবী ঘূরিতে লাগিল। তিনি বৃক্ষমূলে পৃষ্ঠ রক্ষা করিলেন। চক্ষু মুদিত হইল—নিদ্রা প্রবল হইল— চেতন অপহৃত হইল। নিদ্রাবেশে স্বপ্নে যেন শুনিলেন কে গায়িতেছে,

“কণ্টকে গঠিল বিধি মৃণাল অধমে।”

 নিদ্রাভঙ্গ হইল। হেমচন্দ্র নয়নোন্মীলন করিয়া দেখিলেন, প্রাতঃসূর্য্যকিরণে পৃথিবী হাসিতেছে, শির উপরি শত শত পক্ষী মিলিত হইয়া সহর্ষে কলরব করিতেছে—নাগরিকেরা স্ব স্ব কার্য্যে যাইতেছে। হেমচন্দ্র শূলদণ্ডে ভর করিয়া গাত্রোত্থান পূর্ব্বক গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন।