মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
মোহিনী।
সেই রত্নপ্রদীপদীপ্ত দেবীমন্দিরে, চন্দ্রালোকবিভাসিত দ্বার দেশে, মনোরমাকে দেখিয়া, পশুপতির হৃদয় উচ্ছ্বাসোন্মুখ সমুদ্রের ন্যায় স্ফীত হইয়া উঠিল। মনোরমা নিতান্ত খর্ব্বাকৃতা নহে, তবে তাহাকে বালিকা বলিয়া বোধ হইত তাহার হেতু এই, যে, মুখকান্তি অনির্ব্বচনীয় কোমল, অনির্ব্বচনীয় মধুর। নিতান্ত বালিকা বয়সের ঔদার্য্য বিশিষ্ট—সুতরাং হেমচন্দ্র যে তাহার পঞ্চদশ বৎসর বয়ঃক্রম অনুভব করিয়াছিলেন, তাহা অন্যায় হয় নাই। মনোরমার বয়ঃক্রম যথার্থ পঞ্চদশ কি ষোডশ, কি তদধিক, কি তন্ন্যূন, তাহা ইতিহাসে লেখে না। পাঠক মহাশয় স্বয়ং সিদ্ধান্ত করিবেন।
মনোরমার বয়স্ যতই হউক না কেন, তাহার রূপরাশি অতুল—চক্ষে ধরে না। বাল্যে, কৈশোরে, যৌবনে, সর্ব্বকালে সে রূপরাশি দুর্ল্লভ। একে বর্ণ সোনার চাঁপা; তাহাতে ভুজঙ্গশিশুশ্রেণীর ন্যায়, কুঞ্চিত অলকশ্রেণী বেড়িয়া থাকে; এক্ষণে বাপীজলসিঞ্চনে ঋজু হইয়াছে; অর্দ্ধচন্দ্রাকৃত নির্ম্মলললাট; ভ্রমর-ভর-স্পন্দিত নীলপুষ্প তুল্য, কৃষ্ণতার, চঞ্চল, লোচন-যুগল; মুহুর্মুহুঃ আকুঞ্চন-বিস্ফারণ-প্রবৃত্ত রন্ধ্রযুক্ত সুগঠন নাসা; অধরৌষ্ঠ যেন প্রাতঃশিশিরে সিক্ত, প্রাতঃ সূর্যের কিরণে প্রোদ্ভিন্ন, রক্ত কুসুমাবলির স্তরযুগল তুল্য; কপোল যেন, চন্দ্রকরোজ্জ্বল, নিতান্ত স্থির, গঙ্গাম্বু বিস্তারবৎ প্রসন্ন; শাবক হিংসা শঙ্কায় উত্তেজিতা, হংসীর ন্যায় গ্রীবা,—বেণী বাঁধিলেও সে গ্রীবার উপরে অবাধ্য ক্ষুদ্র কুঞ্চিত কেশ সকল আসিয়া কেলি করে। দ্বিরদ রদ যদি কুসুমকোমল হইত, কিম্বা চম্পক যদি গঠনোপযোগী কাঠিন্য পাইত, কিম্বা চন্দ্রকিরণ যদি শরীর বিশিষ্ট হইত, তবে তাহাতে সে বাহুযুগল গড়িতে পারা যাইত, —সে হৃদয় কেবল সেই হৃদয়েই গড়া যাইতে পারিত। এ সকলই অন্য সুন্দরীর আছে; মনোরমার রূপরাশি অতুল কেবল তাঁহার সর্ব্বাঙ্গীন সৌকুমার্য্যের জন্য। তাঁহার বদন সুকুমার, অধর, ভ্রূযুগ, ললাট, সুকুমার। সুকুমার কপোল; সুকুমার কেশ। অলকাবলি যে ভুজঙ্গ শিশুরূপী, সেও সুকুমার ভুজঙ্গ শিশু। গ্রীবায়, গ্রীবাভঙ্গীতে, সৌকুমার্য্য; বাহুতে, বাহুর প্রক্ষেপে, সৌকুমার্য্য; হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে সেই সৌকুমার্য্য; সুকুমার চরণ, চরণ বিন্যাস সুকুমার। গমন সুকুমার, বসন্ত বায়ুসঞ্চালিত কুসুমিত লতার মন্দাদোলন তুল্য; বচন সুকুমার, নিশীথ সময়ে, জলরাশি পার হইতে সমাগত বিরহ সঙ্গীত তুল্য; কটাক্ষ সুকুমার, ক্ষণমাত্র জন্য মেঘমালামুক্ত সুধাংশুর কিরণ সম্পাত তুল্য; আর ঐ যে মনোরমা দেবীগৃহ দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া আছেন,—পশুপতির মুখাবলোকন জন্য উন্নত মুখী, নয়ন তারা উর্দ্ধস্থাপন-স্পন্দিত, আর বাপীজলার্দ্র, অবদ্ধ কেশরাশির কিয়দংশ এক হস্তে ধরিয়া, এক চরণ ঈষন্মাত্র অগ্রবর্ত্তী করিয়া, যে ভঙ্গীতে মনোরমা দাঁড়াইয়া আছেন;—ও ভঙ্গীও সুকুমার; নবীন সূর্য্যাগ্রে সদ্য প্রফুল্ল দলমালাময়ী নলিনীর প্রসন্ন ব্রীড়া তুল্য সুকুমার। সেই মাধুর্য্যময় দেহের উপর দেবীপার্শ্বস্থিত রত্নদীপের আলোক পতিত হইল। পশুপতি অতৃপ্ত নয়নে দেখিতে লাগিলেন।