মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
মোহিতা।
পশুপতি অতৃপ্ত নয়নে দেখিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে মনোরমার সৌন্দর্য্য-সাগরের এক অপূর্ব্ব মহিমা দেখিতে পাইলেন। যেমন সূর্য্যের প্রখর করমালায় হাস্যময় অম্বুরাশি মেঘ সঞ্চারে ক্রমে ক্রমে গম্ভীর কৃষ্ণ কান্তি প্রাপ্ত হয়, তেমনি পশুপতি দেখিতে দেখিতে মনোরমার সৌকুমার্য্যময় মুখমণ্ডল গম্ভীর হইতে লাগিল। আর সে বালিকা সুলভ ঔদার্য্য-ব্যঞ্জক ভাব রহিল না। অপূর্ব্ব তেজোভিব্যক্তির সহিত, প্রগল্ভ বয়সের ও দুর্লভ গাম্ভীর্য্য তাহাতে বিরাজ করিতে লাগিল। পশুপতি কহিলেন, “মনোরমে, এত রাত্রে কেন আসিয়াছ?—এ কি? আজি তোমার এ ভাব কেন?”
মনোরমা উত্তর করিলেন, “আমার কি ভাব দেখিলে?”
প। “তোমার দুই মূর্ত্তি—এক মূর্ত্তি আনন্দময়ী, সরলা, বালিকা—সে মুর্ত্তিতে কেন আসিলে না—সেই রূপে আমার হৃদয় শীতল হয়। আর তোমার এই মূর্ত্তি—গম্ভীরা, তেজস্বিনী, প্রখর বুদ্ধিশালিনী—সেমূর্ত্তি দেখিলে আমি ভীত হই। তখন বুঝিতে পারি, যে তুমি কোন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছ। আজি তুমি এ মূর্ত্তিতে আমাকে ভয় দেখাইতে কেন আসিয়াছ?”
ম। “পশুপতি, তুমি এত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি করিতেছ?”
প। “আমি রাজকার্য্যে ব্যস্ত ছিলাম—কিন্তু তুমি—”
ম। “পশুপতি, আবার? রাজ কার্য্যে না আত্মকার্য্যে?”
প। “আত্মকার্য্যই বল। রাজকার্য্যই হউক আর আত্মকার্য্যই হউক আমি কবে না ব্যস্ত থাকি? তুমি আজি জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন?”
ম।”আমি সকল শুনিয়াছি।”
প। “কি শুনিয়াছ?”
ম। “যবনের সহিত পশুপতির মন্ত্রণা—শান্তশীলের সহিত মন্ত্রণা—দ্বার পার্শ্বে থাকিয়া সকল শুনিয়াছি।”
পশুপতির মুখমণ্ডল যেন মেঘান্ধকারে ব্যাপ্ত হইল। তিনি বহুক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকিয়া কহিলেন।
“ভালই হইয়াছে। সকল কথাই আমি তোমাকে বলিতাম—না হয় তুমি আগে শুনিয়াছ। তুমি কোন্ কথা না জান?”
ম। “পশুপতি, তুমি আমাকে ত্যাগ করিলে?”
প। “কেন, মনোরমে? তোমার জন্যই আমি এ মন্ত্রণা করিয়াছি। আমি এক্ষণে রাজভৃত্য, ইচ্ছামত কার্য্য করিতে পারি না। এখন বিধবাবিবাহ করিলে জনসমাজে পরিত্যক্ত হইব কিন্তু যখন আমি স্বয়ং রাজা হইব তখন কে আমায় ত্যাগ করিবে? যেমন বল্লাল সেন কৌলীন্যের নূতন পদ্ধতি প্রচলিত করিয়াছিলেন, আমি সেইরূপ বিধবার পরিণয়ের নূতন পদ্ধতি প্রচলিত করিব।”
মনোরম দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “পশুপতি, সে সকল আমার পক্ষে স্বপ্ন মাত্র। তুমি রাজা হইলে, আমার সে স্বপ্ন ভঙ্গ হইবে। আমি কখন তোমার মহিষী হইব না।”
প। “কেন, মনোরমে?”
ম। “কেন? তুমি রাজ্যভার গ্রহণ করিলে আর কি আমায় ভাল বাসিবে? রাজ্যই তোমার হৃদয়ে প্রধান স্থান লাভ করিবে।—তখন আমার প্রতি তোমার হতাদর হইবে। তুমি যদি ভাল না বাসিলে —তবে আমি কেন তোমার পত্নীত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ হইব?”
প। “এ কথাকে কেন মনে করিতেছ? অগ্রে তুমি—পরে রাজ্য। আমার চিরকাল এইরূপ থাকিবে।”
ম। “রাজা হইয়া যদি তাহা কর, রাজ্য অপেক্ষা প্রণয়ে যদি অধিক মনোভিনিবেশ কর তবে তুমি রাজ্য করিতে পারিবে না। তুমি রাজ্যচ্যুত হইবে। বিলাসানুরাগী রাজার রাজ্য থাকে না।”
পশুপতি প্রশংসমান চক্ষে মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। কহিলেন, “যাহার বামে এমন সরস্বতী, তাহার আশঙ্কা কি? না হয় তাহাই হউক। তোমার জন্য রাজ্য ত্যাগ করিব।”
ম। “তবে রাজ্য গ্রহণ করিতেছ কেন? ত্যাগার্থ গ্রহণে ফল কি?”
প। “তোমার পাণিগ্রহণ।”
ম। “সে আশা ত্যাগ কর। তুমি রাজ্যলাভ করিলে আমি কখন তোমার পত্নী হইব না।”
প। “কেন, মনোরমে! আমি কি অপরাধ করিলাম?”
ম। “তুমি বিশ্বাসঘাতক—আমি বিশ্বাসঘাতককে কি প্রকারে ভক্তি করিব? কি প্রকারে বিশ্বাসঘাতককে ভাল বাসিব।”
প। “কেন আমি কিসে বিশ্বাসঘাতক হইলাম?”
ম। “তোমার প্রতিপালক প্রভুকে রাজ্যচ্যুত করিবার কল্পনা করিতেছ; শরণাগত রাজপুত্রকে বধের কল্পনা করিতেছ; ইহা কি বিশ্বাসঘাতকের কর্ম্ম নয়? যে প্রভুর নিকট বিশ্বাস নষ্ট করিল, অতিথির নিকট বিশ্বাস নষ্ট করিল সে পত্নীর নিকট অবিশ্বাসী না হইবে কেন?”
পশুপতি নীরব হইয়া রহিলেন। মনােরম পুনরপি বলিতে লাগিলেন, “পশুপতি, আমি মিনতি করিতেছি এই দুরভিসন্ধি ত্যাগ কর।”
পশুপতি পূর্ব্ববৎ অধােবদনে রহিলেন, তাঁহার রাজ্যাকাঙ্ক্ষা এবং মনােরমার লাভাকাঙ্ক্ষা উভয়ই গুরুতর। কিন্তু রাজ্য লাভের যত্ন করিলে, মনোরমার প্রণয় হারাইতে হয় সেও অত্যজ্য। উভয় শঙ্কটে তাঁহার চিত্ত মধ্যে গুরুতর চাঞ্চল্য জন্মিল। তাঁহার মতির স্থিরতা দূর হইতে লাগিল। “যদি মনােরমাকে পাই ভিক্ষাও ভাল, রাজ্যে কাজ কি?” এইরূপ পুনঃ পুনঃ মনে ইচ্ছা হইতে লাগিল। কিন্তু তখনই আবার ভাবিতে লাগিলেন, “কিন্তু তাহা হইলে লােকনিন্দা, জনসমাজে কলঙ্ক, জাতিনাশ, সকলের ঘৃণিত হইব। তাহা কি প্রকারে সহিব?” পশুপতি নীরবে রহিলেন; কোন উত্তর দিতে পারিলেন না।
মনােরমা উত্তর না পাইয়া কহিতে লাগিলেন, “শুন পশুপতি, তুমি আমার কথায় উত্তর দিলে না। আমি চলিলাম। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে ইহ জন্মে আমার সাক্ষাৎ হইবে না।”
এই বলিয়া মনােরম পশ্চাৎ ফিরিলেন। পশুপতি রােদন করিয়া উঠিলেন।
অমনি মনোরমা আবার ফিরিলেন। আসিয়া পশুপতির হস্তধারণ করিলেন। পশুপতি তাঁহার মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, যে তেজোগর্ব্ববিশিষ্টা, কুঞ্চিতভ্রূবীচি-বিক্ষেপকারিণী সরস্বতী মূর্ত্তি আর নাই; কুসুম সুকুমারী বালিকা তাঁহার হস্তধারণ করিয়া তাঁহার সঙ্গে রােদন করিতেছে।
মনােরমা কহিলেন, “পশুপতি, কাঁদিতেছ কেন?”
পশুপতি চক্ষের জল মুছিয়া কহিলেন, “তােমার কথায়।” ম। “কেন, আমি কি বলিয়াছি?”
প। “তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাইতেছিলে।”
ম। “আর আমি এমন কর্ম্ম করিব না।”
প। “তুমি আমার রাজমহিষী হইবে?”
ম। “হইব।”
পশুপতির আনন্দ সাগর উছলিয়া উঠিল। উভয়ে অশ্রুপূর্ণ লোচনে উভয়ের মুখপ্রতি চাহিয়া উপবেশন করিয়া রহিলেন। সহসা মনোরমা পক্ষিণীর ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া চলিয়া গেলেন।