মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ।
ফাঁদ।
পূর্ব্বেই কথিত হইয়াছে যে বাপীতীর হইতে হেমচন্দ্র মনোরমার অনুবর্ত্তী হইয়া যবন সন্ধানে আসিতেছিলেন। মনোরমা, ধর্ম্মাধিকারের গৃহ কিছু দূরে থাকিতে, হেমচন্দ্রকে কহিলেন, “সম্মুখে এই অট্টালিকা দেখিতেছ?”
হে। “দেখিতেছি।”
ম। “ঐ গৃহে যবন প্রবেশ করিয়াছে।
হে। “কেন?”
এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া মনোরমা কহিলেন, “তুমি এইখানে বৃক্ষের অন্তরালে লুক্কায়িত থাক। যবনকে এইস্থান দিয়া যাইতে হইবে।”
হে। “তুমি কোথা যাইবে?”
ম। “আমি এই গৃহমধ্যে যাইব।”
হেমচন্দ্র স্বীকৃত হইলেন। মনোরমার আচরণ দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইলেন। তাহার পরামর্শানুসারে পথিপার্শ্বে বৃক্ষান্তরালে লুক্কায়িত হইয়া রহিলেন। মনোরমা গুপ্তপথে অলক্ষ্যে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
এই সময়ে শান্তশীল পশুপতির গৃহে আসিতেছিল। সে দেখিল যে এক ব্যক্তি বৃক্ষান্তরালে লুক্কায়িত হইল। শান্তশীল সন্দেহ প্রযুক্ত সেই বৃক্ষতলে গেল। তথায় হেমচন্দ্রকে দেখিয়া প্রথমে চৌর অনুমানে কহিল, “কে তুমি? এখানে কি করিতেছ?” পরে তৎক্ষণে হেমচন্দ্রের বহুমূল্যের অলঙ্কার শোভিত যোদ্ধৃবেশ দেখিয়া কহিল, “আপনি কে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমি যে হই না কেন?”
শা। “আপনি এখানে কি করিতেছেন?
হে। “আমি এখানে যবনানুসন্ধান করিতেছি।”
শান্তশীল চমকিত হইয়া কহিলেন, “যবন কোথায়?”
হে। “এই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।”
শান্তশীল ভীত ব্যক্তির ন্যায় স্বরে কহিলেন, “এ গৃহে কেন?”
হে। “তাহা আমি জানি না।”
শা। “এ গৃহ কাহার?”
হে। “তাহা জানি না।”
শা। “তবে আপনি কি প্রকারে জানিলেন যে এই গৃহে যবন প্রবেশ করিয়াছে?”
হে। “তা তোমার শুনিয়া কি হইবে?”
শা। “এই গৃহ আমার। যদি যবন ইহাতে প্রবেশ করিয়া থাকে তবে কোন অনিষ্ট কামনা করিয়া গিয়াছে সন্দেহ নাই। আপনি যোদ্ধা এবং যবনদ্বেষী দেখিতেছি। যদি ইচ্ছা থাকে তবে আমার সঙ্গে আসুন—উভয়ে চোরকে ধৃত করিব।”
হেমচন্দ্র সম্মত হইয়া শান্তশীলের সঙ্গে চলিলেন। শান্তশীল সিংহদ্বার দিয়া পশুপতির গৃহে হেমচন্দ্রকে লইয়া প্রবেশ করিলেন। এবং এক কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “এই গৃহমধ্যে আমার সুবর্ণ রত্নাদি সকল আছে আপনি ইহার প্রহরায় অবস্থিতি করুন। আমি ততক্ষণ সন্ধান করিয়া আসি কোন্ স্থানে যবন লুক্কায়িত আছে।”
এই কথা বলিয়াই শান্তশীল সেই কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। এবং হেমচন্দ্র কোন উত্তর দিতে না দিতেই বাহির দিকে কক্ষ দ্বার রুদ্ধ করিলেন। হেমচন্দ্র ফাঁদে পড়িয়া বন্দী হইয়া রহিলেন।