মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
নৌকা-যানে।
হেমচন্দ্র ত উপবন গৃহে সংস্থাপিত হইলেন। আর মৃণালিনী? নির্ব্বাসিতা, পরপীড়িতা, সহায়হীনা মৃণালিনী কোথায়?
সান্ধ্যগগনে রক্তিম মেঘমালা কাঞ্চনবর্ণ ত্যাগ করিয়া ক্রমে ক্রমে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিল। রজনীদত্ত তিমিরাবরণে গঙ্গার বিশাল হৃদয় অস্পষ্টীকৃত হইল। সভামণ্ডলে পরিচারক হস্তজ্বালিত দীপমালার ন্যায় অথবা প্রভাতে উদ্যানকুসুম সমূহের ন্যায়, আকাশে নক্ষত্রগণ ফুটিতে লাগিল। প্রায়ান্ধকারে নদীহৃদয়ে নৈশ সমীরণ কিঞ্চিৎ খরতর বেগে বহিতে লাগিল। তাহাতে রমণীহৃদয়ে নায়ক সংস্পর্শ জনিত প্রকল্পের ন্যায়, নদীবক্ষে তরঙ্গ উত্থিত হইতে লাগিল। কূলে তরঙ্গাভিঘাতজনিত ফেনপুঞ্জে, শ্বেতপুষ্পমালা গ্রন্থিত হইতে লাগিল। বহুলোকের কোলাহলের ন্যায় বীচিরব উত্থিত হইল। নাবিকেরা নৌ সকল তীরলগ্ন করিয়া রাত্রের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করিতে লাগিল। তন্মধ্যে একখানি ছােট ডিঙ্গী অন্য নৌকা হইতে পৃথক্ এক খালের মুখে লাগিল। নাবিকেরা আহারাদির ব্যবস্থা করিতে লাগিল।
ক্ষুদ্র তরণীতে দুইটীমাত্র আরােহী। দুইটাই স্ত্রীলােক। পাঠককে বলিতে হইবে না যে ইহারা মৃণালিনী আর গিরিজায়া।
গিরিজায়া মৃণালিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিল “আজিকার দিন কাটিল।”
মৃণালিনী কোন উত্তর করিলেন না।
গিরিজায়া পুনরপি কহিল, “কালিকার দিনও কাটিবে—পরদিনও কাটিবে—কেন কাটিবে না?”
মৃণালিনী তথাপি কোন উত্তর করিলেন না। কেবলমাত্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণী এ কি এ? দিবানিশি চিন্তা করিয়া কি হইবে? যদি আমাদিগের নবদ্বীপ যাত্রা অকর্ত্তব্য কর্ম্ম হইয়া থাকে, চল এখনও ফিরিয়া যাই।”
মৃণালিনী এবার উত্তর করিলেন। বলিলেন, “কোথায় যাইব?”
গি। “চল হৃষীকেশ গৃহে যাই।”
মৃ। “বরং এই গঙ্গাজলে অবগাহন করিয়া মরিব।”
গি “চল তবে মথুরায় যাই।”
মৃ। “আমি ত রলিয়াছি তথায় আমার স্থান নাই। কূলটার ন্যায় রাত্রিকালে যে পিতার গৃহ ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি, কি বলিয়া সে পিতার গৃহে আর মুখ দেখাইব?”
গি। “কিন্ত তুমি ত আপন ইচ্ছায় আইস নাই, অসৎ জভিপ্রায়েও আইস নাই। যাইতে ক্ষতি কি?”
মৃ। “সে কথা কে বিশ্বাস করিবে? যে পিতার গৃহে আদরের গৃহিণী ছিলাম সে পিতার গৃহে ঘৃনিত হইয়াই বা কি প্রকারে থাকিব?”
গিরিজায়া অন্ধকারে দেখিতে পাইল না, যে মৃণালিনীর চক্ষুঃ হইতে বারিবিন্দুর পর বারিবিন্দু পড়িতে লাগিল। গিরিজয়া কহিল “তবে কোথায় যাইবে?”
মৃ। “যেখানে যাইতেছি।”
গি। “সে ত সুখের যাত্রা! তবে অন্যমন কেন? যাহাকে দেখিতে ভাল বাপি তাহাকে দেখিতে যাইতেছি ইহার অপেক্ষা সুখ আর কি আছে?”
মৃ। “নবদ্বীপে আমার সহিত হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না।”
গি। “কেন? তিনি কি সেখানে নাই?”
মৃ। “সেইখানেই আছেন। কিন্ত তুমি ত জান যে আমার সহিত এক বৎসর অসাক্ষাৎ তাঁহার ব্রত। আমি কি সে ব্রত ভঙ্গ করাইব?”
গিরিজায়া নীরব হইয়া রহিল। মৃণীলিনী আবার কহিলেন, “আর কি বলিয়াই বা তাঁহার নিকট দাঁড়াইব? আমি কি বলিব যে হৃশীকেশের উপর রাগ করিয়া আসিয়াছি না বলিব যে হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছেন?”
গিরিজায়া ক্ষণেক নীরব থাকিয়া কহিল, “তবে কি নবদ্বীপে তোমার সঙ্গে হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না?”
মৃ। “না।”
গি। “তবে যাইতেছ কেন?”
মৃ। “তিনি আমাকে দেখিতে পাইবেন না কিন্তু আমি তাঁহাকে দেখিব। তাঁহাকে দেখিতেই যাইতেছি।” গিরিজায়ার মুখে হাসি ধরিল না। বলিল “তবে আমি গীত গাই।”
চরণ তলে দিনু হে শ্যাঁম পরাণ রতন।
দিবনা তোমারে নাথ মিছার যৌবন॥
এ রতন সমতুল, ইহা তুমি দিবে মূল,
দিবানিশি মোরে নাথ দিবে দরশন॥[১]
ঠাকুরাণী, তুমি তাঁহাকে দেখিয়া ত জীবন ধারণ করিবে; আমি তোমার দাসী হইয়াছি আমার ত তাহাতে পেট ভরিবে না, আমি কি খেয়ে বাঁচিব?”
মৃ। “আমি দুই একটা শিল্পকর্ম জানি। মালা গাঁথিতে জানি, চিত্র করিতে জানি, বস্ত্রে কারুকার্য্য করিতে জানি। তুমি বিপণে আমার শিল্পরচনা বিক্রয় করিয়া দিবে?”
গিরি। “আর আমি ঘরে ঘরে গীত গাইব। “মৃণাল অধমে” গাইব কি?”
মৃণালিনী অর্দ্ধসহাস্য, অর্দ্ধসকোপ দৃষ্টিতে গিরিজায়ার প্রতি কটাক্ষ করিলেন।
গিরিজায়া কহিলেন, “অমন করিয়া চাহিলে আমি গীত গাইব।” এই বলিয়া গাইল।
সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।[২]
কে আছে কাণ্ডারী হেন, কে যাইবে সঙ্গে॥
মৃণালিনী কহিল “যদি এত ভয় তবে একা এলে কেন?”
গিরিজায়া কহিলেন “আগে কি জানি।” বলিয়া গাইতে লাগিল।
“ভাসল তরি সকাল বেলা, ভাবিলাম এ জল খেলা
মধুর বহিবে বায়ু ভেসে যাব রঙ্গে।
গগনে গরজে ঘন, বহে খর সমীরণ,
কূল ত্যজি এলাম কেন? মরিতে আতঙ্গে॥”
মৃণালিনী কহিল, “কুলে ফিরিয়া যাওনা কেন?”
গিরিজায়া গাইতে লাগিল।
“মনে করি কূলে ফিরি, বাহি তরি ধীরি ধীরি,
কূলেতে কণ্টক তরু, বেষ্টিত ভূজঙ্গে।”
মৃণালিনী কহিল “তবে ডুবিয়া মর না কেন?”
গিরিজায়া কহিল, “মরি তাহাতে ক্ষতি নাই কিন্তু” বলিয়া আবার গাইল।
“যাহারে কাণ্ডারী করি, সাজাইয়া দিনু তরি;
সে কভু দিল না পদ; তরণীর অঙ্গে॥”
মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, এ কোন্ অপ্রেমিকের গান।”
গি। “কেন?”
মৃ। “আমি হইলে তরি ডুবাই।”
গি। “সাধ করিয়া?”
মৃ। “সাধ করিয়া।”
গি। “তবে তুমি জলের ভিতর কি দেখিয়াছ?”
মৃ। “দেখিয়াছি।”
গি। “কি দেখিয়াছ?”
মৃ। রত্ন