মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কুসুমনির্ম্মিতা।
উপনগর প্রান্তে, গঙ্গাতীরবর্ত্তি এক অট্টালিকা হেমচন্দ্রের বাসার্থে রাজপুরুষেরা নির্দ্দিষ্ট করিলেন। হেমচন্দ্র মাধবাচার্য্যের পরামর্শানুসারে সুরম্য অট্টালিকায় আবাস সংস্থাপিত করিলেন।
নবদ্বীপে জনার্দ্দন নামে এক বধির বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি বয়োবাহুল্য প্রযুক্ত এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের হানিপ্রযুক্ত সর্ব্বতোভাবে অসমর্থ। অথচ নিঃসহায়। তাহার সহধর্ম্মিণীও প্রাচীনা এবং শক্তিহীনা। কিছু দিন হইল ইহাদিগের পর্ণকুটীর প্রবল বাত্যায় বিনাশ প্রাপ্ত হইয়াছিল। সেই অবধি ইহারা আশ্রয়ভাবে এই বৃহৎ পূরীর এক পার্শ্বে রাজপুরুষদিগের অনুমতি লইয়া বাস করিতে ছিল। এক্ষণে কোন রাজপুত্ত্র আসিয়া তথায় বাস করিবেন শুনিয়া তাহারা পরাধিকার ত্যাগ করিয়া বাসান্তরের অন্বেষণে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিল।
হেমচন্দ্র ইহা শুনিয়া দুঃখিত হইলেন। বিবেচনা করিলেন যে এই বৃহৎ ভবনে আমাদিগের উভয়েরই স্থান হইতে পারে। ব্রাহ্মণ কেন নিরাশ্রিত হইবেন? হেমচন্দ্র দিগ্বিজয়কে আজ্ঞা করলেন, যে ব্রাহ্মণকে গৃহত্যাগ করিতে নিবারণ কর। ভৃত্য ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিল “এ কার্য্য ভৃত্য দ্বারা সম্ভব না। ব্রাহ্মণঠাকুর আমার কথা কাণে তুলেন না।”
ব্রাহ্মণ বস্তুতঃ অনেকেরই কথা কাণে তুলেন না—কেন না তিনি বধির। হেমচন্দ্র ভাবিলেন ব্রাহ্মণ অভিমান প্রযুক্ত ভৃত্যের আলাপ গ্রহণ করেন না। এজন্য স্বয়ং তৎসম্ভাষণে গেলেন। ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিলেন।
জনার্দ্দন আশীর্ব্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,
“তুমি কে?”
হে। “আমি আপনার ভৃত্য।”
জ। “কি বলিলে—তােমার নাম রামকৃষ্ণ?”
হেমচন্দ্র অনুভব করিলেন ব্রাহ্মণের শ্রবণশক্তি বড় প্রবল নহে। অতএব উচ্চতরস্বরে কহিলেন, “আমার নাম হেমচন্দ্র। আমি ব্রাহ্মণের দাস।”
জ। “ভাল ভাল; প্রথমে ভাল শুনিতে পাই নাই, তােমার নাম হনূমান দাস। হেমচন্দ্র মনে ভাবিলেন, “নামের কথা দূর হউক। কার্য্য সাধন হইলেই হইল।” বলিলেন “নবদ্বীপাধিপতির এই অট্টালিকা, তিনি ইহা আমার বাসের জন্য নিযুক্ত করিয়াছেন। শুনিলাম আমার অসায় আপনি শঙ্কিত হইয়া এস্থল ত্যাগ করিতেছেন!”
জ। “না—এখনও গঙ্গাস্নানে যাই নাই, এই স্নানের উদ্যোগ করিতেছি।”
হে। (অত্যুচ্চৈঃস্বরে) “স্নান যথা সময়ে করিবেন। এক্ষণে আমি এই অনুরােধ করিতে আসিয়াছি যে আপনি এ গৃহ ত্যাগ করিয়া যাইবেন না।”
জ। “গৃহে আহার করিব না। তােমার বাড়ীতে কি? আদ্য শ্রাদ্ধ?”
হে। “ভাল আহারাদির অভিলাষ করেন তাহার ও উদ্যোগ হইবে। এক্ষণে যেরূপ এ গৃহে অবস্থিতি করিতেছেন সেইরূপই করুন।”
জ। “ভাল ভাল; ব্রাহ্মণ ভােজন করাইলে দক্ষিণা ত আছেই। তা বলিতে হইবে না। তােমার বাটী কোন স্থানে?”
হেমচন্দ্র হতাশ্বাস হইয়া প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিলেন, এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কেহ তাঁহার উত্তরীয় ধরিয়া টানিল। হেমচন্দ্র ফিরিয়া দেখিলেন। দেখিয়া প্রথম মূহুর্তে তাঁহার বােধ হইল সম্মুখে একখানি কুসুমনির্ম্মিতা দেবী প্রতিমা। দ্বিতীয় মূহুর্তে দেখিলেন প্রতিমা সজীব; তৃতীয় মূহুর্তে দেখিলেন, প্রতিমা নহে বিধাতার নির্ম্মাণকৌশল-সীমা-রূপিণী বালিকা অথবা পূর্ণযৌবন তরুণী।
বালিকা না তরুণী? ইহা হেমচন্দ্র তাহাকে দেখিয়া নিশ্চিত করিতে পারিলেন না।
বীণানিন্দিতস্বরে সুন্দরী কহিলেন, “তুমি পিতামহকে কি বলিতেছিলা? তােমার কথা উনি শুনিতে পাইবেন কেন?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাহা ত পাইলেন না দেখিলাম। তুমি কে?”
বালিকা কহিল, “আমি মনােরম।”
হে। “ইনি তােমার পিতামহ?”
মনো। “তুমি পিতামহকে কি বলিতেছিল?”
হে। “শুনিলাম ইনি এ গৃহ ত্যাগ করিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন। আমি তাহা নিবারণ করিতে আসিয়াছি।”
ম। “এ গৃহে এক রাজপুত্ত্র আসিয়াছেন তিনি আমাদিগকে থাকিতে দিবেন কেন?”
হে। “আমিই সেই রাজপুত্ত্র। আমি তােমাদিগকে অনুরোধ করিতেছি তােমরা এখানে থাক।”
ম। “কেন?”
এ কেনর উত্তর নাই? হেমচন্দ্র অন্য উত্তর না পাইয়া কহিলেন, “কেন? মনে কর যদি তােমার সহােদর আসিয়া এই গৃহে বাস করিত সে কি তােমাদিগকে তাড়াইয়া দিত?”
ম। “তুমি কি আমার ভাই?”
হে। “আজি হইতে তােমার ভাই হইলাম। এখন বুঝিলে?”
ম। “বুঝিয়াছি। কিন্তু ভগিনী বলিয়া আমাকে কখন তিরস্কার করিবে না ত?”
হেমচন্দ্র মনােরমার কথার প্রণালীতে চমৎকৃত হইতে লাগিলেন। ভাবিলেন “একি অলৌকিক সরলা বালিকা? না উন্মাদিনী?” কহিলেন, “কেন তিরস্কার করিব?”
ম। “যদি আমি দোষ করি?”
হে। “দোষ দেখিলে কে না তিরস্কার করে?”
মনোরমা ক্ষুণ্ণভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন, বলিলেন “আমি কখন ভাই দেখি নাই; ভাইকে কি লজ্জা করিতে হয়?”
হে। “না।”
ম। “তবে আমি তােমাকে লজ্জা করিব না—তুমি আমাকে লজ্জা করিবে?”
হেমচন্দ্র হাসিলেন—কহিলেন, “আমার বক্তব্য তােমার পিতামহকে জানাইতে পারিলাম না।—তাহার উপায় কি?”
ম। “আমি বলিতেছি।” এই বলিয়া মনােরমা মৃদু মৃদু স্বরে জনার্দ্দনের নিকট হেমচন্দ্রের অভিপ্রায় জানাইলেন। হেমচন্দ্র দেখিয়া বিস্মিত হইলেন যে মনােরমার সেই মৃদু কথা বধিরের বােধগম্য হইল।
ব্রাহ্মণ আনন্দিত হইয়া রাজপুত্ত্রকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। এবং কহিলেন, “মনােরমে ব্রাহ্মণীকে বল রাজপুত্র তাঁহার নাতি হইলেন—আশীর্ব্বাদ করুন।” এই বলিয়া ব্রাহ্মণ স্বয়ং “ব্রাহ্মণি! ব্রাহ্মণি!” বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণী তখন স্থানান্তরে গৃহকার্য্যে ব্যাপৃতা ছিলেন—ডাক শুনিতে পাইলেন না। ব্রাহ্মণ অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন “ব্রাহ্মণীর ঐ বড় দোষ। কাণে কম শােনেন।”